image

image
 

A+ A-
Voice of 71 Voice of 71 Author
Title: একাত্তরের দিনগুলি: ২৩ মে, ১৯৭১
Author: Voice of 71
Rating 5 of 5 Des:
দেশের অন্যান্য জেলা থেকে ঢাকায় আসা লোকদের সঙ্গে যত বেশি দেখা-সাক্ষাৎ হচ্ছে, তত বেশি বেশি খারাপ খবর শুনতে পাচ্ছি। মেয়েদের অপমান ও অত্য...
দেশের অন্যান্য জেলা থেকে ঢাকায় আসা লোকদের সঙ্গে যত বেশি দেখা-সাক্ষাৎ হচ্ছে, তত বেশি বেশি খারাপ খবর শুনতে পাচ্ছি। মেয়েদের অপমান ও অত্যাচারের কথা, বিশেষ করে বাপ, ভাই, স্বামী বা ছেলের সামনে তাদের বেইজ্জতি করে মেরে ফেলার কথা প্রায়ই কানে আসত। এখন আরো বেশি করে তাদের অপহরণের কথা শোনা যাচ্ছে।

এখন আরো বেশি পাকিস্তানি সৈন্য ও বিহারি তাঁবেদাররা যখন-তখন লোকের বাড়িতে ঢুকে টাকা-পয়সা, সোনাদানা লুটেপুটে নিচ্ছে। দোকানপাটে ঢুকেও যেটা খুশি তুলে নিয়ে যাচ্ছে। কাজণ্ডলো, লোকমা তুলে ভাত মুখে দেওয়ার চেয়েও সহজ। যেকোন বাড়িতে ঢুকে রাইফেল উঁচিয়ে সবাইকে সার বেঁধে দাঁড় করালেই হলো। গুলি খরচ না করলেও চলে, মারারও দরকার হয় না। ভয়ের চোটেই টাকা-পয়সা, সোনাদানা সবাই বের করে দিয়ে দেয়। অনেক বাড়িতে গৃহস্থ নিজেই টাকা-পয়সা, সোনাদানা আগ বাড়িয়ে বের করে দেয়- এইনাও সব দিচ্ছি, জানে মেরো না। আজকাল ওরা নিজেও একটু কম জানে মারছে, টাকা-পয়সা, গয়নাগাটি নিয়ে চলে যাচ্ছে। ঢাকাতেও কোন কোন অঞ্চলে এগুলো নাকি হচ্ছে। যদিও আমাদের চেনাজানার মধ্যে কারো এখনো হয় নি।

আমার গহনাগাটি বেশি নেই কিন্তু যেটুকু আছে, সেটুকু গেলে আর তো কোনদিন করতে পারব না। মা'ও উদ্বিগ্ন, তাঁর গহনাপত্রগুলো রেখেছেন দুই ছেলের বউকে দেবার জন্য। ছেলেরা বিদেশে- কবে দেশে আসবে আর বিয়ে করবে, তার ঠিক নেই। তবু গহনাগুলো রক্ষা করার ব্যবস্থা তো করা দরকার।

অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম উঠোনে গর্ত করে পুঁতে রাখব। তবে শুনেছি- ওরা অনেক বাড়ির উঠোন খুঁড়ে দেখে। গ্রামে নাকি কাঁচাঘরের মেঝে পর্যন্ত খুঁড়ে দেখে। তাহলে?

রুমী বলল, "জিনিসণ্ডলো পুঁতে তার ওপর একটা লেবুগাছ লাগিয়ে দাও। তবে ছোট গাছ লাগালে ওরা সন্দেহ করতে পারে। বেশ একটা বড় গাছ আনতে হবে। দেখে যেন মনে হয় দু-তিন বছরের পুরনো গাছ।"

"বড় গাছ তূলে আনলে কি বাঁচবে?"

"চারপাশে অনেক বেশি মাটি নিয়ে খুঁড়ে তুলতে হবে যাতে শেকড় কাটা না যায়।"

তাই ঠিক হলো। শরীফের জানাশোনা এক নার্সারী থেকে বড় একটা লেবুগাছ আনানোর ব্যবস্থা করা হলো।

আমি বললাম, "চল, মা'র বাসায় যাই। গহনা রাখার বন্দোবস্ত হয়েছে, বলে আসি।"

মা'র বাসা যেতেই দেখি উনি বাইরে যাবার জন্য রওনা হচ্ছেন। কি ব্যাপার? খবর এসেছে রাজশাহীতে তারার ভাইকে বিহারিরা মেরে ফেলেছে। তারা মায়ের মামাতো ভাইয়ের মেয়ে, আসাদ গেটের কাছে নিউ কলোনিতে থাকে। বললাম, "চলুন আপনাকে তারার বাসায় নামিয়ে দিই। আমরাও একটু দেখা করে আসি ওদের সঙ্গে।"

