ছ’টা-দুটো হরতাল চলছেই।
শরীফ আর রুমী আজ সকালে হাঁটতে হাঁটতে ব্লাড ব্যাঙ্কে গিয়ে রক্ত দিয়ে এল। আমি আর জামী বাদ গেলাম যথাক্রমে অ্যানিমিক ও ছোট বলে।
গতকালকার আলোচনার পর থেকে কিটি কেমন যেন চুপ করে মেরে গেছে।
শরীফরাও রক্ত দিতে যাবার আগে, সে যেরকম মুখ করে ওদের দিকে তাকিয়েছিল, তাতে মনে হল, সেও বোধহয় রক্ত দিতে যেতে চাইছে। কিন্তু কপাল ভালো, শেষ পর্যন্ত কিটি মুখ খুলল না।
আমার বেশ খারাপ লাগছে কিটির কথা ভেবে। এখানে আসার দিন পনের পর থেকেই ও আমাকে আম্মা বলা শুরু করেছে। মাস দেড়েক পর থেকে শরীফকেও আব্বা বলছে। ও আমাদের পরিবারে মিশে যেতে চায়, সব ব্যাপারে অংশ নিতে চায়। কিন্তু ওর সোনালি চুল, নীল চোখ রাস্তায় লোকজনের মুখে ভ্রুকুটি এনে দেয়। পাড়ার লোকেরাও এখন আর ভালো চোখে দেখে না ওকে। বাসায় মেহমান এসেও ওকে দেখে কেমন যেন অস্বস্তিতে পড়ে যায়। আমরা যখন সকলে মিলে গলা ফাটিয়ে তর্ক, আলাপ-আলোচনায় মেতে উঠি, তখন কিটি এসে দাঁড়ালে আমরা থমকে যাই। মাতৃভাষায় যত কথা কলকল করে বলতে পারি, ইংরেজিতে তত ফ্লো আসে না। ফলে আলাপ হোঁচট খায়। তাতে ও সন্দেহ করে ওকে দেখে আমরা বুঝি কথা ছাপাচ্ছি। আমরা বাংলায় আলাপ চালিয়ে রাখলে সব কথা বুঝতে পারে না। তখন উল্টো মাইন্ড করে। ভারি এক ফাটা বাঁশের মধ্যে পড়েছি যেন!
আজ দুপুর একটা পাঁচ মিনিটে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। শরীফ সাড়ে বারোটার মধ্যেই গোসল সেরে রেডি– প্রেসিডেন্ট কি বলেন, তা শোনার জন্য সকলেই চনমন করছি। এক তারিখের ঘোষণায় তো লঙ্কাকান্ড বেঁধে গেছে, এখন আবার কি বলেন, তা নিয়ে আমাদের মধ্যে জল্পনা-কল্পনার অন্ত নেই। আগামীকাল রেসকোর্সে গণজমায়েতে শেখ কি বলবেন, তা নিয়েও লোকজনের জল্পনা-কল্পনার অবধি নেই। এক তারিখে হোটেল পূর্বাণীতে তিনি বলেছিলেন, বাংলার মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জনের কর্মসুচীর ঘোষণা তিনি সাত তারিখে দেবেন। কিন্তু এ ক’দিনে ঘটনা তো অন্য খাতে বইছে। এত মিছিল, মিটিং, প্রতিবাদ, কারফিউ ভঙ্গ, গুলিতে শয়ে শয়ে লোক নিহত– এর প্রেক্ষিতে শেখ আগামীকাল কি ঘোষণা দেবেন? কেউ বলছে, উনি আগামীকাল স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। কেউ বলছে, দূর তা কি করে হবে? উনি নির্বাচনে জিতে গণপ্রতিনিধি, মেজরিটি পার্টির লিডার, উনি দাবির জোরে সরকার গঠন করবেন, স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করবেন। এখন স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে সেটা তো রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়বে। কেউ বলছে, আগামীকালের মিটিংয়ের ব্যাপারে ভয় পেয়ে ইয়াহিয়া আজ ভাষণ দিচ্ছে।
ভাষণ শুনে সবাই ক্ষুব্ধ এবং উত্তেজিত। আমি হেসে শরীফকে বললাম, "তুমি কি আশা করেছিলে? ইয়াহিয়া ‘এসো বধু আধ আঁচরে বসো’ বলে মুজিবকে ডেকে সরকার গঠন করতে বলবে?"
