সকালে
চায়ের টেবিলে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে খবর কাগজের ওপর। পরিস্থিতি ও চাহিদার
গুরুত্ব বুঝে মাসের ২-৩ তারিখ থেকেই তিন চারটে কাগজ রাখছি-যাতে বাড়ির
সকলেই একই সঙ্গে সুখী থাকতে পারে।
সবার নজর মুজিব-ইয়াহিয়ার বৈঠকের খবরটার দিকে। খবর অবশ্য বিশেষ কিছু নেই। তাঁরা রুদ্ধদ্বার কক্ষে আড়াই ঘন্টাকাল আলোচনা করেছেন। বাইরে বেরিয়ে এসে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শেখ শুধু বলেছেন, তাঁরা দেশের রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা কেবল শুরু করেছেন; আলোচনা চলতে থাকবে, কারণ সমস্যা যা, দু’তিন মিনিটে তার সমাধান সম্ভব নয়।
আজ বুধবার সকাল দশটায় আবার বসছেন তাঁরা।
রুমী হঠাৎ মুখ তুলে বলল, “আম্মা, এই খবরটা দেখেছ?”
“কোনটা?”
রুমি হাতের দৈনিক আজাদ পত্রিকাটা এগিয়ে দিল আমার দিকে। পড়লাম খবরটা। হেডিং হচ্ছে:
জানেন কি?
রাজধানী ঢাকায় বর্তমানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কতজন পদস্থ ব্যক্তি অবস্থান করিতেছেন?
খবরটা সংক্ষেপে হল: প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ, প্রিন্সিপ্যাল স্টাফ অফিসার লেঃ জেনারেল পীরজাদা, মেজর জেনারেল ওমর এবং আরো ছয়জন ব্রিগেডিয়ার ঢাকা এসেছেন। তবে এ সম্বন্ধে কোন সরকারি সমর্থন পাওয়া যায় নি। কেবল প্রেসিডেন্টের জনসংযোগ অফিসার সাংবাদিকদের প্রশ্নের চাপে, পীরজাদা ও ওমরের ঢাকা আসার কথা স্বীকার করেছেন।
রুমী বলল, “বুঝলে আম্মা, ব্যাপারটা আমার কাছে খুব সুবিধের ঠেকছে না। বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা করতে এত সেনাপতি, সামন্ত সঙ্গে নিয়ে আসার মানেটা কি?”
আমার বুকটা হঠাৎ কেঁপে উঠল, তবু একটু ধমকের সুরে বললাম,“তোরা খালি গুজবের আগে ছুটিস। এ খবরের কোনো ভিত্তি নেই তো। লোকে আগাম আশঙ্কা করে বলছে এ কথা। আলোচনা তো কেবল একদিন হয়েছে, দু’চারটে দিন ধৈর্য ধরে দেখ না-নিশ্চয় সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“ঐ আনন্দেই থাকো। তোমার কি রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি বলতে কিছু নেই আম্মা”- রুমীর কথায় বাধা পড়ল। কলিং বেল বেজে উঠেছে। জামী তড়াক করে উঠে দরজা খুলেই চেঁচিয়ে বলল, “মা, মা, নিয়োগী চাচা-”
আমিও চেঁচিয়ে উঠলাম, “আরে তাই নাকি? খুব ভালো দিনে এসেছেন তো। আপনাকে আমার খুব দরকার।”
অজিত নিয়োগী ঘরে ঢুকে হাসিমুখে বললেন, “সেইটে জেনেই তো কেমন এসে পড়েছি, দেখুন।”
শরীফ ও আমি উঠে বসার ঘরের দিকে গেলাম। রুমী, জামী নিয়োগী সাহেবকে আদাব দিয়ে দোতলায় উঠে গেল।
আমি বললাম, দাদা, আপনার সঙ্গে আজ আমার কিছু জরুরী কথাবার্তা আছে। বসতে হবে অনেকক্ষণ। আর ঠিক ঠিক জবাব দিতে হবে।”
নিয়োগী দাদা হাসতে হাসতে বললেন, “আরে বাপরে। কি এমন সাংঘাতিক কথা জিগ্যেস করবেন? একেবারে ঠিক ঠিক জবাব চাই?”
