image

image
 

A+ A-
Voice of 71 Voice of 71 Author
Title: একাত্তরের দিনগুলি: ২৫ মার্চ, ১৯৭১
Author: Voice of 71
Rating 5 of 5 Des:
২৫ মার্চ, ১৯৭১, বৃহষ্পতিবার ২৩ মার্চের উজ্জ্বল প্রতিরোধ দিবসের পর কি যেন এক কালোছায়া সবাইকে ঘিরে ধরেছে। চারদিক থেকে খালি নৈরাশ্যজ...
২৫ মার্চ, ১৯৭১, বৃহষ্পতিবার

২৩ মার্চের উজ্জ্বল প্রতিরোধ দিবসের পর কি যেন এক কালোছায়া সবাইকে ঘিরে ধরেছে। চারদিক থেকে খালি নৈরাশ্যজনক খবর শোনা যাচ্ছে। ইয়াহিয়া-মুজিব- ভুট্টোর বৈঠক যেন সমাধানের কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছে না। শেখ মুজিব প্রতিদিন প্রেসিডেন্ট ভবনে যাচ্ছন আলোচনা করতে, বেরিয়ে এসে সাংবাদিকদের বলছেন আলোচনা এগোচ্ছে; ওদিকে আন্দোলনকারী জঙ্গী জনতাকে বলছেন দাবি আদায়ের জন্য আপনারা সংগ্রাম চালিয়ে যান। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলুন।

বেশকিছু দিন থেকে মুখে মুখে শোনা যাচ্ছে প্রতিদিন নাকি প্লেনে করে সাদা পোশাকে প্রচুর সৈন্য এসে নামছে বিমানবন্দরে। বিশ্বাস হতে চায় না কথাটা, তবু বুক কেঁপে ওঠে। ওদিকে চটগ্রাম খেকে দু’তিনজন বন্ধুর টেলিফোনে জানা গেছে-চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্র বোঝাই জাহাজ এসে ভিড়েছে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। সে অস্ত্র চট্টগ্রামের বীর বাঙালিরা খালাস করতে দেবে না বলে মরণপণ করে রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিচ্ছে। ওদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য আর্মি ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওদের ওপর।

রুমীর মুখে দু’দিনের খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মাথার চুল খামছে ধরে রুমী বলল, “আম্মা বুঝতে পারছ না মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা ব্যর্থ হতে বাধ্য। এটা ওদের সময় নেবার অজুহাত মাত্র। ওরা আমাদের স্বাধীনতা দেবে না। স্বাধীনতা আমাদের ছিনিয়ে নিতে হবে সশস্ত্র সংগ্রাম করে।”

আমি শিউরে উঠলাম, “বলিস কিরে? পাকিস্তান আর্মির আছে যুদ্ধের লেটেস্ট মডেলের সব অস্ত্রশস্ত্র। তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করবি কি দিয়ে?”

রুমী উত্তেজিত গলায় বলল, একজ্যাকটলি-সেই প্রশ্ন আমারও। সাদা গাড়িতে কালো পতাকা উড়িয়ে শেখ রোজ প্রেসিডেন্ট হাউসে যাচ্ছেন আর আসছেন, আলোচনার কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না। ওদিকে প্লেনে করে রোজ সাদা পোশাকে হাজার হাজার সৈন্য এসে নামছে, চট্টগ্রামে অস্ত্রভর্তি জাহাজ ভিড়ছে। আর এদিকে ঢাকার রাস্তায় লাঠি-হাতে বীর বাঙালিরা ধেই ধেই করে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সালাম দিয়ে হৃষ্টচিত্তে বাড়ি ফিরে পেট-পুরে মাছ-ভাত খেয়ে ঘুম দিচ্ছে। পল্টন ময়দানে ডামি বন্দুক ঘাড়ে কুচকাওয়াজ করছে। আমরা কি এখনো রূপকথার জগতে বাস করছি নাকি? ছেলেমানুষিরও একটা সীমা থাকা দরকার।”

“তাহলে এখন উপায়?”

“উপায় বোধহয় আর নেই আম্মা।”

ভয় আর আতঙ্কের একটা হিম বাতাস আমাকে অবশ করে দেয় যেন, “না, না, ওরকম করে বলিস না। তুই শেখের রাজনীতি সমর্থন করিস না, তাই একথা বলছিস। তোরা হলি জঙ্গী বাঙালি, খালি মার-মার, কাট-কাট। শেখ ঠিক পথেই আন্দোলনকে চালাচ্ছেন। ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনা ব্যর্থ হলেও এভাবে অহিংস, অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে জনগণ তাদের দাঁবি ঠিকই আদায় করে নেবে?”

