৯ মে, রবিবার, ১৯৭১
একটা লোহার সাঁড়াশি যেন পাঁজরের দুই পাশ চেপে ধরে আছে। মাঝে-মাঝে নিঃশ্বাস আটকে আসে। মাঝে-মাঝে চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। মাঝে-মাঝে সব কাজ ফেলে ডুকরে কেঁদে উঠতে ইচ্ছে করে। কিন্তু মাছের মাকে নাকি শোক করতে নেই। চোরের মাকে নাকি ডাগর গলায় কথা বলতে হয়। রুমী যাবার পর উঁচু ভল্যুমে ক্যাসেট বাজানো হয় প্রায় সারাদিনই। সন্ধ্যে হলেই সারা বাড়িতে সব ঘরে বাতি জ্বেলে জোরে টিভি ছেড়ে রাখা হয়। অর্থাৎ বাড়িতে বেশ একটা উৎসব উৎসব পরিবেশ। বেশ গান বাজনা, হৈচৈ, কলকোলাহল। আশেপাশে কোন বাড়ির কেউ যেন সন্দেহ না করে যে এ বাড়ির লোকগুলোর বুক খাঁখাঁ করছে, ব্যথায় কলজেয় টান ধরছে।
আকাশের বুকেও অনেক ব্যাথা। তার কিন্তু আমার মতো চেপে রাখার দায় নেই। তাই সেও ক’দিন থেকে মাঝে-মাঝে অঝোরে ঝরাচ্ছে। না জানি রুমীদের কি কষ্ট হচ্ছে এই বৃষ্টিতে।
জামীও আবদার ধরেছিল সে রুমীর সঙ্গে যাবে। তাকে অনেক করে বুঝিয়েছি, দু’ভাই একসঙ্গে গেলে পাড়ার লোকে সন্দেহ করবে। সবচেয়ে বড় কথা বাবাকে কি কৈফিয়ত দেব? ওঁকে তো কিছুতেই বলা চলবে না মুক্তিযুদ্ধের কথা। তাহলে উদ্বেগে, উত্তেজনায় ব্লাড প্রেসার বেড়ে স্ট্রোক হয়ে যাবে। তাছাড়া আমিই বা থাকব কি করে?
কাল সারারাত ঘুম হয় নি। সারারাত জোরে জোরে মাইকে হামদ, নাত, দরুদ, মিলাদ, মওলানা সাহেবদের ওয়াজ-নসিহত এসব শোনা গেছে। এ বছর ঈদ-ই- মিলাদুন্নবী অনেক বেশি শান-শওকত ধুম-ধড়াক্কার সঙ্গে পালিত হচ্ছে। চার-পাঁচদিন আগে খেকে খবরের কাগজ, রেডিও-টিভিতে ঢোল-শোহরতের কি ঘটা! ইসলামকে পুরো গলা কেটে জবাই করে এখন তাকে জোড়া লাগানোর চেষ্টা!
সকালে উঠে চোখ করকর করছিল, শরীরও ম্যাজম্যাজ। ভাবলাম গোসল করলে ঝরঝরে লাগবে। গোসল করে নাশতা খেয়েও স্বস্তি লাগছে না। শরীফ বলল, “বিষ্টি নেই, চল লিলিবুদের বাড়ি যাই। ওখান থেকে নারিন্দা।”
কোথাও বেরোতে ইচ্ছে করে না, আবার ঘরে বসে থাকলেও ফাঁপর লাগে। তাই জোর করেই বেরিয়ে পড়লাম। ঠিক আছে, সব আত্মীয়স্বজনের বাড়িতেই বেড়াব আজ। লিলিবুদের বাসায় খানিক বসে লিলিবু ও একরাম ভাইকে সঙ্গে নিয়ে নারিন্দায় গেলাম আতাভাইদের বাসায়। ওখান থেকে কাছেই নওয়াব স্ট্রিটে খোকাদের বাসায়। গিয়ে দেখি খোকার বোন আনা তার সামী পুত্র শাশুড়িসহ এ বাড়িতে। আনাদের বাড়িও কাছেই- ক্যাপ্টেন বাজারে। ওদের বাড়ির পেছনে বিহারিদের বস্তি। সামনে রেললাইন পেরিয়ে আওয়ামী লীগের অফিস। ২৫ মার্চ রাতে আওয়ামী লীগের অফিস আউনে পোড়ানো হয়। ২৭ তারিখ সকালে কারফিউ উঠলে আনারা ভাইয়ের বাসায় চলে