শরীফ খানিকক্ষণ কথা বলার পর উঠে দাঁড়াল, আমার অফিস আছে, চললাম। আপনারা সাংঘাতিক সওয়াল জবাব করতে থাকুন।”
শরীফ চলে যাবার পর আমি বললাম, আমি খুব স্পষ্ট কথায় দুটো প্রশ্ন করব। ঠিক ঠিক জবাব দেবেন কিন্তু দাদা।”
উনি হাসিমুখে বললেন, “বলুন, আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করব।”
আমি খানিকক্ষণ মাথা নিচু করে মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিলাম, তারপর স্পষ্ট করে কেটে কেটে বললাম, “এক নম্বর প্রশ্ন-দেশে রক্তস্রোত বয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে কি না। দুই নম্বর প্রশ্ন-আমার কপালে পুত্রশোক আছে কি না।”
প্রশ্ন শুনে নিয়োগী দাদা স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। আমি খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে বললাম, “কই জবাব দিচ্ছেন না?”
নিয়োগী দাদা একটু হাসলেন, অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন মনে হল। কেশে গলা পরিষ্কার করে বললেন, এসব বিষয়ে কি নিশ্চিত করে কিছু বলা যায়?”
আমি জোর দিয়ে বললাম, “কেন যাবে না? আপনি এত বড় অ্যাস্ট্রলজার কত বছর ধরে কত বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করে আসছেন, আপনি কি বলতে চান দেশের বিষয় নিয়ে কিছুই ভাবনাচিন্তা করেন নি?”
“করেছি বইকি। তবে-”
তবে-টবে নয়। কি চিন্তাভাবনা করেছেন, বলুন।”
“রক্তস্রোতের সম্ভাবনা খুবই ছিল। পাকিস্তান হল মকর রাশির অন্তর্গত দেশ। মকর রাশিতে এ সময়ে আছে রাহু ও শুক্র। আর পাশাপাশি দ্বাদশ ঘরে ধনুতে অবস্থান করছে মঙ্গল। রাহু মানে ধ্বংস আর শুক্রের জন্য আগুন আসে। দ্বাদশে মঙ্গল মানেও ধ্বংস। কিন্তু বৃহষ্পতি এ সময় বৃশ্চিকে একাদশ ঘরে আছে বলেই ভরসার কথা। অল্পের জন্য ভয়াবহ রক্তস্রোতের সম্ভাবনাটা এড়ানো গেছে।”
আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম, আর আমার দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব?”
নিয়োগী দাদা আবারো অস্বস্তিতে পড়েছেন, বোঝা গেল। বহুক্ষণ চুপ করে করে জানলার বাইরে তাকিয়ে রইলেন। অনেকক্ষণ পরে ধীরে ধীরে বললেন, “রুমীর মঙ্গল খুব প্রবল। জানেন তো মঙ্গল যুদ্ধের রাশি। ওকে একটু সাবধানে রাখবেন।”
আমি গোঁয়ারের মতো বললাম, “ওসব সাবধানে রাখার কথা বাদ দিন। আমার কপালে পুত্রশোক আছে কি না তাই বলুন। ওটা থাকলে লখিন্দরের লোহার ঘর বানিয়েও লাভ নেই।
অজিত নিয়োগী অনেকক্ষণ ধরে কি যেন ভাবলেন, তারপর মৃদুস্বরে বললেন, “না। আপনার কপালে পুত্রশোক নেই। তবু ওকে সাবধান রাখবেন।”
আমার বুক থেকে পাষাণ-ভার নেমে গেল। আমি জ্যোতিষশাস্ত্র, ভবিষ্যদ্বাণী- এসব কোনো কিছুতেই কোনোদিনও বিশ্বাস করি নি। অজিত নিয়োগীর সঙ্গে আমাদের পরিচয়ের সূত্র অদৃষ্ট গণনা বা ভবিষ্যদ্বাণীর নয়, সাহিত্যালোচনা ও সামাজিক মেলামেশার। এর মধ্যেই ওঁর কয়েকটা গল্পের বই বাজারে বেরিয়েছে। তবু দেশের এই রকম পরিস্থিতিতে রুমীর রহস্যময়, উদভ্রান্ত চালচলনে, মনের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের খুঁটিটা কখন কেমন করে যেন নড়বড়ে হয়ে গেছে। তাই অজিত নিয়োগীর ভবিষ্যদ্বাণীর ক্ষমতার ওপর এখন মনেপ্রাণে নির্ভর করতে চাইছি।
- শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বই থেকে
Post a Comment Blogger Facebook