“আম্মা, তুমি কোন আহাম্মকের স্বর্গে বসে আছ? শুধু কয়েকটা বিষয় তলিয়ে দেখ-পূর্ব পাকিস্তানে বর্তমানে যা যা ঘটছে সবই পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে। স্বাভাবিক হিসেবে এগুলো সবই বিষম রাষ্ট্রদ্রোহিতা। দেশের সর্বময় কর্তা প্রেসিডেন্ট খোদ হাজির, অথচ দেশ চলছে শেখের কথায়। লোকে অফিস-আদালত-ব্যাঙ্ক সব চালাচ্ছে শেখের সময়ে। তারপর দেখ পাকিস্তান সরকারের হেনস্তা। টিক্কা খানকে কোন বিচারপতি শপথ গ্রহণ করাতে রাজি হল না বলে বেচারা গভর্নর হতে পারল না। শুধু মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটার হয়ে কাজ চালাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ঢাকায় এসে নামল আর তার বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ। সেনাবাহিনীর জন্য কোন বাঙ্গালি খাবার জিনিস বেচছে না। ওরা কতদিন ডাল-রুটি খেয়ে থেকেছে। তারপর প্লেনে করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে খাবার আনতে হয়েছে। এতসব কান্ডের পরও ইয়াহিয়া সরকার একদম মুখ বুজে চুপ করে আছে। কেন বুঝতে পারছ না? ওরা শুধু সময় নিচ্ছে। ওরা আলোচনার নাম করে আমাদের ভুলিয়ে রাখছে। শেখ বড্ডো দেরি করে ফেলছেন। এপথে, এভাবে আমরা বাঁচতে পারব না।”

আমি রাগ করে বললাম, “দাড়ি কামিয়ে সাবান মেখে ঠান্ডা পানিতে ভালো করে গোসল কর দেখি বাপু-মাথা বড্ড বেশি গরম হয়ে গেছে।”

রুমী নীরবে উঠে নিজের ঘরে চলে গেল। আমি কেমন যেন চুপসে গেলাম। নিজের মনেও যেন আর জোর পাচ্ছি না।

আজ আবার রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী-দম্পতি আতিক ও বুলুর বাসায় রাতের খাবার দাওয়াত আছে। এরকম অবস্থায় দাওয়াত খেতে যেতে ইচ্ছে করে না, আবার ঘরে বসে থাকলেও ফাঁপর লাগে। শরীফের মিটিং ছিল ঢাকা ক্লাবে। অতএব আমি একাই গেলাম আতিকের বাসায়। সেখানে দেখা হল এনায়েতুল্লাহ খান ও তার স্ত্রী লীনার সঙ্গে, লীনার ছোট ভাই জিল্লুর রহমান খান ও তার আমেরিকান বউ মার্গারেটের সঙ্গে। আরো এসেছে আতিকের বন্ধু হালিম ও তার স্ত্রী মণি, আতিকের ভায়রা ভাই ফাত্তাহ ও তার স্ত্রী। সকলের মুখে একই কথা: কি হবে? কি হবে?

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া নাকি কাউকে না জানিয়ে লুকিয়ে প্লেনে চড়ে পশ্চিম পাকিস্তান চলে গেছে? রাস্তায় নাকি ইতোমধ্যেই আর্মি নেমে গেছে? আমি বুঝতে পারছি না আর্মি কেন নামবে।

সাড়ে নয়টার সময় মাসুমা ফিরল টিভি অফিস থেকে। কিছুদিন আগে বড়ভাই রফিকুল ইসলামের বাসা ছেড়ে এখন মেজভাই আতিকুল ইসলামের বাসায় থাকছে। সে এল ঝড়েপড়া পাখির মতো বিদ্ধস্ত চেহারা নিয়ে। সবার মধ্যে যে আশঙ্কা, তারমধ্যেও তাই। বরং টিভি স্টেশনে সে আমাদের চেয়ে বেশিকিছু শুনেছে। কিন্তু মাসুমা আমাদের সঙ্গে বসল না, বলল, খুব বেশি টায়ার্ড আমি, নিজের ঘরে যাই।” অনেক বলা সত্ত্বেও সে খেল না আমাদের সঙ্গে।

আমাদেরও খিদে ছিল না। কোনোমতে খাওয়া সারলাম সবাই। সাড়ে দশটায় শরীফ ফোন করল, “এখনো দেরি করছ কেন? শহরের অবস্থা ভালো নয়। বহু জায়গায় জনতা নতুন করে ব্যারিকেড দিচ্ছে। ইয়াহিয়া ঢাকা ছেড়ে চলে গেছে। অনেক রাস্তায় আর্মির গাড়ি দেখা যাচ্ছে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এস।”

ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ ভীষণ শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। চমকে উঠে বসলাম। রুমী-জামী ছুটে এল এ ঘরে। কি ব্যাপার? দু’তিন রকমের শব্দ-ভারি বোমার বুমবুম আওয়াজ, মেশিনগানের ঠাঠাঠাঠা আওয়াজ, চি-ই-ই-ই করে আরেকটা শব্দ। আকাশে কি যেন জ্বলে-জ্বলে উঠছে, তার আলোয় ঘরের ভেতর পর্যন্ত আলোকিত হয়ে উঠছ। সবাই ছুটলাম ছাদে। আমাদের বাড়ির দক্ষিণ দিকে মাঠ পেরিয়ে ইকবাল হল, মহসীন হল, আরো কয়েকটা হল, ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টার্সের কয়েকটা বিল্ডিং। বেশির ভাগ আওয়াজ সেইদিক থেকে আসছে, সেই সঙ্গে বহু কন্ঠের আর্তনাদ, চিৎকার। বেশিক্ষণ ছাদে দাঁড়ালো গেল না। আগুনের ফুলকির মত কি যেন চিঁ-ই-ই-ই শব্দের সঙ্গে এদিক পানে উড়ে আসছে। রুমী হঠাৎ লাফ দিয়ে কালো আর স্বাধীন বাংলা পতাকা দুটো নামিয়ে ফেলল।