আসে। খোকা ও আনার বড় বোন মীরা আমার চাচাত দেবর আনুর স্ত্রী। আনু ও মীরা এখন করাচিতে রয়েছে। ওদের জন্যেও খোকারা সবাই খুব উদ্বিগ্ন, বিশেষ করে খোকার আম্মা। খানিকক্ষণ পরস্পরের জানা খবর বিনিময় করে আমরা উঠলাম। ফেরার পথে একরাম ভাই বললেন, “মকু মিয়ার বাড়ি চল ক্যানে একবার? ভিখুর ছেলেমেয়েরা, মা, বোন সবাই ফিরেছে শুনলাম। দেখে আসি।”
আমি বললাম, “ভিখুর ছেলে রুবেল ফেরে নি। ও নাকি আগেই রাজশাহী দিয়ে ইন্ডিয়া চলে গেছে। ভিখুর দুই মেয়ে লীরা, ইয়েন মকু মিয়ার বাড়িতে আছে। বুলু, তার মাও আছে।”
মকু চৌধুরীর বাড়ি গিয়ে বুলুর দেখা পেলাম না; ও আজ ভোরের প্লেনে পোল্যান্ডের পথে করাচি রওনা হয়ে গেছে। তবে আরো অনেক আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা হলো -তনজিম, তার বউ ডলি, বুলুর ছোট বোন গুলু অর্থাৎ মওদুদা। তনজিম, ডলি, ণ্ডলুর মুখেও খানসেনাদের বিভিন্ন জায়গার বিভিন্ন রকমের নিষ্ঠুরতার কাহিনী শুনলাম। এ ছাড়া অন্য কোন কথা নেই কারো মুখে। কানু ছাড়া গীত নেই।
বাসায় ফিরে ঘরে পা দিয়েই চমকে গেলাম। বসার ঘরে সোফায় বসে এক রোগাপাতলা লোক, চুলদাড়ি সব সাদা, গর্তে ঢোকা চোখ, কপালে গভীর ভাঁজ। চিনতে না পেরে তাকিয়ে রইলাম। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “সালাম আলায়কুম, আমি রসুল। চিনতে পারেন নি, না?”
লজ্জিত হেসে বললাম, “ওয়ালায়কুম সালাম। কি করে চিনব! এত রোগা হয়ে গেছেন! চুলদাড়ি সাদা হলো কি করে? বসুন।”
রসুল সাহেব আমার এক ছাত্রীর স্বামী। ছাত্রী মানে সেই ১৯৫২ সালে আমি যখন প্রথম সিদ্ধেশ্বরী স্কুলে চাকরি করতে যাই, সেই বছরের ক্লাস টেনের ছাত্রী। মাত্র বছরখানেক পেয়েছিলাম তাকে, তাতেই পরবর্তী সময়ে যখনই তার সঙ্গে দেখা হয়েছে, আমাদের ‘বড় আপা’ বলে উচ্ছ্বসিত হয়েছে। বিয়ের পরে স্বামীকে সঙ্গে এনে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। রসুল সাহেব সরকারি চাকুরে। বদলির চাকরি। বিভিন্ন জেলায় ঘুরে বেড়ান। যখনি ঢাকা আসেন, একবার আমাদের বাসায় আসবেনই। ধর্মভীরু পরহেজগার মানুষ। কালো চাপদাড়ি, মাথায় কালো জিন্না টুপি- এইভাবে তাঁকে দেখে আসছি গত পনের-ষোল বছর ধরে। সেই মানুষের একি চেহারা হয়েছে!
আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, "বয়েস হয়েছে, একটু-আধটু পাক ধরেছিল আগেই, কিন্তু গত দেড় মাসে হঠাৎ সব সাদা হয়ে গেল ভয়ে, দুর্ভাবনায়, ছুটোছুটিতে।"
আমি বারেককে চা’র কথা বলে এসে বললাম, "বলুন তো কি ব্যাপার? এবার প্রায় চার বছর পর এলেন। কোথায় পোস্টেড ছিলেন? কিভাবে কাটালেন এই দেড় মাস?"
“ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বদলি হয়েছিলাম মাত্র ছ’মাস আগে। ভালোই ছিলাম। ক্র্যাকডাউনের পরেও ওখানেই ছিলাম। প্রথম কিছুদিন এলাকাটা জয় বাংলার দখলেই ছিল। তারপর যখন প্লেন থেকে বোমা ফেলা শুরু হলো, তখন জানের ভয়ে সব ফেলে বউ- ছেলেমেয়ের হাত ধরে গ্রামের দিকে পালিয়েছিলাম। সে যে কি কষ্ট। কোন একটা গ্রামে থিতু হয়ে থাকতে পারি নি। আমার বাড়ি উত্তরবঙ্গে। এদিকের কোন গ্রামে কোন আত্মীয়স্বজন, চেনাজানা কেউ নেই। কিন্তু গ্রামের লোকেরা এত ভালো ব্যবহার করেছিল যে কি বলব। খেতে দিয়েছে, শুতে দিয়েছে। কিন্তু হলে কি হবে, পাকিস্তান আর্মি যেভাবে গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিচ্ছিল, তাতে ওরা নিজেরাই একগ্রাম ছেড়ে আরেক গ্রামে দৌড়াচ্ছিল, সেই সাথে আমরাও।”
শরীফ জিগ্যেস করল, “আচ্ছা, কোন সময় বম্বিং করে, মনে আছে?”
“মার্চের শেষে হবে। তারিখ ঠিক মনে নেই।”
শরীফ বলল, "ওই সময় আমরা প্রায় প্রায়ই দেখতাম বম্বার প্লেনগুলো এদিক-ওদিক উড়ে যাচ্ছে। ঘরে বসে বুঝতে পারতাম না, কিন্তু সন্দেহ করতাম- যেসব এলাকা তখনো জয়বাংলার দখলে রয়েছে, সেইসব এলাকায় বোমা ফেলতে যাচ্ছে। আচ্ছা, আপনি কি বলতে পারবেন ওই অঞ্চলে কি রকম যুদ্ধ হয়েছিল?"
রসুল মাথা নেড়ে বলল, “না। আমাদের বাড়িটা যে পাড়ায় ছিল, সেখানে বোমা পড়ে নি, তবে কাছেই বোমা পড়েছে, বিকট শব্দ, লোকজনের ঢিৎকার শুনেছি, আগুন দেখেছি। আর তখুনি একবস্ত্রে ছুটে পালিয়েছি পাশের এক গ্রামে। কিন্তু সেখানে একরাত থাকার পরই শুনলাম মিলিটারি আসছে। যাদের বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিলাম তারাসুদ্ধ পালালাম। দু’দিন পরে ফিরে এসে দেখি- পুরো গ্রাম আগুনে পুড়ে ছাই। বহুলোক- যারা পালাতে পারে নি মরে পড়ে আছে। গরু, ছাগল মরে ফুলে ঢোল হয়ে আছে। দুর্গন্ধে টেকা যায় না। সে যে কি বীভৎস দুশ্য।”
রসুল সাহেব দম নেবার জন্য থামতেই আমি বলে উঠলাম, “তারপর কি আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ফিরে এলেন?”
“না, ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর তার আশপাশে তখনো প্রায় রোজই বম্বিং হচ্ছিল। আমরা অন্যদিক দিয়ে অন্য একটা গ্রামে চলে গেলাম। সেখানেও শান্তি নেই। মিলিটারির তাড়া।”
“আপনার ফ্যামিলি কোথায়?”
অনেক কষ্টে সবসুদ্ধ ঢাকায় এসে পৌছেছি। ভূতের গলিতে আমার এক আত্মীয় আছেন, তাঁর বাড়িতে উঠেছি। গ্রামে দৌড়ে পালাতে গিয়ে সালেহার পায়ের তলায় হাড়ের টুকরো ফুটেছিল। প্রথমে কেউ খেয়াল করি নি, একটু আধটু ব্যথা করত। খেয়াল করব কি করে? সে সময়টুকু ছিল নাকি? একটু চুন-হলুদ দিয়ে বেঁধে রাখলেই ভালো হয়ে যেত, সেটাই বা কে করে! এখন ফুলে-পেকে যা-তা অবস্থা হয়েছে।
আমি ব্যস্ত হয়ে উঠলাম, “সর্বনাশ । ডাক্তার দেখিয়েছেন ?”
