![]() |
ধানমন্ডি ১৩ নম্বর রোডে মকু অর্থাৎ মাহবুবুল হক চৌধুরীর বাড়ি। ভিখু চৌধুরীর বড় ভাই। পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রাক্তন ল’ সেক্রেটারি। ভিখুর বোন, মা ও মেয়েরা করটিয়া থেকে ফিরে এসেছে কয়েকদিন হল। দেখা করতে গেলাম ওদের সঙ্গে। বজ্রাহতের মতো বসে আছে সবাই। কেবল খালাম্মা অর্থাৎ ভিখুর মা কথা বলছেন, মাঝে-মাঝে কাঁদছেন। ভিখুর বোন বুলু অর্থাৎ মাসুদার স্বামী শরফুল আলম পোলান্ডে পাকিস্তান দূতাবাসে রয়েছেন। বুলু ছুটিতে দেশে বেড়াতে এসে এই কান্ড। তার ডান কাঁধের নিচে গুলি লেগেছিল। ভিখুর মা’র মুখে পুরো ঘটনাটা শুনলাম।
ওদের বিরাট একটা দল ঢাকা থেকে গ্রামের দিকে যাচ্ছিল। করটিয়ায় জাহাঙ্গীরের (ইঞ্জিনিয়ার নূরুর রহমানের ডাক নাম) ফুফার বাড়িতে আশ্রয় নেবার পর এই দুর্ঘটনা ঘটে। সকালবেলা নাশতা তৈরি হচ্ছিল। ঘুম থেকে উঠে সবাই মুখ-হাত ধুচ্ছিল, এমন সময় পাক আর্মি এসে সে বাড়ি ঘেরাও করে গুলি চালাতে থাকে। ভিখুর মা ব্যাপার বুঝে ওঠার আগেই দেখেন গুলিবিদ্ধ ছেলে ও পুত্রবধূর দেহ বাড়ির পুকুরপাড়ে। মিলির পা দুটো পুকুরের পানিতে, মাথা পুকুরের পাড়ে। গুলি লাগে তার তলপেটে, বুলুর কাধের নিচে। জাহাঙ্গীরের ফুফা ঘরের মধ্যে ছিলেন, তিনি সেখানেই গুলি খেয়ে ঢলে পড়েন। গুলি খেয়ে ঢলে পড়ে জাহাঙ্গীর। আরো অনেকে মারা পড়ে,বাকিরা চিৎকার করে দৌড়ে পালাতে থাকে। আর্মি খানিকক্ষণ গুলি চালিয়ে মেরে-ধরে চলে যায়। ভিখুর মা তলপেটে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ভিখুর মেয়ে দু’টিকে খোঁজ করতে গিয়ে দেখেন পাঁচ বছরের ছোট মেয়ে ইয়েন ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে চলে যাচ্ছে অন্য কতকগুলো লোকের পেছন পেছন। ভিখুর মা ঐরকম আহত অবস্থাতেই একহাতে তলপেট চেপে ধরে ছুটে গিয়ে অন্য হাতে নাতনীকে টেনে আনেন। মিলিটারি চলে যাবার পর সেই গ্রামের একটি সহৃদয় ছাত্র অনেক কষ্টে বুলু ও তার মাকে মির্জাপুর হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে ওরা প্রায় তিন সপ্তাহ থাকেন। তারপর আত্মীয়বন্ধুর সহায়তায় ঢাকা এসেছেন। বুলুও তার মার দেহে তখনো গুলির টুকরা রয়ে গিয়েছিল, ধানমন্ডিতে ডাঃ মনিরুজ্জামানের ক্লিনিকে যা গোপনে, খুব সাবধানতার সঙ্গে এঁদের দু’জনের শরীর থেকে গুলির টুকরো বের করা হয়েছে।
আমি সব শুনে স্তব্ধ হয়ে বসে ভাবতে লাগলাম। সমস্ত দেশের ওপর কি মহা সর্বনাশের প্রলয় ঝড় নেমে এসেছে। ভিখু, মিলি, হামিদুল্লাহ, সিদ্দিকা, খোন্দকার সাত্তার, রঞ্জুর কলিগ, নূরুর রহমান –কি এদের অপরাধ ছিল? শান্তিপ্রিয় নাগরিক, নিজের দেশকে ভালোবাসতো। ভিখু প্রেস চালিয়ে স্বাধীন ব্যবসা করে খেত, আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিল, বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ছিল। এই তার এতবড় অপরাধ? হামিদুল্লাহ, শান্ত নিরীহ মানুষ, পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম এবং একমাত্র ষোলআনা বাঙালি মালিকানার ব্যাঙ্ক, ইস্টার্ন ব্যাঙ্কিং করপোরেশনের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর। এই অপরাধে তার এত বড় শাস্তি? নিষ্ঠুর হত্যাকারীদের গোলার আঘাতে একমাত্র সন্তানকে চোখের সামনে মরতে দেখল, ভয়ানক আহত বউও কয়েকদিন পরে তার কোলেই শেষ নিশ্বাস ফেলল। নূরুর রহমান ইঞ্জিনিয়ার- স্বাধীন ব্যবসা করে খেত, বিয়ে করেনি বলে কোন পিছুটান ছিল না। দেশের ও দশের উপকার করে বেড়াত। সেই অপরাধে তাকে প্রাণ দিতে হল?
- শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বই থেকে
Post a Comment Blogger Facebook
Click to see the code!
To insert emoticon you must added at least one space before the code.