"না, অতটা আশা না করলেও ওরকম কর্কশ গলায় ধমক-ধামকও আশা করিনি। যতো দোষ নন্দঘোষ বলে উনি যেভাবে আমাদের গালাগালি করলেন, সেটা মোটেই আমাদের প্রাপ্য নয়। বর্তমান পরিস্থিতির জন্য উনিই তো দায়ী।"
"যাই বলো, ভয় পেয়েছে কিন্তু। দেখলে না ২৫ মার্চ অধিবেশন বসার ঘোষণা দিল?"
রুমী চটা গলায় বলে উঠল, "আর সামরিক বাহিনী দিয়ে আমাদের শায়েস্তা করার ঘুমকী দিল যে? সেটা কি?"
এইসব কচাকচি করতে করতে দুপুরের খাওয়া শেষ হল। শরীফ ও রুমিকে বাইরে যাবার জন্য তৈরি হতে দেখে বললাম, "কোথায় যাচ্ছ?"
"অফিসে।"
"অফিসে? আজ না শনিবার, হাফ?"
রুমী হেসে উঠে বলল, "আম্মা ভুলে গেছ, এখন না বিকেলে অফিস-কাচারি চলছে?"
আমি বিমুঢ় হয়ে বললাম, "তাতে কি? হাফের দিন হাফ থাকবে না?"
"নিশ্চয়ই থাকবে। হাফ ছুটিটা সকালেই হয়ে গেছে, এখন হাফ অফিস। দেখছ না, এখন উলট-পুরাণের যুগ চলছে।"
"তাই বটে। কিন্তু তুই কোথায় যাচ্ছিস?"
"আমি? আমিও অফিসে যাচ্ছি। ও আম্মা, তুমি কি ভুলে গেছ আমি আব্বুর অফিসে ড্রয়িং করতে যাই? তাছাড়া এখন যে বেবী চাচার সঙ্গে কাজ করি?"
ভুলেই গেছিলাম বটে! রুমি গত বছর আই.এস.সি পরীক্ষা দেবার পর খেকে শরীফের অফিসে টুকটাক ড্রয়িংয়ের কাজ করে। রেজাল্ট বেরোবার পর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হযেছে গত বছর অক্টোবরে; কিন্তু তখনিই কলেজ থেকে বলে দেওয়া হয়েছিল ক্লাস শুরু হবে একাত্তরের মার্চ থেকে। তাই বসে না থেকে শরীফের অফিসের কাজটা চালিয়ে যাচ্ছে, সেটাও তার সব সময় করতে ভালো লাগে না। তাই বিভাগীয় প্রধানের বিশেষ অনুমতি নিয়ে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকনমিকস বিভাগে ক্লাসও করে। এখন তো মার্চে এই তোলপাড় ব্যাপার। পড়াশোনা এতদিন শিকেয় তোলা ছিল, এবার টংয়ে উঠল।
বাংলা একাডেমিতে আজ শিল্পীদের জরুরী সভা আড়াইটেয়। যদিও আমি শিল্পী বা সাহিত্যিক নই, কিন্তু ঢাকায় সেই ১৯৪৯ সাল থেকে আছি বলে বেশির ভাগ শিল্পী-সাহিত্যিকদের সঙ্গেই ব্যক্তিগত পরিচয় ও আলাপ আছে। তাই শিল্প সাহিত্য-বিষয়ক সভা, সমিতি, সেমিনার, আন্দোলন ইত্যাদিতে দর্শক ও পর্যবেক্ষকের ন্ডূমিকায় সব সময়ই গিয়ে থাকি।
কিন্তু আজও বাধা পড়ল। বাবাকে ওঠানোর ভার জামীর ওপর দিয়ে তিনটের দিকে বেরোব ভেবেছিলাম। কিন্তু বাবা হঠাৎ পৌনে তিনটেয় জেগে ডাক দিলেন- "মা একটু শোন তো।"
"কি ব্যাপার?"
