image

image
 

A+ A-
Voice of 71 Voice of 71 Author
Title: একাত্তরের দিনগুলি: ৩ মে, ১৯৭১
Author: Voice of 71
Rating 5 of 5 Des:
৩ মে, সোমবার, ১৯৭১ আজ আমার জন্মদিন। ২৯ মার্চ রুমীর জন্মদিনে তবু ভাবতে পেরেছিলাম কিছু স্পেশাল রান্না করা দরকার। কারণ তখনো ২৫ মার্চ...

৩ মে, সোমবার, ১৯৭১

আজ আমার জন্মদিন।

২৯ মার্চ রুমীর জন্মদিনে তবু ভাবতে পেরেছিলাম কিছু স্পেশাল রান্না করা দরকার। কারণ তখনো ২৫ মার্চ কালরাত্রির আকস্মিকতার আঘাত মনকে পুরোপুরি ধরাশায়ী করতে পারে নি; কারণ তখনো এই নিষ্ঠুর মারণযজ্ঞের ব্যাপকতা বুঝে উঠতে পারি নি। তাই তখনো স্বাভাবিক চিন্তাধারা, গতানুগতিক মনমানসিকতা যেন একেবারে মরে যায় নি। কিন্তু সেই ধ্বংসযজ্ঞের পাঁচ সপ্তাহ পর এখন মনমানসিকতা, চিন্তাধারা কিছুই আর চিরাচরিত, গতানুগতিক খাতে বইছেনা। যে জীবন এতকাল যাপন করে এসেছি, তা বড়ই অর্থহীন মনে হছে। ভিখু, মিলি, সিদ্দিকা, নূরুর রহমানের অনর্থক হত্যা মনকে একেবারে অসাড় করে দিয়েছে।

তবু প্রতিবছরের অভ্যাসমতো রুমী-জামী যখন আজ সকালে আমাদের ঘরের দরজার ওপাশ থেকে বলল, "আম্মা আসি ?" তখন চেখ ভরা পানি নিয়ে বললাম, "এসো।"

ওরা প্রতিবছরের অভ্যাসমতই ঘরে ঢুকল, কিন্তু প্রতিবছরের মতো হাসিমুখে নয়, সুন্দর প্যাকেটে মোড়া হাতভর্তি 'সারপ্রাইজ প্রেজেন্ট' নিয়েও নয়। ওদের মুখও মেঘাচ্ছন্ন, তবে তাতে পানি নেই, বজ্রের আভাস আছে- টের পেলাম। রুমীর হাতে একটা পুরনো বই, জামীর হাতে বাগান থেকে তোলা একটি আধা-ফোটা কালো গোলাপ যার নাম 'বনি প্রিন্স।'

রুমী বইটা আমার হাতে দিয়ে বলল, “আম্মা, এই বইটা তুমি পড়লে মনে অনেক জোর পাবে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শুরুতে জার্মানি অতর্কিত আক্রমণ করে পোল্যান্ড দখল করে নেবার পর সেখানে পোলিশ ইহুদীদের ওপর নাৎসী বাহিনীর অমানুষিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে পোলিশরা যে অসাধারণ প্রতিরোধ গড়ে তোলে তারই কাহিনী এটা। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত কিভাবে তারা লড়াই করে গেছে, লড়াই করে মরেছে, তবু মাথা নোয়ায় নি, তারই কাহিনী এটা। এই বইটা পড়লে তোমার মনের সব ভয় চলে যাবে, সব দুঃখ তুচ্ছ হয়ে যাবে। জার্মানরা ইহুদীদের মানুষ বলে গণ্য করত না। পশ্চিম পাকিস্তানিরাও আমাদের মানুষ বলে গণ্য করে না, মুসলমান বলেও গণ্য করে না। অথচ ওদের চেয়ে আমরা বহুগুণে খাঁটি মুসলমান। পড়লে তুমি বুঝতে পারবে, এই বইতে যা লেখা আছে, দেশ আর জাতির নাম বদলে দিলে তা অবিকল বাংলাদেশ আর বাঙালির দু:খের কাহিনী, প্রতিরোধের কাহিনী, বাঁচা-মরার লড়াইয়ের কাহিনী বলে মনে হবে।”

চেয়ে দেখলাম লিয়ন উরিস-এর লেখা ‘মাইলা-১৮’। রুমীর নিজ লাইব্রেরিতে ‘এক্সোডাস’ - এর বিখ্যাত লেখক লিয়ন উরিস-এর সবগুলো বই-ই আছে। আগে দেখেছি, তবে পড়া হয়ে ওঠে নি।

