image

image
 

A+ A-
Voice of 71 Voice of 71 Author
Title: একাত্তরের দিনগুলি: ২৬ মার্চ, ১৯৭১
Author: Voice of 71
Rating 5 of 5 Des:
২৬ মার্চ, ১৯৭১, শুক্রবার ছ’টার দিকে হঠাৎ কানে এল খুব কাঁপা কাঁপা অস্পষ্ট গলার ডাক-“আপা, আপা”। চমকে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি ...

২৬ মার্চ, ১৯৭১, শুক্রবার

ছ’টার দিকে হঠাৎ কানে এল খুব কাঁপা কাঁপা অস্পষ্ট গলার ডাক-“আপা, আপা”। চমকে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি বাগানের একটা জবা গাছের নিচে কুঁকড়ি মেরে বসে আছেন কামাল আতাউর রহমান। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অনার্স পরীক্ষার্থী, মোহসীন হলে থাকে। ছুটে নিচে নেমে এলাম। দরজা খুলে উদভ্রান্ত, প্রায় অচেতন কামালকে ধরে তুলে ঘরে নিয়ে এল রুমী-জামী। ও সারারাত হলের একতলার একটা বাথরুমে আরো দশ-বারোটা ছেলের সঙ্গে লুকিয়ে ছিল। ট্রেসার, হাউইয়ের দরুন রাতে বেরোতে সাহস পায় নি। এখন সকালের আলো ফুটতে ট্রেসার হাউই বন্ধ হয়েছে। ওরা বাথরুম থেকে বেরিয়ে মাঠ, খানা-খোন্দল, রেললাইন পুরো এলাকাটা চার হাতপায়ে হামাগুড়ি দিয়ে পালিয়ে এসেছে।

কামালকে সুস্থ করে রেডিও খুললাম। সুরা বাকারার পর খালি একটা বাজনাই বারেবারে বাজছে-আমার প্রিয় একটা গান, “কোকিল ডাকা, পলাশ-ঢাকা আমার এদেশ ভাইরে”- এই গানের সুরে তৈরি যন্ত্রসঙ্গীত। সাতটার সময় পাশের ডাঃ এ.কে.খানের বাড়ি গেলাম ফোন করতে। ওঁদের ফোনও ডেড। ক্রমে ক্রমে আমাদের রাস্তার আরো সব বাড়ির লোকজন সাবধানে উকিঝুঁকি দিতে লাগল। সবারই মুখে আতঙ্ক। সবাই সারারাত জেগেছে। কেউ কিছু বুঝতে পারছি না -কি হচ্ছে। সব বাড়ির ফোনই ডেড।

বাড়ি চলে এসে খাবার টেবিলে বসে রইলাম, রেডিও সামনে নিয়ে। জামীকে বললাম, “বারেককে সঙ্গে নিয়ে দাদাকে ওঠাও, মুখ ধোয়াও, নাশতা খাওয়াও।”

কাসেম যন্ত্রচালিতের মত টেবিলে চা-নাশতা দিয়ে গেল। নাশতা ফেলে সবাই চায়ের কাপ টেনে নিলাম।

সাড়ে ন’টার সময় হঠাৎ যন্ত্রসঙ্গীত বন্ধ হল। শোনা গেল একটা রুক্ষ অবাঙালি কণ্ঠস্বর। প্রথমে উর্দু এবং পরে ইংরেজিতে বলল। পরবর্তী আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত কারফিউ বলবৎ থাকবে। কারফিউ ভঙ্গ করে কেউ বাইরে বেরোলে কি শাস্তি, তাও বলল। আর বলল, ‘মার্শাল ল’ জারি করা হয়েছে। তার নিয়ম কানুনগুলো এক এক করে বলে যেতে লাগল। বেতার-ঘোষকের উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি শুনে মনে হল লোকটা একটা সেপাই-টেপাই কিছু হবে। সামরিক সরকার আর কাউকে হাতের কাছে না পেয়ে ওকে দিয়ে ঘোষণাগুলো করাচ্ছে।

অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ। যা তান্ডব হচ্ছে চারদিকে, কারফিউ না দিলেও বাইরে বের হয় কার সাধ্যি! গোলাগুলির শব্দ থামেই না। মাঝে-মাঝে কমে শুধু। আগুনের স্তম্ভ দেখার জন্য এখন আর ছাদে উঠতে হয় না। দোতলার জানালা দিয়েই বেশ দেখা যায়। কালো ধোঁয়ায় রৌদ্রকরোজ্জ্বল নীল আকাশের অনেকখানিই আচ্ছন্ন।

মিকির কান্নায় অস্থির হয়ে উঠেছিল সবাই। ওর অ্যালসেসিয়ান চরিত্রই বদলে গেছে যেন। অবিশ্রান্ত গোলাগুলির শব্দে এই জাতের সাহসী কুকুর যে এরকম কাহিল ও উদভ্রান্ত হয়ে পড়বে, তা কে ভেবেছিল? ওকে কিছু খাওয়ানো যাচ্ছে না। আমরা সবাই পালা করে ওকে কাছে টেনে ওর গলা জড়িয়ে ধরে সুস্থির রাখার চেষ্টা করছি, কিন্তু কোনো ফল হচ্ছে না।

বাবাকে নিয়েও হয়েছে মুশকিল। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কেন, কি দোষে নিজের দেশের লোকজনকে মারছে, তা ওঁকে বোঝাতে গিয়ে আমাদের সবার মুখ দিয়ে ফেনা উঠে গেল। আমার ভয় হচ্ছে ওঁর আবার ব্লাড প্রেসার না বেড়ে যায়।

টেলিফোন বিকল, রেডিও পঙ্গু, বাইরে কারফিউ-গোলাগুলির শব্দের চোটে প্রাণ অস্থির, বাইরে কি হচ্ছে কিছুই জানবার উপায় নেই। এ ক্ষেত্রে আমাদের একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী স্কুপ সংবাদদাতা কামাল আতাউর রহমান। সকাল থেকে আমার বারবার একই প্রশ্নে একই কথা বলতে বলতে কামালও যেন হাঁপিয়ে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে।

“আচ্ছা কামাল, রাত বারোটার সময় তুমি কি করছিলে?”

“আমি? আমি একটা প্রবন্ধ লিখছিলাম-‘বাংলা সাহিত্যে দেশপ্রেম।’ ২৭ তারিখে রেডিও প্রোগ্রামে পড়বার জন্য।”

“কখন গোলাগুলির শব্দ শুনলে?”

“ঐ বারোটার দিকেই। হয়তো দু’চার মিনিট পরে। আমার এক বন্ধু এসে বলল “তুই এখনো হলে রয়েছিস? জানিস না শহরের অবস্থা ভয়ানক খারাপ? আর্মি আসছে ক্যাম্পাস অ্যাটাক করতে? আমি বাড়ি চললাম। তুইও বেরিয়ে যা।” কিন্তু আমরা কেউই আর বেরোবার চান্স পেলাম না। তখুনিই কানে এল ভয়ানক গোলাগুলির শব্দ। একটু পরেই চারদিক আলো হয়ে উঠতে লাগল। একবার করে আলো জ্বলে আর গুলিগোলা ছোটে। আমার ঘর ছিল পাঁচতলায়, তাড়াতাড়ি একতলায় নেমে এলাম। হাজী মোহসীন হলের দক্ষিণে ইকবাল হল-তার ওপাশে এস.এম. হল। মনে হল ভারি ভারি কামানের গোলা দিয়ে মিলিটারিরা ইকবাল হল উড়িয়ে দিচ্ছে। আমাদের হলের দিকে গুলি ছুটে আসছিল।”

“তোমাদের হল আক্রমণ করে নি ?”

“না, আমরা প্রতি মুহূর্তে ভয় করছিলাম, এই বুঝি হাজী মোহসীনেও এল। কিন্তু ওরা আসে নি।”

“আর কোথায় কোথায় ওরা অ্যাটাক করেছে বলে মনে হয়?”

