image

image
 

A+ A-
Voice of 71 Voice of 71 Author
Title: একাত্তরের দিনগুলি: ৯ এপ্রিল, ১৯৭১
Author: Voice of 71
Rating 5 of 5 Des:
৯ এপ্রিল, ১৯৭১, শুক্রবার কারফিউয়ের মেয়াদ ধীরে ধীরে কমছে। পাঁচ তারিখে ছ’টা-ছ’টা ছিল। ছয় তারিখ থেকে সাড়ে সাতটা-পাঁচটা দিয়েছিল। গতকাল...
৯ এপ্রিল, ১৯৭১, শুক্রবার

কারফিউয়ের মেয়াদ ধীরে ধীরে কমছে। পাঁচ তারিখে ছ’টা-ছ’টা ছিল। ছয় তারিখ থেকে সাড়ে সাতটা-পাঁচটা দিয়েছিল। গতকাল থেকে আরো কমিয়ে ৯টা-৫টা করেছে।

বদিউজ্জামানরা সবাই মা’র বাড়ির একতলা থেকে চলে গেছে নিজ নিজ বাসায়।

রফিকরা ওয়াহিদের বাসা থেকে সরে মা’র ঝড়ির একতলায় এসে উঠেছে। তিন নম্বর রোডে ওয়াহিদের বাসার কাছাকাছি মিলিটারিদের চলাফেরা খুব বেড়ে গেছে, কি একটা চেকপোস্ট না কি যেন হয়েছে। মা’র বাড়ি ছ’নম্বর রোডের ভেতরে বলে কিছুটা নিরিবিলি।

কপাল ভালো, আগের দিনই অজিত নিয়োগী চলে গেছেন। ওঁর কিছু বন্ধু প্রথমে আমাদের বাসায় এসে খোঁজ করেন। তারপর মা’র বাসা থেকে খুব সাবধানে ওঁকে গাড়ির ভেতরে চাদর মুড়ি দিয়ে বসিয়ে অন্যত্র নিয়ে গেছেন। শুনলাম, গ্রামের বাড়িতে যাবেন। যেখানেই যান, ভালো থাকুন।

২৫ মার্চ কালরাত্রির পর কয়েকটা দিন রুমী একেবারে থম ধরে ছিল। টেপা ঠোট, শক্ত চোয়াল উদভ্রান্ত চোখের দৃষ্টিতে ভেতরের প্রচণ্ড আক্ষেপ যেন জমাট বেঁধে থাকত। এখন একটু সহজ হয়েছে। কথাবার্তা বলে, মন্তব্য করে, রাগ করে, তর্ক করে। বন্ধুদের বাড়ি দৌড়োদৌড়ি করে, নানা রকম খবর নিয়ে আসে।

আজ বলল, “জান আম্মা, বর্ডার এলাকাগুলোতে না যুদ্ধ হচ্ছে।”

শুনেই চমকে গেলাম, “যাঃ তা কি করে হবে? সবখানে তো মেরে ধরে পুড়িয়ে শেষ করে দিচ্ছে।”

তা হয়তো দিচ্ছে। পঁচিশের রাত থেকে যেখানে যেখানে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল, পাকিস্তানিরা সেসব জায়গা আবার দখল করে নিচ্ছে-এটাও সত্যি। কিন্তু সেগুলো তারা এমনি এমনি দখল করতে পারছে না। সেসব জায়গায় তুমুল যুদ্ধ হচ্ছে। বহু জায়গায় বাঙালি আর্মি অফিসাররা রিভোল্ট করেছে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে ই.পি.আর, ই.বি.আর, পুলিশ, আনসারের লোকজন। ঢাকা থেকে বহু ছেলেছোকরা বর্ডারের দিকে লুকিয়ে চলে যাচ্ছে যুদ্ধ করবে বলে। পাক আর্মি যেসব থানা, গ্রাম, মহকুমা জ্বালিয়ে দিয়েছে, সেখানকার লোকজনেরাও বর্ডারের দিকে পালিয়ে যাচ্ছে যুদ্ধ করতে।”

“পালাচ্ছে ঠিকই। তবে যুদ্ধ করতে কি? ওরা তো সব পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে।”

“তা নিচ্ছে ঠিকই। কিন্তু আম্মা, যুদ্ধও হচ্ছে।”

“তুই এত কথা কোথায়, কার কাছে শুনিস?”

“সবখানে-সবার কাছে। আমার বন্ধুদের অনেকের আত্মীয়স্বজন মফস্বল থেকে ঢাকায় আসছে। তাদের কাছে।”

বিশ্বাস হতে চায় না। হায়রে, আমার কোনো আত্মীয় যদি এমনি মফস্বল থেকে আসত, তাহলে তার মুখে শুনে বিশ্বাস হত।

রুমী বলল, “আমার জানাশোনা অনেক ছেলে বাড়িতে না-বলে লুকিয়ে চলে গেছে।”

আমি অবিশ্বাসের সুরে বললাম, “কই কারা গেছে, নাম বলতো।”

“ কেন, বাবু ভাই আর চিংকু ভাই।”

আমি আবার চমকালাম, “ওরা তো চাটগাঁ গেল।”

রুমী হাসল, “আসলে ওরা যুদ্ধেই গেছে।”

“কোথায় যুদ্ধ হচ্ছে?”

“তাতো ঠিক করে কেউ বলতে পারছে না। ওরা খোঁজ করতে করতে যাবে।”

আমি স্তদ্ধ হয়ে বসে রইলাম। কি রকম ভালো মানুষের মতো মুখ করে ওয়াহিদ এই তো কয়েকদিন আগে বলে গেল মা’র সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে চাটগাঁর গ্রামের বাড়িতে। চিংকুও যাচ্ছে তার সঙ্গে। চিংকুর ফুপা চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ও ফুফার বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছে।

রুমী খুব আস্তে কিন্তু দৃঢ় গলায় বলল, “আম্মা। আমি যুদ্ধে যেতে চাই।”

কি সর্বনেশে কথা। রুমী যুদ্ধে যেতে চায়! কিন্তু যুদ্ধটা কোথায়? কেউ তো ঠিক করে বলতে পারছে না। সবখানে ওধু জল্লাদের নৃশংস হত্যার উল্লাস-হাতবাঁধা, চোখবাঁধা অসহায় নিরীহ জনগণের ওপর হায়েনাদের ঝাঁপিয়ে পড়ার নিষ্ঠুর মত্ততা। যুদ্ধ হচ্ছে-এ কথা ধরে নিলেও তা এতই অসম যুদ্ধ যে কয়েকদিনের মধ্যেই পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের আধুনিকতম মারণাস্ত্র দিয়ে বিদ্রোহী বাঙালিদের গুঁড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেবে। সবখান থেকে তো সেই খবরই শুনতে পাচ্ছি। এই রকম অবস্থায় রুমীকে যুদ্ধে যেতে দিই কি বলে? মাত্র বিশ বছর বয়স রুমীর! কেবল আই.এস.সি পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢ়ুকেছে। ও যুদ্ধের কি বোঝে? ও কি যুদ্ধ করবে?

- শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বই থেকে

About Author

Advertisement

Post a Comment Blogger

 
Top