“সেই জন্যই আপনার কাছে এসেছি। সালেহা বলল বড় আপার কাছে যাও। উনার সঙ্গে অনেক ডাক্তারের চেনাজানা আছে।”
“আমাদের পাড়াতেই ভালো সার্জন আছেন। মেইন রোড ধরে পূর্বদিকে খানিক গেলেই পলি ক্লিনিক, ওখানে ডাঃ আজিজ আমার চেনা, খুব ভালো সার্জন।”
তখুনি ফোনে আজিজের সাথে কথা বলে রসুলকে বলণীম, "আজিজ ক্লিনিকেই আছে। এক্ষুণি পেসেন্টকে নিয়ে যেতে বলল। আপনি সালেহাকে নিয়ে যান। আমি আধঘন্টা পরে ক্লিনিকে যাচ্ছি। এখন যাবার সময় ডানদিকে তাকাতে তাকাতে যাবেন পলি ক্লিনিকের সাইনবোর্ড চোখে পড়বে।"
আধঘন্টা পরে পলি ক্লিনিকে গিয়ে দেখি রসুলরা তখনো এসে পৌছায় নি। ডাঃ আজিজের ন্ত্রী সুলতানাও ডাক্তার। পাশাপাশি দুটো বাড়ি ভাড়া নিয়ে ওরা এই ক্লিনিক করেছে। একটা বাড়ির নিচে এমার্জেন্সি, অপারেশন থিয়েটার, দোতলায় রুগীদের কেবিন। পাশের বাড়ির দোতলায় ওরা নিজেরা থাকে, নিচে রুগীর কেবিন।
সুলতানা-আজিজ দু’জনেই খুব হাসিখুশি, সবসময় চারপাশটা মাতিয়ে রাখতে পারে। ক্র্যাকডাউনের পর কয়েকটা দিন স্তম্ভিত, হতবাক হয়েছিল। মাঝখানে বেশ কয়েকদিন দেখা হয় নি। আজ দেখলাম, আগের মতই। বললাম, “কি খুব যে হাসিখুশি মনে হচ্ছে।”
সুলতানা হিহি করে হেসে বলল, “হ্যাঁ বুবু, প্রথম ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠেছি। আমরা ডাক্তার তো, গোলায় নিজের পা উড়ে গেলেও যদি হাত দুটো ঠিক খাকে, তাহলে ওই অবস্থাতেই আরেকজনের ঢ্রিটমেন্ট করতে হয়। আর এখন তো ক্যাজুয়ালিটির সংখ্যা অনেক বেশি, গোপনে ট্রিটমেন্ট করার টেনসানও বেশি, তাই চাঙ্গা থাকার জন্যই হাসতে হয়।”
সুলতানা অবশ্য এমনিতেই হাসে বেশি। সেজন্য ওকে আমরা আদর করে পাগলি বলি। সে আমার হাত ধরে পাশের বাড়িটায় নিয়ে গেল। এটার দোতলায় ওরা থাকে। গেটটা এক পাশে। গেট বরাবর পোর্চ পেরিয়ে সোজা এগিয়ে গ্যারেজ- পাশের ও পেছনের বাউন্ডারি ওয়াল ঘেঁষে। সুলতানা নিজের হাতে গ্যারেজের দরজা খুলে দিতেই দেখা গেল ভেতরে একটা গাড়ি। গাড়ির পাশ দিয়ে পেছনে নিয়ে গেল আমায়। দেখলাম মেঝের কাছাকাছি দেয়াল ভেঙে একহাত বাই দেড় হাত একটা ফোকর। বাড়ির দিকে গ্যারেজের যে দেয়াল, তাতে একহাত চওড়া একটা কাঠের দরজা। অর্থাৎ মেইন বাড়ির যে খিড়কি দরজাটা এ পাশে আছে, সেটা দিয়ে বেরিয়ে এই ছোট দরজাটা দিয়ে গ্যারেজে ঢুকে ওই ফোকর দিয়ে পালিয়ে যাওয়া খুবই সহজ বাড়ির সামনে মেইন গেটের কাছে দাঁড়ানো লোকজন মোটেই টের পাবে না।
আকাশের বুকেও অনেক ব্যাথা। তার কিন্তু আমার মতো চেপে রাখার দায় নেই। তাই সেও ক’দিন থেকে মাঝে-মাঝে অঝোরে ঝরাচ্ছে। না জানি রুমীদের কি কষ্ট হচ্ছে এই বৃষ্টিতে।
জামীও আবদার ধরেছিল সে রুমীর সঙ্গে যাবে। তাকে অনেক করে বুঝিয়েছি, দু’ভাই একসঙ্গে গেলে পাড়ার লোকে সন্দেহ করবে। সবচেয়ে বড় কথা বাবাকে কি কৈফিয়ত দেব? ওঁকে তো কিছুতেই বলা চলবে না মুক্তিযুদ্ধের কথা। তাহলে উদ্বেগে, উত্তেজনায় ব্লাড প্রেসার বেড়ে স্ট্রোক হয়ে যাবে। তাছাড়া আমিই বা থাকব কি করে?
