![]() |
ইংরেজি বিভাগের জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ও তার স্ত্রী বাসন্তীদির খবর নেবার জন্য চৌত্রিশ নম্বর বিল্ডিংয়ে গেলাম। পাঁচদিন পরেও সামনের ছোট বারান্দায় পুরু হয়ে জমাট-বাঁধা রক্ত শুকিয়ে কালচে হয়ে আছে। হাসিন জাহানদের ফ্ল্যাটে এখনো তালা ঝুলছে। বাসন্তীদির ফ্ল্যাটের দরজায় কড়া নাড়লে একজন বুড়োমত লোক বেরিয়ে এসে বলল, কেউ বাড়ি নেই। কোথায় গেছেন জিগ্যেস করাতে বলল, জানে না। জ্যোতির্ময় দাদাবাবুকে কোন হাসপাতালে নেয়া হয়েছে তাও সে জানে না। নিরাশ হয়ে ফিরে এলাম। একা একা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ করতে সাহস হল না।
একটা একটা করে দিন যাচ্ছে, আর লোকমুখে পাকিস্তানী আর্মির বর্বরতার নতুন নতুন খবর কানে এসে মনমানসিকতা সব অসাড় করে দিচ্ছে। দিনরাত কি এক দুঃস্বপ্নের ঘোরে কাটছে। আর গুজবই যে কত। একটা করে গুজব শুনি আর ভয়ে আঁতকে উঠে হুটোপুটি লাগিয়ে দিই। যেমন আজকে এগারোটার দিকে মিনিভাই এলেন রুমী জামীকে নিয়ে। রুমী-জামী আর থাকতে চায় না গুলশানে। মনে হচ্ছে ভয়ের আর কারণ নেই। ড্রয়িংরুমে বসে গল্পগুজব হচ্ছে। বারেককে মোড়ের দোকানে পাঠিয়েছি চা-পাতা কিনতে। খানিক পরে সে ফিরে এসে ভয়ার্ত মুখে বলল, “আম্মা ঐ মোড়ের দোকানে একজন বিহারি জিগাই ছিল রুমী ভাইয়া বাসায় আছে কি না।”
ব্যস অমনি তাড়াহুড়ো লেগে গেল। রুমী-জামীকে তক্ষুণি মিনিভাইয়ের সঙ্গে গাড়িতে তুলে আবার গুলশানে রওনা করিয়ে দিলাম।
আড়াইটার সময় হঠাৎ একটা সুটকেস হাতে অজিত নিয়োগী এসে হাজির। আমরা হতবাক। নিয়োগী দাদার মুখে চার/পাঁচ দিনের খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখ টকটকে লাল, কাপড়-চোপড় ময়লা, কুঁচকানো, গাল বসে গেছে, চুল জট পাকিয়ে গেছে। অবাক ভাবটা কাটার পর আমি হঠাৎ পাগলের মত হাসতে লাগলাম। “কি নিয়োগী দাদা। রক্তস্রোত নাকি অল্পের জন্য এড়াতে পারা গেছে?”
শরীফ মৃদুস্বরে ধমক দিল, “পাগল হলে নাকি? ওঁকে সুস্থির হতে দাও। বসুন মিঃ নিয়োগী।” শরীফ ওর হাত থেকে সুটকেসটা নিল।
“কোথায় ছিলেন এ কয়দিন।”
সিদ্ধেশ্বরীর এক লোকের গোয়ালঘরের পাশের এক ঘুপচি টিনের ঘরে এ ক’দিন কাটিয়েছেন। মশারি ছিল না, অসম্ভব মশায় ঘুমোতে পারেন নি। খাওয়া-দাওয়া প্রায় জোটে নি বললেই চলে-চা একদমই না। অথচ দিনে ১৫/২০ কাপ চা খাওয়ার অভ্যেস তাঁর।
প্রথমেই ওঁকে দোতলায় রুমীদের ঘরে নিয়ে গেলাম। নিচে রাখতে সাহস পেলাম না-যদি হঠাৎ ‘কেউ’ এসে পড়ে। ওঁকে গোসল করে কাপড় বদলাতে বলে নিচে এলাম খাবারের ব্যবস্থা করতে। খাওয়ার পর এককাপ চা ওঁর হাতে দিয়ে শরীফ ও আমি ওঁর সামনেই আলোচনা করলাম-এ পাড়ার যা অবস্থা, ওঁকে এ বাড়িতে রাখা নিরাপদ হবে না। ‘কেউ’ এসে ওঁকে দেখে চিনে ফেললেই বিপদ। ধানমণ্ডি ছয় নম্বর রোডে মা ও লালু থাকেন, সেখানে তিনতলার রুমটিতে উনি সবচেয়ে নিরাপদে থাকবেন। কাকপক্ষীও টের পাবে না, কারণ মা’র কাজের লোকজন নেই। বদিউজ্জামানরা নিচতলায় থাকে বটে, কিন্তু তারা এমনভাবে দরজা জানালা সেঁটে নিঃশব্দে বাসার ভেতর থাকে যে, বাইরে থেকে কারো বোঝার সাধ্যি নেই-ও বাসার ভেতর অতগুলো লোক থাকে। বদির পরিবার, তার শ্বশুরের পরিবার, কে.জি. মোস্তফার পরিবার।
সাড়ে তিনটের সময় ওঁকে নিয়ে মায়ের বাসায় গেলাম। গাড়িটা একেবারে বাড়ির সামনে নিলাম না। কি জানি, বদিরা কেঊ হঠাৎ যদি কোনো কাজের দরজা খুলে বেরিয়ে আসে! আমি প্রথমে বাড়ির সামনে গিয়ে দেখে নিলাম একতলার সব দরজা- জানালা বন্ধ আছে কিনা। তখন মার কলিং বেল টিপলাম। লালু এসে দরজা খোলার পর আমার ইশারা পেয়ে শরীফ নিয়োগী দাদাকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকে গেল। আব্বাজানের পুরনো বন্ধু অজিত নিয়োগী-মা ও লালু খুশি মনেই ওঁকে রাখলেন।
ওখান থেকে গেলাম ভুতের গলিতে, ভাস্তে কলিম, আর চাচাত দেবর নজলু ও হুদাদের বাসায়। ওরা কে কেমন আছে খোঁজখবর নেয়ার জন্য।
আজ সকালে এক পাতার মর্নিং নিউজ বেরিয়েছে। উল্টো পাতাটি সাদাই রয়ে গেছে। বিদেশের দু’একটা খবর ছাড়া পূর্ব বাংলার খবর মাত্র দুটি: ‘মুজিব ওয়ান্টেড সেপারেশান রাইট ফ্রম সিক্সটি সিক্স।’ ১৯৬৬ সাল থেকেই মুজিব বিচ্ছিন্নতা চেয়ে আসছেন। এবং ‘পাকিস্তান সেভড, সেইজ ভুট্টো।’ ভুট্টো বলেছেন: পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে।
- শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বই থেকে
Post a Comment Blogger Facebook
Click to see the code!
To insert emoticon you must added at least one space before the code.