জামী কালো গোলাপের আধফোটা কলিটি আমার হাতে দিল, রুমী বলল, “আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক। এই রকম রঙের রক্ত ঝরিয়ে তবে স্বাধীনতার রাজপুত্র আসবে।”

বনি প্রিন্স-এর পাপড়িগুলো কালচে ঘন মেরুন রঙের, জমাট বাঁধা কালচে রক্তের মতো। এখনো পুরো ফোটে নি, মখমলের মতো মসৃণ, পুরু পাপড়িগুলো মুঠি বেঁধে আছে। আমাদের স্বাধীনতার এখনো অনেক দেরি।

রুমী বলল, “তোমার জন্মদিনে একটি সুখবর দিই আম্মা।” সে একটু থামল, আমি আগ্রহে তাকিয়ে রইলাম, “আমার যাওয়া ঠিক হয়ে গেছে। ঠিকমত যোগাযোগ হয়েছে। তুমি যদি প্রথম দিকে অত বাধা না দিতে, তাহলে একমাস আগে চলে যেতে পারতাম।”

আমি বললাম, “তুই আমার ওপর রাগ করিস নে। আমি দেখতে চেয়েছিলাম, তুই হুজুগে পড়ে যেতে চাচ্ছিস, না সত্যি সত্যি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে যেতে চাচ্ছিস।”

“হুজুগে পড়ে?” রুমীর ভুরু কুচকে গেল, বাঁচা-মরার লড়াই, নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার যুদ্ধে যেতে চাওয়া হুজুগ?”

“না, না, তা বলি নি। ভুল বুঝিস নে। বন্ধুরা সবাই যাচ্ছে বলেই যেতে চাচ্ছিস কি না, যুদ্ধক্ষেত্রের কষ্ট ও ভয়াবহ অবস্থা সম্বন্ধে সম্যক ধারণা করতে পেরেছিস কি না সেসব যাচাই করবার জন্যই তোকে নানাভাবে বাধা দিচ্ছিলাম। তুই-ই তো বলেছিস, তোর কোন কোন বন্ধু যুদ্ধের কষ্ট সইতে না পেরে পালিয়ে এগেছে।”

“তা এসেছে, কিন্তু তাদের সংখ্যা খুবই কম। কোটিতে দুজনার বেশি হবে না।”

“কবে যাবি? কাদের সঙ্গে?”

“তিন-চারদিনের মধ্যেই। কাদের সঙ্গে- নাম জানতে চেও না, বলা নিষেধ।”

লোহার সাঁড়াশি দিয়ে কেউ যেন পাজরের সবগুলো হাড় ছেপে ধরেছে। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে, চোখের বাইরে নিঃশর্তভাবে ছেড়ে দিতে হবে। জানতে চাওয়াও চলবে না- কোন পথে যাবে, কাদের সঙ্গে যাবে। রুমী এখন তার নিজের জীবনে প্রবেশ করতে যাচ্ছে, তার একান্ত নিজস্ব ভুবন সেখানে তার জন্ম-দাত্রীরও প্রবেশাধিকার নেই।

মনে পড়ল, খালীল জিবরান তাঁর ‘প্রফেট’ বইতে এদের সম্পর্কেই লিখে গেছেন:

তোমাদের সন্তানেরা তোমাদের নয়,
.......................................
তারা জীবনের সন্তানসন্ততি
জীবনের জন্যই তাদের আকুতি।
তারা তোমাদের সঙ্গেই রয়েছে
তবু তারা তোমাদের নয়।
তারা তোমাদের ভালোবাসা নিয়েছে
কিন্তু নেয় নি তোমাদের ধ্যান-ধারণা,
কেননা তারা গড়ে নিয়েছে
তাদের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা।
তাদের শরীর তোমাদের আয়ত্বের ভেতর
কিন্তু তাদের আত্মা কখনই নয়
কেননা, তাদের আত্মা বাস করে
ভবিষ্যতের ঘরে,
যে ঘরে তোমরা কখনই পারবে না যেতে
এমনকি তোমাদের স্বপ্নেও না।
.............................................
তাদেরকে চেয়ো না তোমাদের মত করতে
কারণ তাদের জীবন কখনই ফিরবে না
পেছনের পানে।

- শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বই থেকে

About Author

Advertisement

Post a Comment Blogger

 
Top