কাল সারারাত ঘুম হয় নি। সারারাত জোরে জোরে মাইকে হামদ, নাত, দরুদ, মিলাদ, মওলানা সাহেবদের ওয়াজ-নসিহত এসব শোনা গেছে। এ বছর ঈদ-ই- মিলাদুন্নবী অনেক বেশি শান-শওকত ধুম-ধড়াক্কার সঙ্গে পালিত হচ্ছে। চার-পাঁচদিন আগে খেকে খবরের কাগজ, রেডিও-টিভিতে ঢোল-শোহরতের কি ঘটা! ইসলামকে পুরো গলা কেটে জবাই করে এখন তাকে জোড়া লাগানোর চেষ্টা!
সকালে উঠে চোখ করকর করছিল, শরীরও ম্যাজম্যাজ। ভাবলাম গোসল করলে ঝরঝরে লাগবে। গোসল করে নাশতা খেয়েও স্বস্তি লাগছে না। শরীফ বলল, “বিষ্টি নেই, চল লিলিবুদের বাড়ি যাই। ওখান থেকে নারিন্দা।”
কোথাও বেরোতে ইচ্ছে করে না, আবার ঘরে বসে থাকলেও ফাঁপর লাগে। তাই জোর করেই বেরিয়ে পড়লাম। ঠিক আছে, সব আত্মীয়স্বজনের বাড়িতেই বেড়াব আজ। লিলিবুদের বাসায় খানিক বসে লিলিবু ও একরাম ভাইকে সঙ্গে নিয়ে নারিন্দায় গেলাম আতাভাইদের বাসায়। ওখান থেকে কাছেই নওয়াব স্ট্রিটে খোকাদের বাসায়। গিয়ে দেখি খোকার বোন আনা তার সামী পুত্র শাশুড়িসহ এ বাড়িতে। আনাদের বাড়িও কাছেই- ক্যাপ্টেন বাজারে। ওদের বাড়ির পেছনে বিহারিদের বস্তি। সামনে রেললাইন পেরিয়ে আওয়ামী লীগের অফিস। ২৫ মার্চ রাতে আওয়ামী লীগের অফিস আউনে পোড়ানো হয়। ২৭ তারিখ সকালে কারফিউ উঠলে আনারা ভাইয়ের বাসায় চলে আসে। খোকা ও আনার বড় বোন মীরা আমার চাচাত দেবর আনুর স্ত্রী। আনু ও মীরা এখন করাচিতে রয়েছে। ওদের জন্যেও খোকারা সবাই খুব উদ্বিগ্ন, বিশেষ করে খোকার আম্মা। খানিকক্ষণ পরস্পরের জানা খবর বিনিময় করে আমরা উঠলাম। ফেরার পথে একরাম ভাই বললেন, “মকু মিয়ার বাড়ি চল ক্যানে একবার? ভিখুর ছেলেমেয়েরা, মা, বোন সবাই ফিরেছে শুনলাম। দেখে আসি।”
আমি বললাম, “ভিখুর ছেলে রুবেল ফেরে নি। ও নাকি আগেই রাজশাহী দিয়ে ইন্ডিয়া চলে গেছে। ভিখুর দুই মেয়ে লীরা, ইয়েন মকু মিয়ার বাড়িতে আছে। বুলু, তার মাও আছে।”
মকু চৌধুরীর বাড়ি গিয়ে বুলুর দেখা পেলাম না; ও আজ ভোরের প্লেনে পোল্যান্ডের পথে করাচি রওনা হয়ে গেছে। তবে আরো অনেক আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা হলো -তনজিম, তার বউ ডলি, বুলুর ছোট বোন গুলু অর্থাৎ মওদুদা। তনজিম, ডলি, ণ্ডলুর মুখেও খানসেনাদের বিভিন্ন জায়গার বিভিন্ন রকমের নিষ্ঠুরতার কাহিনী শুনলাম। এ ছাড়া অন্য কোন কথা নেই কারো মুখে। কানু ছাড়া গীত নেই।
বাসায় ফিরে ঘরে পা দিয়েই চমকে গেলাম। বসার ঘরে সোফায় বসে এক রোগাপাতলা লোক, চুলদাড়ি সব সাদা, গর্তে ঢোকা চোখ, কপালে গভীর ভাঁজ। চিনতে না পেরে তাকিয়ে রইলাম। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “সালাম আলায়কুম, আমি রসুল। চিনতে পারেন নি, না?”