“ঠিক বলতে পারবো না। মনে হয় এস.এম হল, জগন্নাথ হল, শহীদ মিনার। ঐদিক থেকেই শব্দ বেশি পাওয়া গেছে।”

“তোমার কি মনে হয়? ইকবাল হল, এস.এম. হল সব একেবারে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে? সব ছেলেদের মেরে ফেলেছে?”

“কি করে বলব? আমরা তো একতলার বাথরুমে লুকিয়ে ছিলাম। শব্দ শুনে মনে হয়েছে ভারি ভারি গোলা। মোহসীন হলের মাথার ওপর দিয়েও গুলি ছুটে আসছিল। জানালার কাচ ভাঙ্গার শব্দ পেয়েছি সারারাতই।”

এক পর্যায়ে কামাল বাথরুমে গেলে রুমী আমাকে বলল, “ওকে আর জিগ্যেস কোরো না তো আম্মা। দেখছ না ওর কষ্ট হচ্ছে।”

“তাতো দেখছি। কিন্তু কি যে হচ্ছে চারদিকে, তাই বুঝবার জন্য-”

বুঝবার আর কি আছে আম্মা? যা ঘটবার কথা ছিল, তাইতো ঘটেছে।”

চুপ করে রুমীর দিকে তাকিয়ে রইলাম। রুমী চোখ ফিরিয়ে নিল। কাল রাত থেকে ও বিশেষ কথাবার্তা বলছে না। থম ধরে আছে। আমি ভাবছি: রুমীর কথাই ঠিক হল।

রুমী নিশ্চয় ভাবছে, কেমন জব্দ আম্মা? আহাম্মকের স্বর্গ থেকে ছিটকে পড়েছ তো।

কাঁহাতক ঘরে বসে থাকা যায়। এক সময় উঠে সদর দরজা খুলে গাড়ি-বারান্দায় গেলাম। আমাদের বাসার সামনের এই গলিটা কানা। এলিফ্যান্ট রড থেকে নেমে এসে আমাদের বাসা পেরিয়েই বন্ধ হয়ে গেছে। ওই বন্ধ জায়গাটার ওপরে ডাঃ এ. কে. খানের বাড়ি। বন্ধ গলি হওয়ার মন্ত সুবিধে-এখানে বাইরের লোকের চলাচল বা ভিড় নেই। এ রাস্তার বাড়িগুলোর বাসিন্দারা-আমরা-অনেক সময় গলির ওপর দাঁড়িয়ে গল্প করি। গলিটা যেন আমাদের সকলের এজমালি উঠান। ১৯৫৯ সালে এখানে বাড়ি করে উঠে আসার পর থেকে এদেশে যতবার কারফিউ পড়েছে, আমরা বাড়ির সামনের এই গলিতে দাঁড়িয়ে বহু সময় গল্পগুজব করে কাটিয়েছি। আজ কিন্তু গাড়ি-বারান্দা পেরিয়ে গলিতে পা রাখতে সাহস হল না। গোলাগুলির শব্দে এখনো আকাশ ফাটছে। মাঝে-মাঝে কুকুরের চিৎকার কানে ভেসে আসছে। সেই সঙ্গে মনে হচ্ছে যেন মানুষেরও চিৎকার। খুব অস্পষ্ট। নাকি আমার ভুল? এত বিরামহীন গোলাগুলির পরও কোন মানুষ কি বেঁচে আছে চিৎকার দেয়ার জন্য? আশ্চর্যের ব্যাপার, একটা কাক, চিল কি কোন পাখির ডাক নেই।