হঠাৎ মনে পড়ল একতলায় বারেক, কাসেম ওরা আছে। হুড়হুড় করে সবাই নিচে নেমে গেলাম। রান্নাঘরের ভেতর দিয়ে উঠানের দিকের দরজাটা খুলতেই আমাদের অ্যালসেসিয়ান কুকুর মিকি তীর বেগে ঘরে ঢুকে আমাদের সবার পায়ে লুটোপুটি খেতে খেতে করুণ স্বরে আর্তনাদ করতে লাগল। উঠানের দিকে মুখ বাড়িয়ে ডাকলাম, “বারেক-কাসেম।” ওদের ঘরের দরজা খুলে বারেক, কাসেম কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এসে ঘরে ঢুকল। আমি বললাম, “তোমরা তোমাদের বিছানা নিয়ে এ ঘরে চলে এস।”

মিকিকে কিছুতেই আর ঘর থেকে উঠানে নামানো গেল না। এত গোলাগুলির শব্দ ও ট্রেসার হাউইয়ের নানা রঙের আলোর ঝলকানিতে সে দিশেহারা হয়ে গেছে। রুমী তার ঘাড়ে-মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলল, “ভয় নেই, মিকি ভয় নেই। তুই আমাদের সঙ্গে উপরে থাকবি।” তাকে উপরেও নেয়া গেল না। কি এক মরণ ভয়ে ভীত হয়ে সে খালি কোণা খুঁজছে। শেষে সিঁড়ির নিচের ঘুপচি কোণটাতে কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে রইল।

বসার ঘরে ফোন তুলে দেখি-ফোন ডেড। উপরে উঠে গেলাম। বাবার গলা শুনলাম। রুমী গিয়ে বাবার হাত ধরে মৃদু স্বরে তাঁকে কি কি যেন বলতে লাগল।

বাকি রাত আর ঘুম এল না। আবার ছাদে গেলাম। দূরে দূরে আগুনের আভা দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন দিক থেকে গোলাগুলি, মেশিনগানের শব্দ আসছে, ট্রেসার হাউই আকাশে রংবাজি করে চলেছে-দূর থেকে চিৎকার ভেসে আসছে। উত্তরে, দক্ষিণে, পূর্বে, পশ্চিমে সবদিকেই দূরে আগুনের স্তম্ভ ক্রমেই স্পষ্ট ও আকাশচুম্বী হয়ে উঠছে।

কারো মুখে কোনো কথা নেই। রুমী, জামী নীরবে থমথমে মুখে সুতলির বাঁধন খুলে প্লাস্টিক ব্যাগ একে একে উপুড় করল কমোডে। একটু করে ফ্ল্যাশ করে, খানিক অপেক্ষা করে, আবার ঢালে, আবার ফ্ল্যাশ করে। এক সঙ্গে সব মালমশলা ঢাললে কমোডের নল বন্ধ হয়ে যাবে। জামী বাসনমাজা পাউডার দিয়ে তিন চারবার করে হামানদিস্তা দুটো মাজল আর ধুল। একবার ধুয়ে শুঁকে দেখে, আবার মাজে, আবার ধোয়।

এ কাজ সেরে রুমী মার্কস, এঙ্গেলসের বই, মাও-সে-তুংয়ের মিলিটারি রচনাবলি সব একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরল। আমরা চিন্তা করতে লাগলাম কোথায় বইগুলো লুকোনো যায়। মাটিতে পুঁততে চাইলে, বইগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। শেষে মনে পড়ল বারেকদের ঘরের পেছনে বাউন্ডারি ওয়ালের এক জায়গায় একটা কোটরমতো আছে। প্রতিবেশী হেশাম সাহেবের বাউন্ডারি ওয়ালের দরুন এই কোটরটার সৃষ্টি হয়েছে। এখানে বইয়ের প্যাকেটটা ফেলে দিলে লুকোনোও থাকবে, নষ্ট হবে না। ভোরের আলো অল্প একটু ফুটতেই রুমী সাবধানে গুড়ি মেরে ওখানে গিয়ে বইয়ের প্যাকেটটা রেখে দিল। তার ওপর ফেলল কয়েকটা শুকনো নারকেলের পাতা।

- শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বই থেকে

About Author

Advertisement

Post a Comment Blogger

Emoticon
:) :)) ;(( :-) =)) ;( ;-( :d :-d @-) :p :o :>) (o) [-( :-? (p) :-s (m) 8-) :-t :-b b-( :-# =p~ $-) (b) (f) x-) (k) (h) (c) cheer
Click to see the code!
To insert emoticon you must added at least one space before the code.

 
Top
Chat here...