লজ্জিত হেসে বললাম, “ওয়ালায়কুম সালাম। কি করে চিনব! এত রোগা হয়ে গেছেন! চুলদাড়ি সাদা হলো কি করে? বসুন।”
রসুল সাহেব আমার এক ছাত্রীর স্বামী। ছাত্রী মানে সেই ১৯৫২ সালে আমি যখন প্রথম সিদ্ধেশ্বরী স্কুলে চাকরি করতে যাই, সেই বছরের ক্লাস টেনের ছাত্রী। মাত্র বছরখানেক পেয়েছিলাম তাকে, তাতেই পরবর্তী সময়ে যখনই তার সঙ্গে দেখা হয়েছে, আমাদের ‘বড় আপা’ বলে উচ্ছ্বসিত হয়েছে। বিয়ের পরে স্বামীকে সঙ্গে এনে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। রসুল সাহেব সরকারি চাকুরে। বদলির চাকরি। বিভিন্ন জেলায় ঘুরে বেড়ান। যখনি ঢাকা আসেন, একবার আমাদের বাসায় আসবেনই। ধর্মভীরু পরহেজগার মানুষ। কালো চাপদাড়ি, মাথায় কালো জিন্না টুপি- এইভাবে তাঁকে দেখে আসছি গত পনের-ষোল বছর ধরে। সেই মানুষের একি চেহারা হয়েছে!
আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, "বয়েস হয়েছে, একটু-আধটু পাক ধরেছিল আগেই, কিন্তু গত দেড় মাসে হঠাৎ সব সাদা হয়ে গেল ভয়ে, দুর্ভাবনায়, ছুটোছুটিতে।"
আমি বারেককে চা’র কথা বলে এসে বললাম, "বলুন তো কি ব্যাপার? এবার প্রায় চার বছর পর এলেন। কোথায় পোস্টেড ছিলেন? কিভাবে কাটালেন এই দেড় মাস?"
“ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বদলি হয়েছিলাম মাত্র ছ’মাস আগে। ভালোই ছিলাম। ক্র্যাকডাউনের পরেও ওখানেই ছিলাম। প্রথম কিছুদিন এলাকাটা জয় বাংলার দখলেই ছিল। তারপর যখন প্লেন থেকে বোমা ফেলা শুরু হলো, তখন জানের ভয়ে সব ফেলে বউ- ছেলেমেয়ের হাত ধরে গ্রামের দিকে পালিয়েছিলাম। সে যে কি কষ্ট। কোন একটা গ্রামে থিতু হয়ে থাকতে পারি নি। আমার বাড়ি উত্তরবঙ্গে। এদিকের কোন গ্রামে কোন আত্মীয়স্বজন, চেনাজানা কেউ নেই। কিন্তু গ্রামের লোকেরা এত ভালো ব্যবহার করেছিল যে কি বলব। খেতে দিয়েছে, শুতে দিয়েছে। কিন্তু হলে কি হবে, পাকিস্তান আর্মি যেভাবে গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিচ্ছিল, তাতে ওরা নিজেরাই একগ্রাম ছেড়ে আরেক গ্রামে দৌড়াচ্ছিল, সেই সাথে আমরাও।”
শরীফ জিগ্যেস করল, “আচ্ছা, কোন সময় বম্বিং করে, মনে আছে?”
“মার্চের শেষে হবে। তারিখ ঠিক মনে নেই।”
শরীফ বলল, "ওই সময় আমরা প্রায় প্রায়ই দেখতাম বম্বার প্লেনগুলো এদিক-ওদিক উড়ে যাচ্ছে। ঘরে বসে বুঝতে পারতাম না, কিন্তু সন্দেহ করতাম- যেসব এলাকা তখনো জয়বাংলার দখলে রয়েছে, সেইসব এলাকায় বোমা ফেলতে যাচ্ছে। আচ্ছা, আপনি কি বলতে পারবেন ওই অঞ্চলে কি রকম যুদ্ধ হয়েছিল?"
