নাসরিনের
বাবা মোতাহার সাহেব আমাদের বহু বছরের পরিচিত। ১৯৫০ সালে প্রথম যখন রেডিও
প্রোগ্রাম করি, উনি তখন ছিলেন প্রোগ্রাম এসিস্ট্যান্ট। মাইকের সামনে
কিভাবে, থেমে, দম নিয়ে পড়লে রিডিং পড়ার মতো শোনাবে না, কথা বলার মতই
শোনাবে-এই কায়দা উনিই আমাকের প্রথম শিখিয়েছিলেন।
পরবর্তীতে
মোতাহার সাহেব তার এক বন্ধু আশরাফ আলী সাহেবের সঙ্গে মিলে ‘খাওয়াতীন’
নামে যে মহিলাদের মাসিক পত্রিকা বের করেন, তাতে প্রথম দিকে আমাকে বেশ
কিছুদিন সম্পাদিকার কাজ করতে হয়েছিল। তারপর বহুদিন ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল
না। আমাদের গলিতে ওঁর মেয়েজামাই বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে, তাও জানতাম না।
হঠাৎ
একদিন সকালে দেখি, আমাদের বাসার সামনে মোতাহার সাহেব! কি ব্যাপার? উনি
শ্যামলীতে থাকতেন, এই রকম সময়ে ওদিকে থাকা নিরাপদ নয়, তাই ওঁর জামাই সামাদ
ওঁকে সপরিবারে নিজের বাসায় নিয়ে এসেছে।
মোতাহার
সাহেব এ পাড়ায় আসার পর সন্ধ্যেটা আমাদের ভালোই কাটে। খুব মজলিসী মানুষ।
কতো জায়গার খবর যে বলেন। এক সঙ্গে সবাই মিলে স্বাধীন বাংলা বেতার
কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনি। পূর্ব পাকিস্তানের রেডিও ও সংবাদপত্রের খবর,
আকাশবাণী ও বিবিসির খবর এবং স্বাধীন বাংলা বেতারের খবর চালাচালি করে আসল
খবর বের করার চেষ্টা করি। এ কাজে মোতাহার সাহেবের জুড়ি নেই। ওর ধৈর্য এবং
অধ্যবসায়েরও শেষ নেই।
মা’র
বাসায় গেছিলাম সকাল দশটায়। গিয়ে দেখি ওঁর জ্বর। রুমী সঙ্গে ছিল। ওকে
দিয়ে রুটি আনিয়ে মা’র কাছে খানিক বসে বারোটার দিকে বাড়ি ফিরে দেখি-মোতাহার
সাহেব আমাদের বসার ঘরে বসে কোথায় যেন ফোন করছেন, ওঁর চুল উষ্কখুষ্ক, মুখে
উদ্বেগের ছাপ। কি ব্যাপার? ওঁর জামাই সামাদের বড় ভাই আজ ভোরের কোচে
পাবনা রওনা দিয়েছিল। খানিকক্ষণ আগে উনি লোকমুখে খবর শুনেছেন-মিরপুরের
বিহারিরা নাকি মোহাম্মদপুরের বাঙালিদের মেরে ধরে শেষ করে দিচ্ছে; ও পথে
যত বাস, কোচ যাচ্ছে সেগুলোও থামিয়ে যাত্রীদের মেরে ফেলছে।
পাবনার
কোচ তো আরিচার পথে মোহাম্মদপুর, মিরপুরের ওপর দিয়েই যাবে। মারামারির খবর
শোনার পর থেকেই উনি ফোন করছেন কমলাপুর কোচ স্টেশনে। রিং বেজে যাচ্ছে,
কিন্তু কোচ স্টেশনে কেউ ফোন তুলছে না।
খবর
শুনে আমারও বুক ধড়ফড় করতে শুরু করল। আমাকে বাসায় নামিয়ে রুমী আবার
বেরোবার উদ্যোগ করছিল। এই খবর শোনার পর রুমীকে আর বেরোতে দিলাম না।
শরীফকে তার ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের অফিসে ফোন করে খবরটা জানিয়ে তাড়াতাড়ি
বাড়ি ফিরতে বললাম।
মোতাহার সাহেব খানিক পরপরই এসে কোচ স্টেশনে ফোন করার জন্য ডায়াল করতে লাগলেন। রিং হয়, ফোন বেজেই যায়, কেউ ধরে না।
শেষে দুটোর দিকে মোতাহার সাহেব বললেন তিনি নিজেই কমলাপুর কোচ স্টেশনে যাবেন খবর নিতে।
উনি
সামাদের ছোট ভাইকে নিয়ে কমলাপুরের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেলেন। আমরা কয়েকজন
বাড়িতে স্থির হয়ে বসতে পারছিলাম না, বাড়ির সামনে গলিতে দাঁড়িয়ে হোসেন
সাহেব, রশীদ সাহেব, আহাদ সাহেব-এঁদের সঙ্গে কথা বলে সময় কাটাতে লাগলাম।
ঘন্টা
দুয়েক পর মোতাহার সাহেব বিস্তারিত খবর নিয়ে ফিরলেন। কোচের ড্রাইভার
আড়াইটের দিকে কমলাপুর কোচ স্টেশনে ফিরলে তার মুখে সব খবর জানা যায়।
মিরপুর ব্রিজের কাছে বিহারিরা ওদের কোচ এবং অন্য একটা ছোট বাস থামিয়ে বড়
রাস্তা থেকে একটু ভেতরে নিয়ে যায়। তারপর সব যাত্রীকে নামায়। যাত্রীদের
ভয়ার্ত চিৎকার, বিহারিদের রণহুঙ্কার ইত্যাকার হৈ চৈ গোলমালের সুযোগ নিয়ে
পাবনাগামী কোচের ড্রাইভারটি বাসের তলায় লুকিয়ে পড়ে এবং সেখান থেকে পুরো
হত্যাযজ্ঞটি প্রত্যক্ষ করে। বিহারিরা যাত্রীদের নামিয়ে ধারাল দা বড়
চাকু-এসব দিয়ে মারতে থাকে। বাসে দু’জন যাত্রী ছিল তারা কেবল মক্কা থেকে
হজ্ব করে দেশে ফিরেছে। বিহারিরা কেবল ওই হাজি দু’জনকে ছেড়ে দেয়। বাকি
সবাইকে মেরে ফেলেছে। কয়েকজনকে তারা ছুরি মেরে ব্রিজের ওপর থেকে নিচে নদীতে
ফেলে দিয়েছে- ড্রাইভারটা তাও দেখেছে। মিনিবাসটাকে বিহারিরা ভেতরের
রাস্তায় আরো খানিকদূর নিয়ে গিয়েছিল। বড় রাস্তার মোড়ে কোচের যাত্রীদের
শেষ করে লাশগুলো ওখানেই ফেলে রেখে উল্লাসে উন্মত্ত বিহারিরা ঐ মিনিবাসটার
দিকে চলে যায়। তখন ড্রাইভার কোনমতে জান নিয়ে পালিয়ে কমলাপুর কোচ স্টেশনে
চলে গিয়ে সবাইকে এই খবর দেয়।
- শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বই থেকে
- শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বই থেকে
Post a Comment Blogger Facebook