১৫ মার্চ, ১৯৭১, সোমবার
খেতাব বর্জন শুরু হয়ে গেছে।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন তার ‘হেলালে ইমতিয়াজ’ খেতাব বর্জন করেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ মুনীর চৌধুরী ‘সিতারা-ই-ইমতিয়াজ’ খেতাব বর্জন করেছেন।
নাটোর
হতে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য ডা. শেখ মোবারক হোসেন ‘তমঘা-এ
পাকিস্তান’, ফরিদপুরের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য শেখ মোশারফ হোসেন ‘তঘমা-এ
কায়েদে আযম’ খেতাব বর্জন করেছেন।
দৈনিক পাকিস্তান সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন ও তাঁর ‘সিতারা-ই খিদমত’ এবং ‘সিতারা-ই ইমতিয়াজ’ খেতাব বর্জন করেছেন।
আরো কে কে যেন খেতাব বর্জন করেছেন, নামগুলো মনে করতে পারছি না।
সমস্ত
দেশ স্বাধীনতা আন্দোলনের জোয়ারে টালমাটাল। প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যাচ্ছে
সর্বত্র। ব্যাপার-স্যাপার দেখে বিদেশীরাও ভয় পেতে শুরু করেছে। পশ্চিম
জার্মানি আর যুক্তরাজ্য সরকার তাদের কিছু কিছু নাগরিককে বাংলাদেশ থেকে
সরিয়ে নিতে শুরু করেছে। রুমী জার্মান কালচারাল সেন্টারে জার্মান ভাষা শিখত। সেই সুবাদে তার এক জার্মান টিচারের বাড়িতে যাওয়া-আসা ছিল। সেই
ম্যাডামের কাছ থেকেই জানা গেল তাঁরা চলে যাচ্ছেন। যাওয়ার আগে ম্যাডাম
রুমীকে চা খেতে ডেকেছিলেন তাঁর বাড়িতে। রুমী ফিরে এসে বলল, “ওঁরা আপাতত
ব্যাঙ্ককে যাচ্ছেন। তারপর কি হবে, এখনো জানেন না।”
আমি বললাম, “তাহলে আমাদের গুলশানের বাড়ির ভাড়াটেরাও যাবে নিশ্চয়ই। '৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় তো সবাই ব্যাঙ্ককে চলে গিয়েছিল।”
আমাদের
ভাড়াটে একজন আমেরিকান। তাঁর বউকে ফোন করলাম। তিনি বললেন, “যুক্তরাষ্ট্র
সরকার এখনো তাদের নাগরিকদের সরাবার কথা চিন্তা করে নি। আমরা আপাতত কোথাও
যাচ্ছি না। ঢাকাতেই আছি। ও হ্যাঁ, জাতিসংঘের কর্মচারীদেরও কিন্তু এখনো
ঢাকা থেকে সরাবার কোন প্ল্যান হয় নি। সুতরাং নিশ্চিন্ত থাকতে পার।”
আমি
মনে মনে বললাম, আমাদের আর দুশ্চিন্তার কি আছে? আমরা তো মাটিতেই বসে আছি।
আছাড় খাবার ভয় আমাদের নেই। যত ভয় তোমাদেরই। '৬৫ সালের পাক- ভারত যুদ্ধের
সময় কিভাবে ব্যাঙ্কক পালিয়েছিলে, তা কি আর মনে নেই?
কিন্তু দেশের অবস্থা যে গুরুতর আকার ধারণ করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আকাশে আশঙ্কার কালোমেঘ ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে।
দেশের
ঘুর্ণিবিধ্বস্ত এলাকায় সাহায্য দেবার জন্য গম বোঝাই একটা মার্কিন জাহাজ
আসছিল, সেটাকে চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙ্গর করতে দেয়া হয় নি, ইসলামাবাদ থেকে
জরুরী নির্দেশ দিয়ে করাচি যেতে বলা হয়েছে এই নিয়ে দারুণ হৈচৈ এখানে।
ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এ বিষয়ে প্রকৃত তথ্য উদঘাটনের জন্য তদন্ত দাবি করে খবর
কাগজে বিবৃতি দিয়েছেন। সরকার কাগজে পাল্টা বিবৃতি দিয়েছে এই বলে যে আদৌ
কোনো গমবাহী জাহাজ চট্টগ্রামে আসার কথা ছিল না।
আজিম
ভাই কিছুতেই প্লেনের টিকিট পাচ্ছেন না। বেচারা লন্ডন থেকে দেশে বেড়াতে
এসেছিলেন মাত্র তিন সপ্তাহের ছুটি নিয়ে। প্লেনের টিকিট না পেয়ে ছুটি এখন
চার সপ্তাহ পেরিয়ে যাচ্ছে। দুটো টেলিগ্রাম করেছেন, তারপর ট্রাঙ্কল করেছেন। টেলিফোনে বসের গলার স্বরে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন-আর বুঝি চাকরি থাকে না।
অথচ পি.আই.এ’র ফ্লাইটে নাকি রোজই শয়ে শয়ে অবাঙালি পশ্চিম পাকিস্তান যাচ্ছে। খবর কাগজেও এ নিয়ে সংবাদ বেরিয়েছে: কোন বাঙালি প্লেনের টিকিট পাচ্ছে
না, অথচ বিপুলসংখ্যক অবাঙালি রোজই প্লেনে করে বাংলাদেশ ছেড়ে যাচ্ছে।
বিশেষ করে ব্যবসায়ীরা। এরা এদের বউ ছেলেমেয়েদের সেই ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই
পাঠিয়ে দিতে শুরু করেছিল। এখন নিজেরা পালাচ্ছে। এদিকে শয়ে শয়ে সিলেটি
বাঙালি লন্ডন থেকে ছুটি কাটাতে এসে আটকা পড়ে গেছে। টিকিট পাচ্ছে না। অথচ
পি.আই.এ এদেরকে অন্য এয়ার লাইনসে টিকিট এনডোর্স করে নেবার অনুমতিও দিচ্ছে
না।
আজ বিকেলের প্লেনে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকা এসে নেমেছেন।
- শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বই থেকে
Post a Comment Blogger Facebook
Click to see the code!
To insert emoticon you must added at least one space before the code.