নিউ কলোনিতে আমরা একটুক্ষণ বসে রইলাম। মা এখন খানিকক্ষণ ও বাড়িতে থাকবেন। ওখান থেকে গেলাম রাজারবাগ এলাকায় আউটার সার্কুলার রোডে মান্নান ও নূরজাহানের বাড়ি। ইঞ্জিনিয়ার মান্নান শরীফের বন্ধু ও সহকর্মী। ক্র্যাকডাউনের আগে মান্নানের চাচাতো ভাইয়ের বিয়েতে চাটগাঁ গিয়ে ওরা ছেলেমেয়ে সুদ্ধ সবাই আটকা পড়েছিল। সপ্তাহখানেক হলো ঢাকা ফিরেছে। ওদের বাসায় গিয়ে নূরজাহান আর মান্নানের মুখে শুনলাম ওদের জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু লোমহর্ষক কাহিনী।

চাটগাঁর ও. আর. নিজাম রোডে ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের অফিস ও রেস্ট হাউস। মান্নানরা সপরিবারে ওখানেই ছিলেন। ২৬ মার্চ সকালে বাইরোডে গাড়িতে ওদের ঢাকার পথে রওয়ানা হবার কথা। কিন্তু ২৫ মার্চ রাতে মান্নানের বন্ধু আরেক ইঞ্জিনিয়ার জামান সাহেব ফোনে ঢাকায় তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ঢাকার গোলমালের কথা জানতে পারেন। পরে আরো এঁর-ওঁর কাছ থেকে খবর পেয়ে ওরা ক্র্যাকডাউনের ব্যাপারটা বুঝতে পারেন । ফলে ওরা চাটগাঁতেই থেকে যেতে বাধ্য হলেন। ২৬ ও ২৭ মার্চ অবশ্য মান্নানরা চাটগাঁতে রাস্তায় বেরোতে পেরেছিলেন, যদিও ২৬ মার্চ রাতে ক্যান্টনমেন্ট থেকে ছোড়া ট্রেসার হাউইয়ের আলো দেখতে পেয়েছিলেন এবং গোলাগুলির শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন। ক্যান্টনমেন্টটা ওদের রেস্ট হাউস থেকে বেশিদূরে ছিল না। ২৮ তারিখ সকালে বাধল বিপত্তি। রেস্ট হাউসের পেছনে প্রবর্তক সংঘের পাহাড়, সামনে পুলিশ লাইনের পাহাড়। ওই দিন সকালে হঠাৎ প্রবর্তক সংঘের পাহাড়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা পজিশন নিয়ে পুলিশ লাইনের দিকে গুলিগোলা ছুঁড়তে শুরু করে। পুলিশরাও ওদের দিকে গুলিগোলা ছুঁড়তে থাকে। নূরজাহান বলল, "সে যে কি অবস্থা আপা। রেস্ট হাউসের মাথার ওপর দিয়ে সামনে গুলিগোলা ছুটে যাচ্ছে। ভাবলাম, আর রক্ষে নেই। এইবার শেষ। ছুটে সবাই দোতলা থেকে নেমে নীচের অফিস ঘরের মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে রইলাম। মাঝে-মাঝে উঠে ঘুলঘুলি দিয়ে উঁকি মেরে দেখি। বেলা দুটো পর্যন্ত এই রকম চলল। দুটোর পর মাথার ওপর দিয়ে গুলি করছে। তখন মনে হলো, আমাদের বাড়িতে নিশ্চয় আসবে, আর গুলি ছোটা বন্ধ হল। তারপর শব্দ শুনে মনে হলো খানসেনারা পাহাড় থেকে নেমে বাড়ি বাড়ি ধাক্কা দিয়ে দরজা ভেঙ্গে সব গুলি করে মারবে। শেষ পর্যন্ত কপাল ভাল, ওরা আর আসেনি। তিনটের দিকে সব শান্ত হতে আমরা ঠিক করলাম, এখানে আর নয়। যে করেই হোক, নন্দনকাননে বাঁকা সাহেবের বাড়িতে গিয়ে উঠতে হবে। সদর রাস্তা দিয়ে যাওয়া রিস্কি, তাই ঠিক করলাম ডানদিকে এলিট পেইন্টের মালিকের বাড়ির পাশ দিয়ে যে গলি রাস্তা আছে, ওই দিক দিয়ে লুকিয়ে-ছাপিয়ে যেতে হবে। খানিক দূরে যেতেই একটা বাড়িতে দেখি এক দম্পতি বারান্দায় দাঁড়িয়ে। আমাদেরকে দেখে গলিতে নেমে এলেন। আমরা এদিক দিয়ে নন্দনকানন যাবার চেষ্টা করছি শুনে বললেন, পাগল হয়েছেন! নন্দনকানন পর্যন্ত পৌছতেই পারবেন না। পাকসেনারা সব জায়গায় টহল দিচ্ছে। একবার দেখতে পেলে আর রক্ষে নেই। তার চেয়ে আমাদের বাসায় থাকুন। সম্পূর্ণ অপরিচিত এক দম্পতির এই রকম আন্তরিক ব্যবহারে খুব মুগ্ধ হলাম। পরে জেনেছিলাম ভদ্রলোকের নাম আবদুল হাই। আমাদের জোবেদা খানম আপার ভাই।

"ওদের বাসায় ৪/৫ দিন ছিলাম। তারপর ৩০ তারিখ দুপুরের পর বম্বিং হলো- আমরাও বাসার জানালা দিয়ে দুরের আকাশে পরিষ্কার প্লেনগুলো দেখতে পেলাম। ওদের বাসায় ৪/৫ দিন থাকার পর আবার আমরা রেস্ট হাউসেই ফিরে গেলাম।"

"স্বাধীন বাংলা বেতার শুনতে পেয়েছিলে? প্রথম কবে শুনেছিলে?"