বাউন্ডারি ওয়ালের এপাশে শরীর রেখে শুধু  মুখটা  বাড়ালাম গেটের বাইরে, বাঁদিকে তাকালাম মেইন রোডের পানে। জনশূন্য রাস্তা। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে হয়তো সেনাভর্তি জীপ বা ট্রাক চলে যেতে দেখব। কিন্তু দরকার নেই তা আমাদের দেখে। আমার মুখোমুখি বাসাটা হোসেন সাহেবের। উনি খোলা দরজার ঠিক ভেতরেই চেয়ারে একবার বসছেন, আবার উঠে বারান্দায় আসছেন, আবার তাড়াতাড়ি ভেতরে চলে যাচ্ছেন। বাঁ পাশে ডাঃ রশীদের বাড়ি। উনিও অস্থিরভাবে ঘর-বারান্দা করছেন-এখান খেকে দেখা যাচ্ছে। ফিরে, ঘুরে  ঢোকার মুখে গাড়ির দিকে নজর পড়তেই আঁতকে উঠলাম। কাচ জুড়ে জ্বলজ্বল করছে সেই স্টিকার- ‘একেকটি বাংলা অক্ষর একেকটি বাঙালির জীবন।’ দ্রুত ঘরে ঢুকে রুমীকে ডাকলাম, “রুমী, রুমী, শিগগির গাড়ির স্টিকার উঠিয়ে ফেল।”

ঠিক সন্ধ্যার মুখে কারেন্ট চলে গেল। বাঃ বেশ। এবার ষোলকলা পূর্ণ হল। গোলাগুলির শব্দ একটু কমেছে মনে হল। মিকিও যেন একটু ধাতস্থ হয়েছে। ঘর থেকে বেরিয়ে উঠানের এক পাশের ঢাকা জায়গায় তার নিজস্ব জলচৌকিটায় গিয়ে বসেছে। সামান্য কিছু খেয়েছেও।

আমি চার-পাঁচটা মোমবাতি বের করে একতলা দোতলায় তিন-চার জায়গায় বসিয়ে দিলাম। আজ সারাদিন বারেক, কাসেম আমাদের চারপাশেই ঘোরাঘুরি করেছে। সন্ধ্যের সময় বারেক-কাসেমকে বললাম, “তোরা এখুনি তোদের বিছানাপত্র এনে গেস্টরুমে রাখ। অন্ধকারে উঠোনে বেরিয়ে কাজ নেই।” ওরা কৃতজ্ঞমুখে দৌড়োদৌড়ি করে বিছানাপত্র এনে রেখে আমাদের কাছাকাছি মাটিতে এসে বসল। মনে হল আমরা সবাই নূহের নৌকায় বসে আছি। 

বাড়িতে একটা ভালো রেডিও নেই। এবার ২০ ফেব্রুয়ারির শেষ রাতে আমরা বাড়িসুদ্ধ সবাই বাইরে ছিলাম-সেই ফাঁকে বাসায় চোর ঢুকে অনেক জিনিসের সঙ্গে আমাদের ভালো রেডিওটাও নিয়ে যায়। এতোদিন কিটির দামী রেডিওটাই ব্যবহার করতাম, ও গুলশানে চলে যাওয়াতে রুমী-জামীর নড়বড়ে টু-ইন-ওয়ানটা দিয়ে কোন মতে কাজ চালাই। কিন্তু এটাতে বিবিসি’র বাংলা সার্ভিসটা ধরা যায় না। আকাশবাণীও ঢাকার রাস্তায় আর্মি নেমেছে, এর বেশি কিছু বলে নি। টিভি বন্ধ। কি আর করি। তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়া সেরে কাজের লোকদের রেহাই দিলাম। সবাই সিড়ি দিয়ে উপরে উঠছি, হঠাৎ রুমী থমকে দাঁড়াল, “মিকির কোন সাড়াশব্দ নেই যে? একেবারে নর্মাল হয়ে গেছে মনে হচ্ছে।”

জামী বলল, “ওকে ভেতর আনা হয় নি।”

আবার আমরা সবাই নিচে নামলাম। দরজা খুলে উঠানে নেমে মিকির জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম। মোমবাটির কাঁপা কাঁপা আলোয় দেখলাম মিকি মরে পড়ে আছে।

- শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বই থেকে

About Author

Advertisement

Post a Comment Blogger

 
Top