রসুল মাথা নেড়ে বলল, “না। আমাদের বাড়িটা যে পাড়ায় ছিল, সেখানে বোমা পড়ে নি, তবে কাছেই বোমা পড়েছে, বিকট শব্দ, লোকজনের ঢিৎকার শুনেছি, আগুন দেখেছি। আর তখুনি একবস্ত্রে ছুটে পালিয়েছি পাশের এক গ্রামে। কিন্তু সেখানে একরাত থাকার পরই শুনলাম মিলিটারি আসছে। যাদের বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিলাম তারাসুদ্ধ পালালাম। দু’দিন পরে ফিরে এসে দেখি- পুরো গ্রাম আগুনে পুড়ে ছাই। বহুলোক- যারা পালাতে পারে নি মরে পড়ে আছে। গরু, ছাগল মরে ফুলে ঢোল হয়ে আছে। দুর্গন্ধে টেকা যায় না। সে যে কি বীভৎস দুশ্য।”
রসুল সাহেব দম নেবার জন্য থামতেই আমি বলে উঠলাম, “তারপর কি আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ফিরে এলেন?”
“না, ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর তার আশপাশে তখনো প্রায় রোজই বম্বিং হচ্ছিল। আমরা অন্যদিক দিয়ে অন্য একটা গ্রামে চলে গেলাম। সেখানেও শান্তি নেই। মিলিটারির তাড়া।”
“আপনার ফ্যামিলি কোথায়?”
অনেক কষ্টে সবসুদ্ধ ঢাকায় এসে পৌছেছি। ভূতের গলিতে আমার এক আত্মীয় আছেন, তাঁর বাড়িতে উঠেছি। গ্রামে দৌড়ে পালাতে গিয়ে সালেহার পায়ের তলায় হাড়ের টুকরো ফুটেছিল। প্রথমে কেউ খেয়াল করি নি, একটু আধটু ব্যথা করত। খেয়াল করব কি করে? সে সময়টুকু ছিল নাকি? একটু চুন-হলুদ দিয়ে বেঁধে রাখলেই ভালো হয়ে যেত, সেটাই বা কে করে! এখন ফুলে-পেকে যা-তা অবস্থা হয়েছে।
আমি ব্যস্ত হয়ে উঠলাম, “সর্বনাশ । ডাক্তার দেখিয়েছেন ?”
“সেই জন্যই আপনার কাছে এসেছি। সালেহা বলল বড় আপার কাছে যাও। উনার সঙ্গে অনেক ডাক্তারের চেনাজানা আছে।”
“আমাদের পাড়াতেই ভালো সার্জন আছেন। মেইন রোড ধরে পূর্বদিকে খানিক গেলেই পলি ক্লিনিক, ওখানে ডাঃ আজিজ আমার চেনা, খুব ভালো সার্জন।”
তখুনি ফোনে আজিজের সাথে কথা বলে রসুলকে বলণীম, "আজিজ ক্লিনিকেই আছে। এক্ষুণি পেসেন্টকে নিয়ে যেতে বলল। আপনি সালেহাকে নিয়ে যান। আমি আধঘন্টা পরে ক্লিনিকে যাচ্ছি। এখন যাবার সময় ডানদিকে তাকাতে তাকাতে যাবেন পলি ক্লিনিকের সাইনবোর্ড চোখে পড়বে।"
আধঘন্টা পরে পলি ক্লিনিকে গিয়ে দেখি রসুলরা তখনো এসে পৌছায় নি। ডাঃ আজিজের ন্ত্রী সুলতানাও ডাক্তার। পাশাপাশি দুটো বাড়ি ভাড়া নিয়ে ওরা এই ক্লিনিক করেছে। একটা বাড়ির নিচে এমার্জেন্সি, অপারেশন থিয়েটার, দোতলায় রুগীদের কেবিন। পাশের বাড়ির দোতলায় ওরা নিজেরা থাকে, নিচে রুগীর কেবিন।
সুলতানা-আজিজ দু’জনেই খুব হাসিখুশি, সবসময় চারপাশটা মাতিয়ে রাখতে পারে। ক্র্যাকডাউনের পর কয়েকটা দিন স্তম্ভিত, হতবাক হয়েছিল। মাঝখানে বেশ কয়েকদিন দেখা হয় নি। আজ দেখলাম, আগের মতই। বললাম, “কি খুব যে হাসিখুশি মনে হচ্ছে।”
