image

image
 

A+ A-
Voice of 71 Voice of 71 Author
Title: একাত্তরের দিনগুলি: ২২ মার্চ, ১৯৭১
Author: Voice of 71
Rating 5 of 5 Des:
২২ মার্চ, ১৯৭১, সোমবার ছুটির দিন হওয়া সত্ত্বেও গতকাল একমুহুর্ত বিশ্রাম পায় নি বাড়ির কেউ। সারাদিনে এ্যা-তো মেহমান এসেছিল যে চা-নাশত...
২২ মার্চ, ১৯৭১, সোমবার

ছুটির দিন হওয়া সত্ত্বেও গতকাল একমুহুর্ত বিশ্রাম পায় নি বাড়ির কেউ। সারাদিনে এ্যা-তো মেহমান এসেছিল যে চা-নাশতা দিতে দিতে সুবহান, বারেক, কাসেম সবাই হয়রান হয়ে গিয়েছিল। আমিও হয়েছিলাম, কিন্তু দেশব্যাপী দ্রুত প্রবহমান ঘটনাবলির উত্তেজনায় অন্য সবার সঙ্গে আমিও এত টগবগ করেছি যে টের পাই নি কোথা দিয়ে সময় কেটে গেছে।

সকাল ন’টায় এলেন আমার বড় ননদ লিলিবু ও নন্দাই একরাম ভাই। প্রতি রবিবারে এঁরা নিয়মিত আসে বাবার সঙ্গে খানিকক্ষণ কাটাবার জন্য।

রুমী, জামী আজ সাড়ে আটটাতেই নাশতা খাওয়া শেষ করে কোথায় যেন গেছে। আমি আর শরীফ তখনো খাবার টেবিলে, খবর কাগজ নিয়ে। একরাম ভাই লিলিবুকে বললেন, “তুমি উপরে যাও বুড়ার কাছে। আমি এইখানে একটু কথা কয়ে যাই।” লিলিবু সিঁড়ি দিয়ে উপরে চলে গেলেন। একরাম ভাই এসে একটা চেয়ারে বসলেন। আমি জিজ্ঞাসু চোখে ওঁর দিকে চেয়ে রইলাম।

এর কারণ আছে। রুমীর মতিগতি দেখে শঙ্কিত হয়ে সপ্তাহখানেক আগে একরাম ভাইকে বলেছিলাম, “আপনি রুমীকে ডেকে একটু কথাবার্তা বলুনতো! ও কি ভাবে, কি চায়!” একরাম ভাই রুমীকে তাঁর বাসায় ডাকিয়ে দু’দিন কথাবার্তা বলেছেন। আমাকে মুখে কোনো প্রশ্ন করতে হল না, একরাম ভাই নিজেই বলার জন্য এখানে এসে বসেছেন, বুঝতে পারছি।

উনি বললেন, “রুমীর সঙ্গে আলাপ করে আমি তো হতবাক। এইটুকু ছেলে এই বয়সে এত পড়াশোনা করে ফেলেছে? আগে তো ভাবতাম বড়লোকের ছাওয়াল হুশ হুশ করে গাড়ি হাঁকিয়ে বেড়ায়-চোঙ্গা প্যান্ট পরে, গ্যাটম্যাট করে ইংরেজি কয়- আলালের ঘরের দুলাল। কিন্তু এখন দেখতিছি এ বড় সাংঘাতিক চিজ। মার্কস- এঙ্গেলস একবারে গুলে খেয়েছে। মাও সে তুং য়ের মিলিটারি রাইটিংস সব পড়ে হজম করে নিয়েছে। এই বয়সে এমন মাথা, এমন ক্লিয়ার কনসেপশন, বাউরে, আমি তো আর দেখি নাই।”

একরাম ভাইয়ের কথার ধরনই এই রকম। বকুনির সময় যেমন ঠেষে বকে দেন, প্রসংসার সময়ও তেমনি অঢেল প্রশংসা করেন। কোথাও কোনো কিপটেমি নেই।