"২৬ তারিখ রাতেই। জামান সাহেবের রেডিও ছিল, উনি ঘোরাতে ঘোরাতে হঠাৎ পেয়ে যান। তারপর রোজই শুনতাম। আমাদের ঘরে বসে থাকা ছাড়া আর তো কোন কাজ ছিল না, তাই রেডিওটাই শোনা হত বেশি। আকাশবাণী, বিবিসি, রেডিও অস্ট্রেলিয়া, স্বাধীন বাংলা বেতার- সবই শুনতাম। তবে ৩০ তারিখে বম্বিংয়ের পর তিন-চারদিন স্বাধীন বাংলা বেতার শুনতে পাই নি। তারপর যখন চাটগাঁ-ঢাকা প্লেন সার্ভিস শুরু হলো, তখন প্লেনে সিট পাবার চেষ্টা করতে লাগলাম। দু'সপ্তাহ পরে সিট পেয়ে এইতো গেল সপ্তাহে ঢাকা এসেছি। এই দু'সপ্তাহ কি করতাম জানেন? সকালে কারফিউ উঠলে নাশতা খেয়েই ছেলেমেয়ে, বোঁচকাবুঁচকি নিয়ে এয়ারপোর্ট যেতাম, ফিরতাম বিকেলে কারফিউ শুরু হবার আগ দিয়ে।"

"বল কি? দুপুরের খাওয়া-দাওয়া?"

"প্রথমদিনের পর থেকে স্যান্ডউইচ, ফ্লাস্কে চা, পানি এসব নিয়ে যেতাম।"

"কেন সারাদিন বসে থাকতে হত কেন?"

"প্লেনে মিলিটারির লোকজন আগে সিট পেত। অল্প ক'টা সিট সিভিলিয়ানদের দেয়া হত। এয়ারপোর্টে গিয়ে লাইন করে দাঁড়াতে হত। কবে ক'টা সিট সিভিলিয়ানদের দেবে, তার কোন স্থিরতা ছিল না । আর লাইন ছিল লম্বা।"

পতেঙ্গা এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে বসে বসে অপেক্ষা করার সময় একটা সাংঘাতিক দৃশ্য নূরহাজান এবং নিশ্চয় বাকি সবারও চোখে পড়ত। সবাই সেটা না দেখারই ভান করত। এখন বলতে নূরজাহান শিউরে উঠল, "একদিন হঠাৎ দেখি কি বেশ দূরে একটা দোতলা বিল্ডিংয়ের সামনে ট্রাক থেকে লোক নেমে লাইন করে ভেতরে ঢুকছে। ট্রাকের সামনে মেশিনগান হাতে মিলিটারি দাঁড়িয়ে। দোতলার জানালা খোলা ছিল। জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম ঘরের ভেতরে খানসেনারা চাবুক দিয়ে লোকগুলোকে মারছে।"

"বল কি! চিৎকার শুনতে পেতে?"

"না, বিন্ডিংগুলো বেশি দূরে ছিল। তবে মাঝখানটা ফাঁকা মাঠ বলে দেখা যেত। ঘরের মধ্যে জানালাগুলো ওরা বন্ধ করে নেয়াও দরকার মনে করত না। দিনের বেলা রোদের আলোতে এত দূর থেকেও ঘরের ভেতরের সব দেখা যেত। দূর বলে চিৎকার শুনতে পাইনি, তবে চাবুকের ওঠানামা বুঝতে পারতাম।"

"রোজ রোজ ট্রাকে করে লোক নিয়ে আসত?"

"যে কয়দিন এয়ারপোর্টে বসে থেকেছি, প্রায় রোজই দেখেছি। যা ভয় লাগত আপা, গায়ের লোম খাড়া হয়ে যেত ভয়ে। কিন্তু কি করব, না দেখার ভান করে বসে থাকতাম। আবার ওদিকে না তাকিয়েও পারতাম না।"

- শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বই থেকে

About Author

Advertisement

Post a Comment Blogger

Emoticon
:) :)) ;(( :-) =)) ;( ;-( :d :-d @-) :p :o :>) (o) [-( :-? (p) :-s (m) 8-) :-t :-b b-( :-# =p~ $-) (b) (f) x-) (k) (h) (c) cheer
Click to see the code!
To insert emoticon you must added at least one space before the code.

 
Top
Chat here...