সুলতানা হিহি করে হেসে বলল, “হ্যাঁ বুবু, প্রথম ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠেছি। আমরা ডাক্তার তো, গোলায় নিজের পা উড়ে গেলেও যদি হাত দুটো ঠিক খাকে, তাহলে ওই অবস্থাতেই আরেকজনের ঢ্রিটমেন্ট করতে হয়। আর এখন তো ক্যাজুয়ালিটির সংখ্যা অনেক বেশি, গোপনে ট্রিটমেন্ট করার টেনসানও বেশি, তাই চাঙ্গা থাকার জন্যই হাসতে হয়।”
সুলতানা অবশ্য এমনিতেই হাসে বেশি। সেজন্য ওকে আমরা আদর করে পাগলি বলি। সে আমার হাত ধরে পাশের বাড়িটায় নিয়ে গেল। এটার দোতলায় ওরা থাকে। গেটটা এক পাশে। গেট বরাবর পোর্চ পেরিয়ে সোজা এগিয়ে গ্যারেজ- পাশের ও পেছনের বাউন্ডারি ওয়াল ঘেঁষে। সুলতানা নিজের হাতে গ্যারেজের দরজা খুলে দিতেই দেখা গেল ভেতরে একটা গাড়ি। গাড়ির পাশ দিয়ে পেছনে নিয়ে গেল আমায়। দেখলাম মেঝের কাছাকাছি দেয়াল ভেঙে একহাত বাই দেড় হাত একটা ফোকর। বাড়ির দিকে গ্যারেজের যে দেয়াল, তাতে একহাত চওড়া একটা কাঠের দরজা। অর্থাৎ মেইন বাড়ির যে খিড়কি দরজাটা এ পাশে আছে, সেটা দিয়ে বেরিয়ে এই ছোট দরজাটা দিয়ে গ্যারেজে ঢুকে ওই ফোকর দিয়ে পালিয়ে যাওয়া খুবই সহজ বাড়ির সামনে মেইন গেটের কাছে দাঁড়ানো লোকজন মোটেই টের পাবে না।
আজিজ ধমক দিল, “এত কথা বল কেন?” সূলতানা আগের মতই হাসতে হাসতে আমার হাত ধরে আবার মেইন ক্লিনিকে চলল।
একটু পরেই সালেহাকে নিয়ে রসুল পৌছে গেল। আমাকে দেখে সালেহা কান্নায় ভেঙে পড়ল, “বড় আপা গো, আমাদের সব গেছে। ফকির হয়ে গেছি । মরে গেছি একেবারে।”
সুলতানা হৈ-হৈ করে উঠল, “আরে আরে! কাঁদে কেন? কান্নার কি হয়েছে? হাসুন, হাসুন, হাসলে আদ্দেক অসুখ সেরে যাবে। আসুন আগে একজামিন করি। দেখি কত তাড়াতাড়ি সারানো যায় আপনাকে।”
সালেহাকে ভর্তি করতে হলো ক্লিনিকে। ওকে বেডে উইয়ে ওর পাশে বসে রইলাম, রসুল আবার বাসায় গেল সালেহার কয়েকটা জিনিসপত্র আনতে। সালেহা আমার হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “বড় আপা, খানসেনারা কি মানুষ নয়? ওরা কি মুসলমান নয়? হিন্দু খুঁজে খুঁজে মেরেছে তো বটেই, কলমা জানা মুসলমানকে পর্যন্ত ওরা কাফের মনে করে মেরেছে। বড় আপা, বাড়িঘর, জিনিসপত্র, সব ফেলে পালিয়ে এসেছি। পা পচে গেছে। আমি আর বাঁচব না। বড় আপা, আমি মরে গেলে কে আমার বাচ্চাগুলোকে দেখবে?”
রুবেল, লীলা, ইয়েনের কথা মনে হয়ে আমার বুকে কান্না উথলে উঠল। বললাম, “সালেহা আল্লার কাছে হাজার শুকুর কর তোমার পরিবারের সবাই বেঁচে আছে। তোমাদের কারো গায়ে আর্মির গুলি লাগে নি। তুমি খুব ভাগ্যবতী, তাই তোমার পায়ে হাড় বিধেছে, আর্মির গুলি বেঁধে নি। সামান্য একটু অপারেশন করে তোমার পা ভালো হয়ে যাবে দু’চারদিনে। জিনিসপত্র গেছে, তার জন্য এত শোক কেন? জিনিসপত্র, টাকাপয়সা আবার হবে। জান যদি চলে যেত। তাহলে আর কি জান ফিরে পেতে?”
ওকে ভিখু, মিলি ও তাদের তিনটি নাবালক বাচ্চার কথা বললাম। শুনে সালেহা আরেক দফা কাঁদল, তারপর বলল, “না বড় আপা আমার আর কোন দুঃখ নেই।”
- শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বই থেকে
Post a Comment Blogger Facebook