image

image
 

A+ A-
Voice of 71 Voice of 71 Author
Title: একাত্তরের দিনগুলি: ২৮ মার্চ, ১৯৭১
Author: Voice of 71
Rating 5 of 5 Des:
২৮ মার্চ, ১৯৭১, রবিবার গত রাতেও ঘুমোতে পারি নি। সন্ধ্যা থেকে শুরু হয়ে গোলাগুলি চলেছে প্রায় ভোর পর্যন্ত। কাল বিকেলেই কারেন্ট এ...
২৮ মার্চ, ১৯৭১, রবিবার

গত রাতেও ঘুমোতে পারি নি। সন্ধ্যা থেকে শুরু হয়ে গোলাগুলি চলেছে প্রায় ভোর পর্যন্ত।

কাল বিকেলেই কারেন্ট এসেছে, কিন্তু ফোন এখনো খারাপ। কারেন্ট না এসে যদি ফোনটা ঠিক হত, তাহলে বেশি স্বস্তি পেতাম। শরীফকে বললাম, “আজ যে করেই হোক, ফোনটা ঠিক করাতেই হবে। তোমার বন্ধু লোকমানকে বল না।”

শরীফ বিরক্ত হয়ে বলল, “তুমি কি পাগল হলে? মিলিটারি যেখানে সারা ঢাকায় সব ফোন কেটে দিয়েছে, সেখানে তোমার একটা ফোন সারবে কোন ম্যাজিকে?”

আটটায় কারফিউ উঠতেই কাসেম বারেক দু’জনকেই পাঠালাম-যে করেই হোক, যত টাকা কবুল করেই হোক, মেথর একটা ধরে আনতেই হবে।

জামী ধরে বসেছে কাল সে বাসায় ছিল, অতএব আজ তাকে বাইরে যেতে দিতেই হবে।

বললাম, “ঠিক আছে, যাবি। তবে একা নয়। রুমীর সঙ্গে।”

রুমী প্রতিবাদ করে উঠল, “আমার অন্য কাজ আছে।”

আমি রেগে রুমীকে কিছু বলতে গেলাম, তার আগেই কলিং বেল বেজে উঠল। জামী খুলে দিতেই কিটি উদভ্রান্তের মত এসে ঢুকল। তার সঙ্গের মিঃ চাইল্ডার দরজার বাইরে বারান্দাতেই দাঁড়িয়ে রইল।

“কিটি!” বলে আমি এগিয়ে যেতেই সে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। ধরেই রইল প্রায় দু’মিনিট, আর ছাড়ে না। তার বুকে যেন ঢেঁকির পাড় পড়ছে, আমি টের পাচ্ছি। একটু পরে জলেভরা চোখ তুলে কিটি অস্ফুট স্বরে বলল, “তোমরা কেমন আছ, দেখবার জন্য এসেছি।”

তিন মিনিটে শরীফ, রুমী, জামী-সকলের কুশল নিয়ে কিটি তক্ষুণি আবার মিঃ চাইল্ডার সঙ্গে গাড়িতে উঠে চলে গেল।

একটু পরে মিনিভাই এলেন গুলশান থেকে। তাঁর কাছে জানা গেল শেখ মুজিব বেঁচে আছেন, তাঁকে গ্রেপ্তার করে ‘আননোন ডেস্টিনেশানে’ নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতারা, ছাত্রনেতারা, প্রায় সকলেই পালিয়ে যেতে পেরেছেন।

শরীফ বলল, “চলুন ঢাকা ক্লাব ঘুরে আসি একবার।”

রুমী বলে উঠল, “আব্বু, আমি গাড়িটা নিয়ে যাই একটু।”

আমি বললাম, “আজ কিন্ত বারোটায় কারফিউ শুরু মনে থাকে যেন।”

“কেন? কাল তো বিকেল চারটে পর্যন্ত খোলা ছিল?”

“বোধ করি, গতকাল লোকজনের অত চলাফেরা দেখে আর্মি আজ সময় কমিয়ে দিয়েছে।”

জামী বলল, “আব্বু, আমি তোমার সঙ্গে ঢাকা ক্লাবে যাই?”

মিনি ভাইয়ের গাড়িতে শরীফ আর জামী ঢাকা ক্লাবে গেল। আমি রুমীকে বললাম, “আমাকে পাঁচ মিনিটের জন্য একবার হাসপাতালে ঘুরিয়ে এনে দিয়ে তারপর তুই তোর কাজে যাস। ইমন আর শেলীর জন্য একটু খাবার দিয়ে আসব।”

হাঁড়িপানা মুখ করে রুমী আমাকে নিয়ে হাসপাতালের দিকে রওনা হল। বললাম, “শহীদ মিনারের সামনের রাস্তা ধরে যাবি। ফেরার পথে বাংলা একাডেমির সামনে দিয়ে আসবি। একাডেমির দেয়াল নাকি গোলার ঘায়ে ভেঙে গেছে। আর রেসকোর্সের কালীবাড়িও নাকি নেই?”

