![]() |
আমি কাঁপতে কাঁপতে নিজের ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। কি করি? কি বলি? সারা দেশ স্বাধীনতার দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছে; ঢাকায়, রাজশাহীতে, চট্টগ্রামে সবখানে এই দাবি তুলে শান্তিপ্রিয় বাঙালিরা আজ মরিয়া হয়ে লাঠি, সড়কি যা পাচ্ছে, তাই হাতে নিয়ে ছুটে যাচ্ছে গুলির সামনে। ঘরে ঘরে নিজের হাতে বোমা পটকা, মলোটভ ককটেল বানিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে প্রতিপক্ষের ওপর। এই রকম সময়ে আমার ছেলেকে আমি কি চাইব ঘরে আটকে রাখতে? আমি কি চাইব সে শুধু বন্ধুবান্ধব নিয়ে জাঁকিয়ে বসে, স্বাধীনতার দাবি-দাওয়ার প্রশ্নে তর্ক-বিতর্ক, চুলচেরা বিশ্লেষণ নিয়ে মত্ত থাকুক?
রুমী কখন বাড়ি ফিরেছে, টের পাই নি। ফিরেই নিশ্চয় জামীর কাছে সব শুনেছে। আমার ঘরে এসে সুইচ টিপে বাতি জ্বেলে খুব শান্তস্বরে বলল, “আম্মা, তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।”
আমি উঠে বসে বললাম, “তোমার সঙ্গে আমারও কিছু কথা আছে।”
রুমী খাটে এসে বসল আমার সামনে। আমি বললাম, “ছোটবেলা থেকে তোমাকে এই শিক্ষা দিয়েছি-এমন কাজ কখনো করবে না যা আমাদের কাছে লুকোতে হবে। শিখিয়েছি-যদি কখনো কোন বিষয়ে আমাদের মতের সঙ্গে তোমার মত না মেলে তাহলে আগে আমাদেরকে বুঝিয়ে তোমার মতে ফেরাবে, তারপর সেই কাজটা করবে।”
রুমী তার স্বভাবসিদ্ধ মৃদুগলাতে বলল, “আমি লুকিয়ে কিছু করছিনা আম্মা। আব্বু সব জানে, আব্বুই আমাকে বেবী চাচার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছ। তোমাকে তো আগেই বলেছি, আমি বেবী চাচার সঙ্গে কাজ করি। তবে কি কাজ করি, বিস্তারিত বলা নিষেধ আছে।”
আমি রুমীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললাম, “আমার খুব ভয় করছে রুমী।”
রুমী একটুক্ষণ চুপ করে থেকে গম্ভীর গলায় বলল, “ভয় করার স্টেজে আমরা আর নেই মা। আমাদের আর পেছনে হটার কোনো উপায় নেই।”
“তুই যা-ই বলিস রুমী, দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। আজই তো কেবল মুজিব- ইয়াহিয়া বেঠক শুরু হল। ফয়সালা একটা নিশ্চয় হবে।”
রুমীর মুখে কি রকম একটা হাসি ফুটে উঠল, কি যেন বলতে গেল সে, তার আগেই সিড়ির মুখ থেকে জামী চেঁচিয়ে ডাকল, “মা ভাইয়া, শিগগির এস, খবর শুরু হয়ে গেছে। টিভিতে শেখ মুজিবকে দেখাচ্ছে।”
হুড়মুড়িয়ে উঠে নিচে ছুটলাম। খবর খানিকটা হয়ে গেছে। শেখ মুজিবের গাড়িটা প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বেরিয়ে আসছে। সাদা ধবধবে গাড়িতে পতপত করে উড়ছে কালো পতাকা। দেখে প্রাণটা যেন জুড়িয়ে গেল। প্রতিবাদের কালো পতাকা উচিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনায় গিয়েছেন শেখ মুজিব। এর আগে কোনদিনও পাকিস্তান সরকার বাঙালির প্রতিবাদের এই কালো পতাকা স্বীকার করে নেয় নি। এবার সেটাও সম্ভব হয়েছে।
- শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বই থেকে
Post a Comment Blogger Facebook
Click to see the code!
To insert emoticon you must added at least one space before the code.