"মনে হচ্ছে খাটটা দুলছে।"
বুঝলাম। ব্লাড প্রেশার বেড়েছে। ব্লাড প্রেসার বাড়লেই ওর মনে হয় খাট, দেয়াল, ছাদ সব দুলছে। রুমীর ওপর রাগ হল। কাল রাতে রুমী অনেকক্ষণ ধরে বাবাকে দেশের পরিস্থিতি বুঝিয়েছে। অন্ধ মানুষ, বয়স প্রায় নব্বই, হাই রাড প্রেসারের জন্য সব সময়ে ধরে ধরে সব করাতে হয়। তাঁর ওপর সামান্য মানসিক চাঞ্চল্য হলেই আর রক্ষা নেই। প্রেসার একেবারে দশতলায় উঠে বসে থাকে। তাকে বাঙ্গালি জাতির অধিকার আদায়ের এই মরণপণ আন্দোলনের সাতকাহন না শোনালেই নয়? প্রতিবেশী ডাক্তার, এ. কে. খানও নেই ঢাকায়, রাজশাহীতে পোস্টেড। তার অবর্তমানে কখনো ডাঃ নূরুল ইসলাম, কখলো ডাঃ রব দেখেন বাবাকে। কিন্তু এখন ওদের বিশ্রামের সময়। পাঁচটার আগে ডাকা ঠিক হবে না। তাই ফোন করে শরীফকেই তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আসতে বললাম।
পাঁচটার পর ডাঃ নুরুল ইসলামকে ফোন করলাম। উনি বাড়ি নেই। সৌভাগ্যবশত ডাঃ রবকে পেয়ে গেলাম। উনি বললেন, "এখন তো ভাই আমার গাড়িটা নেই। রুমীকে পাঠিয়ে দিতে পারেন আমাকে নিয়ে যাবার জন্য ?"
অতীতে রুমী বহুবার ওঁকে গাড়ি করে নিয়ে এসেছে।
রুমীকে গাড়ি নিয়ে যাবার জন্য বলতেই সে বলল, "এখন তো ওই রাস্তায় গাড়ি নেয়া যাবে না। এখন যে ওই রাস্তা দিয়ে মিছিল যাবে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি।"
তাইতো। ডাঃ রবের বাড়ি মিরপুরে মেইন রোডের ওপর। গত ক’দিন ধরে রোজই সন্ধ্যায় সব মিছিল ওই রাস্তা দিয়ে গিয়ে শেষ হয় বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে।
- শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বই থেকে
রুমী হেসে উঠে বলল, "আম্মা ভুলে গেছ, এখন না বিকেলে অফিস-কাচারি চলছে?"
আমি বিমুঢ় হয়ে বললাম, "তাতে কি? হাফের দিন হাফ থাকবে না?"
"নিশ্চয়ই থাকবে। হাফ ছুটিটা সকালেই হয়ে গেছে, এখন হাফ অফিস। দেখছ না, এখন উলট-পুরাণের যুগ চলছে।"
"তাই বটে। কিন্তু তুই কোথায় যাচ্ছিস?"
"আমি? আমিও অফিসে যাচ্ছি। ও আম্মা, তুমি কি ভুলে গেছ আমি আব্বুর অফিসে ড্রয়িং করতে যাই? তাছাড়া এখন যে বেবী চাচার সঙ্গে কাজ করি?"