শহীদ মিনারের সামনের রাস্তায় এসে রুমী গাড়ির গতি কমিয়ে চালাতে লাগল। ডাইনে তাকিয়ে দেখলাম, গতকাল শহীদ মিনারের যে ভাঙা উর্ধ্বাংশ দেখেছিলাম, আজ সেটাও নেই। গত রাতের তান্ডবে সব অদৃশ্য হয়ে শুধু গোড়া তিনটে রয়েছে। ওগুলো আর ওপড়াতে পারেনি। একটু জোরেই বলে উঠলাম, “শহীদ মিনার। তোমার এই অপমানের প্রতিশোধ নেবই নেব।”

রুমীর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। সে ঠোঁটে ঠোঁট টিপে শহীদ মিনার পেরিয়ে হাসপাতালের গেটে ঢ়ুকে গেল।

রুমী এলিফ্যান্ট রোডে গলির মুখে আমাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। গেটের কাছাকাছি আসতে দেখা হল হোসেন সাহেবের সঙ্গে। উনি চিন্তিত মুখে বললেন, “শুনলাম পাড়ায় কোন বাড়িতে কতো জোয়ান ছেলে আছে, তার লিস্ট হবে।”

শুনে চমকে গেলাম। মনে পড়ল মেইন রোডের উত্তরদিকের একটা গলিতে কয়েকটা অবাঙালি ছেলে থাকে, যাদের সঙ্গে কয়েক মাস আগে রুমীর ঝগড়া হয়েছিল। ওদের দৌলতে লিস্টে রুমী-জামীর নাম নিশ্চয় প্রথমে বসবে।

বাড়ি ঢ়ুকে রেডিও খুলে রেখে অসহায়ের মত বসে রইলাম। শরীফ রুমী না ফেরা পর্যন্ত করার কিছু নেই।

হঠাৎ জানালা দিয়ে কি যেন ঝপ করে মেঝেয় পড়ল। চমকে দেখি খবরের কাগজ। দৌড়ে জানালার কাছে গিয়ে ডাক দিলাম, “বদরুদ্দিন, তুমি বেঁচে আছ?”

বদরুদ্দিন সে-ই ১৯৫৬ সাল খেকে আজিমপুরের বাসায় থাকার সময় থেকে আমাদের কাগজ দেয়। বদরুদ্দিন রোগা মুখে করুণ হেসে বলল, “আল্লার রহমত আর আপনাদের দোয়া।”

“আর কোন কাগজ বেরোয় নি?”

“না, এই একটাই।”

“যেদিন যতগুলো কাগজ বেরোবে সব দিয়ে যাবে কেমন?”

“আচ্ছা।” বলে বদরুদ্দিন চলে গেল। কাগজ পড়ার উত্তেজনায় বদরুদ্দিনকে জিগ্যেস করতে ভুলে গেলাম এ কয়দিন তার কেমন কেটেছে।

২৫ তারিখ রাতের মহামারণযজ্ঞের পর এই প্রথম কাগজ বেরোল– পাকিস্তান অবজারভার। দুই পাতা মাত্র। আট কলাম জুড়ে দুই ইঞ্চি চওড়া হেডলাইন: ইয়াহিয়া ব্রডকাস্টস। ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণ। ইয়াহিয়ার ২৬ তারিখ সন্ধ্যার বেতার বক্তৃতার পুরো বিবরণ। তার নিচে বাকি পাতা জুড়ে মার্শাল ল অর্ডারসমূহের নম্বর ধরে ধরে বিবরণ। একপাশে ছোট্ট হেডিংয়ে খবর: মুজিব অ্যারেস্টেড- মুজিব গ্রেপ্তার।

সকালে রেডিওতে ঘোষণা করা হয়েছিল আটটা-বারোটা কারফিউ থাকবে না। অথচ এখন পৌনে বারোটায় সেটা বাড়িয়ে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত করা হল। এতে আমাদের সুবিধেই হয়েছে। রুমী-জামীকে মিনি ভাইয়ের বাসায় দিয়ে আসা সম্ভব হবে। মিনিভাই বলেছেন গুলশানের বাড়িগুলো তুলনামূলকভাবে নিরাপদ।

জামী ঢাকা ক্লাব থেকে ফিরেছে খুব বিচলিত হয়ে। ঢাকা ক্লাবেও আর্মি ঢুকেছিল, কয়েকজন বেয়ারার লাশ আজ সকাল পর্যন্তও পড়েছিল। জামীর জীবনে বোধ হয় এই প্রথম এরকম ফুলে পচে ওঠা দু’তিনটে লাশ এভাবে দেখা। ভালোই হল, গুলশানে টাট্টুর সঙ্গে থাকলে ও সামলে উঠতে পারবে।

দুপুরে খেয়েই রুমী জামীকে নিয়ে গুলশাল চললাম আমি ও শরীফ। রাস্তাঘাট গৎকালের তুলনায় বেশ  নির্জন। বারোটায় কারফিউ শুরু হবে, সেটা সকালেই জেনে লোকজন সেইভাবে বাড়ি দৌড়েছে। শেষ মুহুর্তে সময় বাড়ালেও জনশূণ্য রাস্তাঘাট আর ভরে ওঠে নি।

রুমী-জামীকে গুলশানে রেখে ফেরার পথে আজিমপুর গেলাম একরাম ভাই লিলিবুর বাসায়।

- শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বই থেকে

About Author

Advertisement

Post a Comment Blogger

 
Top