image

image
 

A+ A-
Voice of 71 Voice of 71 Author
Title: একাত্তরের দিনগুলি: ২১ এপ্রিল, ১৯৭১
Author: Voice of 71
Rating 5 of 5 Des:
২১ এপ্রিল, ১৯৭১, বুধবার রুমীর সাথে ক’দিন ধরে খুব তর্কবিতর্ক হচ্ছে। ও যদি ওর জানা অন্য ছেলেদের মত বিছানায় পাশ-বালিশ শুইয়ে বাবা-মা...
২১ এপ্রিল, ১৯৭১, বুধবার

রুমীর সাথে ক’দিন ধরে খুব তর্কবিতর্ক হচ্ছে। ও যদি ওর জানা অন্য ছেলেদের মত বিছানায় পাশ-বালিশ শুইয়ে বাবা-মাকে লুকিয়ে পালিয়ে যুদ্ধে চলে যেত, তাহলে একদিক দিয়ে বেঁচে যেতাম। কিন্তু ঐ যে ছোটবেলা থেকে শিখিয়েছি লুকিয়ে বা পালিয়ে কিছু করবে না। নিজের ফাঁদে নিজেই ধরা পড়েছি। রুমী আমাকে বুঝিয়েই ছাড়বে, সে আমার কাছ থেকে মত আদায় করেই ছাড়বে।

কিন্তু আমি কি করে মত দেই? রুমীর কি এখন যুদ্ধ করার বয়স? এখন তো তার লেখাপড়া করার সময়। কেবল আই.এস.সি পাস করা এক ছাত্র, এখানে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়েছে, আবার আমেরিকার ইলিনয় ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজিতেও ওর অ্যাডমিশন হয়ে গেছে। এই বছরের ২ সেপ্টেম্বর থেকে সেখানে ক্লাস শুরু হবে। ওকে আমেরিকা যেতে হবে আগস্টের শেষ সপ্তাহে। সেখানে গিয়ে চার বছর পড়াশোনা করে তবে সে ইঞ্জিনিয়ার হবে। আর এই সময় সে কি না বলে যুদ্ধ করতে যাবে?

নাসিরের বাড়িতে বসেও এই তর্ক হচ্ছিল। ডাঃ নাসিরুল হক হলিফ্যামিলি হাসপাতালে শিশু বিভাগের ডাক্তার-সে আমেরিকা চলে যাবার চেষ্টা করছে। হয়ত সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই রওনা হয়ে যেতে পারবে। নাসির কিছুদিন আগেও আমাকে সাপোর্ট করেছে। আজ দেখি উল্টো সুর? আমি ক্ষুব্ধ হয়ে বললাম, "বুঝেছি কেন রুমী ঘনঘন এ বাড়িতে আসে। এ কয়দিনে সে তোমাকে বুঝিয়ে পটিয়ে ফেলেছে।"

রুমী নাসিরের কয়েক মাস বয়সের মেয়েটিকে লোফালুফি করতে করতে বলল, "কি যে বল আম্মা, আমি তো আসি এই ডল পুতুলটাতে আদর করতে। মামার সাথে আমার এ নিয়ে কথাই হয় নি। কিন্তু আম্মা, তোমাকে গত দু’সপ্তাহ ধরে যা বুঝিয়েছি তার সিকি ভাগ মামাকে বললে মামা কনভিনসড হয়ে যেত। আম্মা শোন, ছাত্রজীবন লেখাপড়া করার সময় এসবই চিরকালীন সত্য; কিন্তু ১৯৭১ সালের এই এপ্রিল মাসে এই চিরকালীন সত্যটা কি মিথ্যে হয়ে যায় নি? চেয়ে দেখ, দেশের কোথায় সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনধারা বজায় আছে? কোথাও নেই। সমস্ত দেশটা পাকিস্তানি মিলিটারি জান্টার টার্গেট প্র্যাকটিসের জায়গা হয়ে উঠেছে। রোমান গ্ল্যাডিয়েটরের চেয়েও আমাদের অবস্থা খারাপ। একটা গ্ল্যাডিয়েটরের তবু কিছুটা আশা থাকত, একটা সিংহের সঙ্গে ঝুটোপুটি করতে করতে সে জিতেও যেতে পারে। কিন্তু এখানে? সেই ঝুটোপুটি করার সুযোগটুকু পর্যন্ত নেই। হাত আর চোখ বেঁধে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে, কটকট করে কতকগুলো গুলি ছুটে যাচ্ছে, মুহুর্তে লোকগুলো মরে যাচ্ছে। এই রকম অবস্থার মধ্য থেকে লেখাপড়া করে মানুষ হবার প্রক্রিয়াটা খুব বেশি সেকেলে বলে মনে হচ্ছে না কি?"

"তুইতো এখানে পড়বি না। আই.আই.টি’তে তোর ক্লাস শুরু হবে সেপ্টেম্বরে, তোকে না হয় কয়েক মাস আগেই আমেরিকা পাঠিয়ে দেব।"

"আম্মা, দেশের এই রকম অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও, আমি হয়তো যাব শেষ পর্যন্ত। কিন্তু তাহলে আমার বিবেক চিরকালের মতো অপরাধী করে রাখবে আমাকে। আমেরিকা থেকে হয়ত বড় ডিগ্রি নিয়ে এসে বড় ইঞ্জিনিয়ার হবো; কিন্তু বিবেকের ভ্রুকুটির সামনে কোনদিনও মাখা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব না। তুমি কি তাই চাও আম্মা?"

কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতার উজ্জ্বল তারকা রুমী কোনদিনই বিতর্কে হারে নি প্রতিপক্ষের কাছে, আজই বা সে হারবে কেন?

আমি জোরে দুই চোখ বন্ধ করে বললাম। "না,তা চাই নে। ঠিক আছে, তোর কথাই মেনে নিলাম। দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে। যা, তুই যুদ্ধে যা।"

- শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বই থেকে

About Author

Advertisement

Post a Comment Blogger

Emoticon
:) :)) ;(( :-) =)) ;( ;-( :d :-d @-) :p :o :>) (o) [-( :-? (p) :-s (m) 8-) :-t :-b b-( :-# =p~ $-) (b) (f) x-) (k) (h) (c) cheer
Click to see the code!
To insert emoticon you must added at least one space before the code.

 
Top
Chat here...