ভুলেই গেছিলাম বটে! রুমি গত বছর আই.এস.সি পরীক্ষা দেবার পর খেকে শরীফের অফিসে টুকটাক ড্রয়িংয়ের কাজ করে। রেজাল্ট বেরোবার পর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হযেছে গত বছর অক্টোবরে; কিন্তু তখনিই কলেজ থেকে বলে দেওয়া হয়েছিল ক্লাস শুরু হবে একাত্তরের মার্চ থেকে। তাই বসে না থেকে শরীফের অফিসের কাজটা চালিয়ে যাচ্ছে, সেটাও তার সব সময় করতে ভালো লাগে না। তাই বিভাগীয় প্রধানের বিশেষ অনুমতি নিয়ে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকনমিকস বিভাগে ক্লাসও করে। এখন তো মার্চে এই তোলপাড় ব্যাপার। পড়াশোনা এতদিন শিকেয় তোলা ছিল, এবার টংয়ে উঠল।
বাংলা একাডেমিতে আজ শিল্পীদের জরুরী সভা আড়াইটেয়। যদিও আমি শিল্পী বা সাহিত্যিক নই, কিন্তু ঢাকায় সেই ১৯৪৯ সাল থেকে আছি বলে বেশির ভাগ শিল্পী-সাহিত্যিকদের সঙ্গেই ব্যক্তিগত পরিচয় ও আলাপ আছে। তাই শিল্প সাহিত্য-বিষয়ক সভা, সমিতি, সেমিনার, আন্দোলন ইত্যাদিতে দর্শক ও পর্যবেক্ষকের ন্ডূমিকায় সব সময়ই গিয়ে থাকি।
কিন্তু আজও বাধা পড়ল। বাবাকে ওঠানোর ভার জামীর ওপর দিয়ে তিনটের দিকে বেরোব ভেবেছিলাম। কিন্তু বাবা হঠাৎ পৌনে তিনটেয় জেগে ডাক দিলেন- "মা একটু শোন তো।"
"কি ব্যাপার?"
"মনে হচ্ছে খাটটা দুলছে।"
বুঝলাম। ব্লাড প্রেশার বেড়েছে। ব্লাড প্রেসার বাড়লেই ওর মনে হয় খাট, দেয়াল, ছাদ সব দুলছে। রুমীর ওপর রাগ হল। কাল রাতে রুমী অনেকক্ষণ ধরে বাবাকে দেশের পরিস্থিতি বুঝিয়েছে। অন্ধ মানুষ, বয়স প্রায় নব্বই, হাই রাড প্রেসারের জন্য সব সময়ে ধরে ধরে সব করাতে হয়। তাঁর ওপর সামান্য মানসিক চাঞ্চল্য হলেই আর রক্ষা নেই। প্রেসার একেবারে দশতলায় উঠে বসে থাকে। তাকে বাঙ্গালি জাতির অধিকার আদায়ের এই মরণপণ আন্দোলনের সাতকাহন না শোনালেই নয়? প্রতিবেশী ডাক্তার, এ. কে. খানও নেই ঢাকায়, রাজশাহীতে পোস্টেড। তার অবর্তমানে কখনো ডাঃ নূরুল ইসলাম, কখলো ডাঃ রব দেখেন বাবাকে। কিন্তু এখন ওদের বিশ্রামের সময়। পাঁচটার আগে ডাকা ঠিক হবে না। তাই ফোন করে শরীফকেই তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আসতে বললাম।
পাঁচটার পর ডাঃ নুরুল ইসলামকে ফোন করলাম। উনি বাড়ি নেই। সৌভাগ্যবশত ডাঃ রবকে পেয়ে গেলাম। উনি বললেন, "এখন তো ভাই আমার গাড়িটা নেই। রুমীকে পাঠিয়ে দিতে পারেন আমাকে নিয়ে যাবার জন্য ?"
অতীতে রুমী বহুবার ওঁকে গাড়ি করে নিয়ে এসেছে।
রুমীকে গাড়ি নিয়ে যাবার জন্য বলতেই সে বলল, "এখন তো ওই রাস্তায় গাড়ি নেয়া যাবে না। এখন যে ওই রাস্তা দিয়ে মিছিল যাবে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি।"
তাইতো। ডাঃ রবের বাড়ি মিরপুরে মেইন রোডের ওপর। গত ক’দিন ধরে রোজই সন্ধ্যায় সব মিছিল ওই রাস্তা দিয়ে গিয়ে শেষ হয় বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে।
- শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বই থেকে
Post a Comment Blogger Facebook