আমি ছলছল চোখে বললাম, “এত যে ভালো বলছেন, এত মাথা নিয়ে এ ছেলে বাঁচলে হয়। কি যে মাতামাতি করে বেড়াচ্ছে! আপনি ওকে আরেকটু বোঝাবেন। এখনো তো বলতে গেলে শিশু ও, কেবল আইএসসি পাস করেছে- ছাত্রজীবন সবটাই পড়ে রয়েছে।”

একরাম ভাই “হুম” বলে গম্ভীর হয়ে কি যেন ভাবতে লাগলেন। একটু পরে বললেন, “দেশের অবস্হা তো ভালো দেখছি না। ইয়াহিয়া-মুজিবের বৈঠকের কি পরিণতি হবে, তাও তো বোঝা যাচ্ছে না। গতকাল আবার ভুট্টো এসেছে বারোজন উপদেষ্টা নিয়ে।”

“ওরা খুব ভয় পেয়েছে মনে হচ্ছে। কাগজে দেখলাম ভাষণ কড়া মিলিটারি পাহারায় প্লেন থেকে নেমেছে। হোটেল ইন্টারকনে আছে-সেখানে নাকি ভয়ানক কড়াকড়ি সিকিউরিটি।”

শরীফ বলল, “কালকে এসেই ভুট্টো ইয়াহিয়ার সঙ্গে দু’ঘন্টা মিটিং করেছে। অথচ ইয়াহিয়া যেদিন এল, সেদিন সারাদিন মুজিবের খোঁজই করল না। পরদিন দুপুরেরও পরে আড়াইটের দিকে দু’জনের বৈঠক হয়েছে।”

একরাম ভাই বললেন, “কেমন যেন একটা ষড়যন্ত্র ষড়যন্ত্র ভাব মনে হচ্ছে।”

কলিং বেল বেজে উঠল। কাসেম ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই ঘরে ঢুকলেন মোর্তুজা ভাই, মোস্তফা ভাই।

আমরা খাবার টেবিল থেকে উঠে বসার ঘরের দিকে গেলাম। বসার পর কুশল বিনিময়ও হয় না-সরাসরি প্রশ্ন সবার মুখে: কি মনে হচ্ছে দেশের অবস্থা?

শরীফ বলল, “আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে জ্বলন্ত বালিতে খৈ ফুটছে। ইয়াহিয়া, মুজিব, ভুট্টো বৈঠক করছে, দেশের সর্বশ্রেণীর লোক ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সি.এস.পি, ই.পি.সি.এস-সব্বাই নিজ নিজ পেশার ব্যানারে মিটিং করছে, মিছিল করছে। জয়দেবপুরে মিলিটারি, পাবলিকের ওপর গুলি করছে, টঙ্গী, নারায়নগঞ্জে তার প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। মিরপুরে, চট্টগ্রামে, পার্বতীপুর-সৈয়দপুরে বাঙালি বিহারী খুনোখুনি রক্তারক্তি হচ্ছে-সেনাবাহিনী বিহারিদের উষ্কানি আর সাপোর্ট দিচ্ছে।”

মোস্তফা ভাই বললেন, “আগামীকাল কি কোন রকম গোলমাল হবে বলে মনে হয়?”

শরীফ বলল, “মনে হয় না। তবে জয়দেবপুরের ঘটনায় লোকজন নতুন করে খেপেছে। মিরপুরেও পরিস্থিতি খুব গরম। এদিকে বাঙালিরাও বেশ জঙ্গী হয়ে রয়েছে। গত পরশু বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে ছাত্র ইউনিয়ন গণবাহিনীর কি সব কুচকাওয়াজ হয়েছে। অনুষ্ঠানের শেষে প্রায় পাঁচশো ছেলেমেয়ে রাস্তায় রাস্তায় মার্চপাস্ট করেছ। তা দেখার জন্য রাস্তার দু-ধারে হাজার হাজার লোক দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়েছে। কাজেই আগামীকাল শেষ পর্যন্ত কি হবে, কিছুই বলা যায় না। আগামীকালও তো আবার পল্টন ময়দানে জয়বাংলা গণবাহিনীর কুচকাওয়াজ আছে।”

