![]() |
৩ এপ্রিল, ১৯৭১, শনিবার
মর্নিং নিউজ-এর একটা হেডলাইনের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম: অ্যাকশান এগেইনস্ট মিসক্রিয়ান্টস অ্যাট জিঞ্জিরা-জিঞ্জিরায় দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ।
গতকাল থেকে লোকের মুখে মুখে যে আশঙ্কার কথাই ছড়াচ্ছিল সেটা তাহলে সত্যি? ক’দিন থেকে ঢাকার লোক পালিয়ে জিঞ্জিরায় গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছিল। গতকাল সকাল পাকিস্তান আর্মি সেখানে কামান নিয়ে গিয়ে গোলাবর্ষণ করেছে। বহু লোক মারা গেছে।
খবরটা আমরা গতকাল প্রথম শুনি রফিকের কাছে। ধানমন্ডির তিন নম্বর রাস্তায় ওয়াহিদের বাসা থেকে রফিক প্রায় প্রায়ই হাঁটতে হাঁটতে আমাদের বাসায় বেড়াতে আসে। নিউ মার্কেটে বাজার করতে এলেও মাঝে মাঝে ঢুঁ মারে। শরীফের সঙ্গে বসে বসে নিচু গলায় পরস্পরের শোনা খবর বিনিময় করে।
রফিকের মুখে শোনার পর যাকেই ফোন করি বা যার সঙ্গেই দেখা হয়-তার মুখেই জিঞ্জিরার কথা। সবার মুখ শুকনো। কিন্তু কেউই খবরের কোনো সমর্থন দিতে পারে না। আজ মর্নিং নিউজ অন্তত নিষ্ঠুরভাবে সেটার সমর্থন দিয়েছে। খবরে লেখা হয়েছে: দুষ্কৃতকারীরা দেশের ভেতরে নির্দোষ ও শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের হয়রান করছে। বুড়িগঙ্গার দক্ষিণে জিঞ্জিরায় সম্মিলিত এরকম একটা দুষ্কৃতকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এরা শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের স্বাভাবিক জীবনযাপন প্রকৃয়ায় বাধা সৃষ্টি করছিল। এলাকাটি দুষ্কৃতকারীমুক্ত করা হয়েছে।
দুপুরের পর রঞ্জু এল বিষণ্ণ গম্ভীর মুখে। এমনিতে হাসিখুশি, টগবগে তরুণ। আজ সেও স্তব্ধ, স্তম্ভিত। সোফাতে বসেই বলল, “উঃ ফুপু আম্মা। কি যেন সাংঘাতিক ব্যাপার ঘটেছে জিঞ্জিরায়। কচি বাচ্চা, থুত্থুড়ে বুড়ো-কাউকে রেহাই দেয়নি জল্লাদরা। কি করে পারল?”
আমি বললাম, “কেন পারবে না? গত কদিনে ঢাকায় যা করেছে, তা থেকে বুঝতে পার না যে ওরা সব পারে?”
“ফুপু আম্মা, আমার এক কলিগ ওখানে পালিয়েছিল সবাইকে নিয়ে। সে আজ একা ফিরে এসেছে-একেবারে বদ্ধ পাগল হয়ে গেছে। তার বুড়ো মা, বউ, তিন বাচ্চা, ছোট একটা ভাই স-ব মারা গেছে। সে সকালবেলা নাশতা কিনতে একটু দুরে গেছিল বলে নিজে বেঁচে গেছে। কিন্তু এখন সে বুক-মাথা চাপড়ে কেঁদে গড়াগড়ি যাচ্ছে, আর বলছে, সে কেন বাঁচল? উঃ ফুপু আম্মা, চোখে দেখা যায় না তার কষ্ট।”
“অথচ কাগজে লিখেছে ওরা নাকি দুষ্কৃতকারী।”
শরীফ বাইরে গিয়েছিল, বাড়ি ফিরেই আরেকটি বম্বশেল ফাটাল, “শুনছো, হামিদুল্লাহ, বউ-ছেলে নিয়ে নৌকায় করে ওদের গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিল। জিঞ্জিরার কাছে পাক আর্মির গোলা গিয়ে পড়ে ওদের নৌকায়। ওর ছেলেটা মারা গেছে, বউ ভীষণভাবে জখম।”
হামিদুল্লাহর বউ সিদ্দিকাকে ওর বিয়ের আগে থেকেই চিনতাম। ভারি ভালো মেয়ে। হামিদুল্লাহ, ইস্টার্ন ব্যাঙ্কিং কর্পোরেশনের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর, সেও খুব নিরীহ নির্বিরোধী মানুষ। একটাই সন্তান ওদের, তার এরকম মর্মান্তিক মৃত্যু। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। খবর কাগজটা তুলে বললাম, “অথচ সামরিক সরকার ওদেরকে দুষ্কৃতকারী বলছে।”
বিকেলে রেবা-মিনি ভাই বেড়াতে এল। তাদেরও মুখ থমথমে। মিনি ভাইয়ের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় খোন্দকার সাত্তার-তিনিও তাঁর পরিবার-পরিজন নিয়ে নৌকায় করে দেশের বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। কামানের গোলার টুকরো তাদের নৌকাতেও গিয়ে পড়ে। নৌকায় ওঁর ছোট ভাই এবং আরো কয়েকজন গুরুতর জখম হয়েছে।
- শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বই থেকে
Post a Comment Blogger Facebook
Click to see the code!
To insert emoticon you must added at least one space before the code.