গতকাল
রাতেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। ক্ষুব্ধ জনতা আবার কারফিউ লঙ্ঘন করে মিছিল
বের করেছে, গগণবিদারী শ্লোগান দিয়ে রাজপথ, জনপদ প্রকম্পিত করেছে এবং
অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ গুলি খেয়ে কালো পিচের রাস্তা রাঙা করেছে।
আজো ছটা-দুটো হরতাল।
গত তিনদিন সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত মিটিং মিছিল করে রুমী খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, বোঝা যাচ্ছে। আজ সকাল থেকে বাড়িতেই আছে। দেখে আমার প্রাণে শান্তি। চিংকু এসেছে। দু’জনে কথা বলছে খাবার টেবিলে বসে। খাবার টেবিলটাই রুমীর পছন্দ আড্ডা দেবার জন্য। বলে বলেও ওকে বসার ঘরের সোফায় বসানো যায় না।
কয়েক মাস আগে ওয়েটিং ফর গোডোতে অভিনয় করে চিংকু খুব নাম করেছে। হোটেল ইন্টারকনের সাউথ বলরুমে নাটকটা অভিনীত হয়েছিল।
মিলিটারির গুলিতে নিহত শহীদদের জন্য আজ গায়েবানা জানাজা বায়তুল মোকাররমে। তারপর শোক মিছিল।
চিংকু বারোটার দিকে চলে গেল। রুমী আর শরীফ গোসল সেরে হালকা স্যান্ডউইচ দিয়ে লাঞ্চ সারল। হেঁটে হেঁটে বায়তুল মোকাররমে যাবে, তাই এইরকম আধপেটা খাওয়া।
বিকেলে রিকশা নিয়ে আমি আর জামী বেরোলাম মালিবাগের মোড়ে ট্রাফিক আইল্যান্ডে ফারুক ইকবালের কবর দেখতে। দুই তারিখে বিকেলে রাস্তায় ব্যারিকেড দিচ্ছিল ফারুক ইকবাল অন্য ছাত্রদের সঙ্গে। সেই সময় মিলিটারি পুলিশের গুলিতে নিহত হয় সে। ক্রুদ্ধ ছাত্রজনতা এই মোড়ের ট্র্যাফিক আইল্যান্ডের ওপরই তাকে কবর দিয়েছে। রাস্তায় বিভিন্ন জায়গায় দুর্ভেদ্য ব্যারিকেড আছে বলেই গাড়ি নেইনি। একেকটা ব্যারিকেডের সামনে এসে রিকশা ছেড়ে দিই। ব্যারিকেডের পাশ দিয়ে হাঁটা রাস্তায় ওপাশে গিয়ে আরেকটা রিকশা নিই। এদিকটার কয়েকটা ব্যারিকেড ভারি চমৎকার জিনিস দিয়ে করা হয়েছে– রেলগাড়ির বগি। জামী বলল, দুই তারিখের বিকেলে মালিবাগ লেভেল ক্রসিংয়ে একটা রেলগাড়ি আটক করে সবাই। তারপর একেকটা বগি টেনে টেনে ব্যারিকেড দিয়েছে তিন-চার জায়গায়।
ফারুকের কবরের কাছে এসে দেখি কবরটা ঘিরে দড়ির রেলিং। আগরবাতি জ্বলছে। চারপাশে অনেক লোক। সন্ধ্যে হয়ে আসছে, কয়েকজন লোক মোমবাতি জ্বেলে দিল। দু’জন মৌলবী সাহেব কোরান শরীফ পড়ছিলেন, একজন লোক দুটো বড় সাইজের মোমবাতি জ্বেলে ওঁদের সামনে বসিয়ে দিল।
আজ রাতে কারফিউ নেই।
- শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বই থেকে
Post a Comment Blogger Facebook