আগামীকাল ২৩ মার্চ প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। এর জন্য সারাদেশে প্রচন্ড আলোড়ন ও উত্তেজনা। জনমনে বিপুল সাড়া ও উদ্দীপনা। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ প্রতিরোধ দিবস পালনের আহ্বান এবং কর্মসূচী দিয়েছে ২০ মার্চেই। ভাসানী ন্যাপ এই তারিখে স্বাধীন পূর্ব বাংলা দিবস পালনের আহ্বান জানিয়ে রোজই ঢাকার রাস্তার মোড়ে মোড়ে পথসভা করছে। অন্যান্য ছাত্রদল ও শ্রমিক দল এবং বিভিন্ন দলের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীও এই দিনকে সামনে রেখে মহা তোড়জোড় শুরু করেছে।

মোর্তজা ভাই বললেন, “ভাবী, আজকের কাগজে স্বাধীন বাংলা পতাকার ছবি বেরিয়েছে, দেখেছেন?”

আমি বললাম, “দেখব না কেন-ইনফ্যাক্ট, পতাকা আমি কিনেও এনেছি একগাদা।”

“একগাদা কেন?”

আমি হেসে বললাম, “যারা শেষ মুহূর্তে কিনতে পাবে না-তাদের বিলোব বলে?”

“তাই নাকি? আনুন তো একটা, দেখি।”

আমি দোতলায় উঠে কয়েকটা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে এলাম। ওঁরা সবাই একেকটা হাতে নিহে খুলে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলেন। আমি বললাম, “আপনারা নিয়ে যান একটা করে-কাল ওড়াবেন।”

ওরা খুশি হয়ে একটা করে নিয়ে গেলেন।

বারোটায় এলেন শরীফের বন্ধু ও সহকর্মী ইঞ্জিনিয়ার বাঁকা ও মঞ্জুর। বাঁকার ভালো নাম এস.আর. খান, কিন্তু বাঁকা নামের বিপুল বিস্তারের নিচে আসল নাম চাপা পড়ে গেছে। ওঁদেরও একটা করে পতাকা দিলাম। ওঁরা যেতে না যেতেই এলেন ফকির। বিকেলে মিনিভাইরা। এমনি করে রাত দশটা পর্যন্ত বহুজন। দুপুরে খাওয়ার সময় কিটি বলল, “আম্মা, আমাকে একটা পতাকা দেবে?”

“নিশ্চয়ই।”

আজ কিটি এখান থেকে চলে যাবে। গুলশানে এক আমেরিকান পরিবারে থাকবে আপাতত। গণআন্দোলন, মিটিং, মিছিল ইত্যাদির কারণে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি জনসাধারণের ক্রমবর্ধমান বিতৃষ্ণা ও বিক্ষোভের কারণে কিটির এখন কোন বাঙালির বাড়িতে না থাকাই বাঞ্ছনীয়। মাত্র দু’দিন আগে ধানমন্ডিতে মার্কিন কনসাল জেনারেলের বাড়িতে বোমা ছোড়া হয়েছে, যদিও কেউ হতাহত হয় নি। কিটির নিরাপত্তার কারণেই কিটিকে এখান থেকে সরানো দরকার। বিকেলে মিঃ চাইল্ডার এলেন কিটিকে নিতে। খুব ভারি মন নিয়ে কিটি বিদায় নিল। আমাদেরও বেশ মন থারাপ হল।

আরো একটা কারণে আজ মন খারাপ। সুবহান আজ চাকরি ছেড়ে চলে গেল। ওর নাকি আর রান্নাবান্নার কাজ ভালো লাগে না। ও এখন আন্দোলন করবে। তা না হয় করবে। কিন্তু আমাদের বাসার রান্নাবান্নার কি হবে?

- শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বই থেকে

About Author

Advertisement

Post a Comment Blogger

 
Top