image

image
 

A+ A-
Voice of 71 Voice of 71 Author
Title: একাত্তরের দিনগুলি: ২২ মে, ১৯৭১
Author: Voice of 71
Rating 5 of 5 Des:
২২ মে, শনিবার, ১৯৭১ আজ সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত মেহমানের যা ভিড়। ভাগ্যিস দু’দিন আগে কাসেম ফিরে এসেছে। চারদিনের ছুটিতে, ছাব্বিশ দিন ...
২২ মে, শনিবার, ১৯৭১

আজ সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত মেহমানের যা ভিড়। ভাগ্যিস দু’দিন আগে কাসেম ফিরে এসেছে। চারদিনের ছুটিতে, ছাব্বিশ দিন কাঢিয়ে এসেছে। তবু তো এসেছে।

সকালে পাশের বাড়ির হেশামউদ্দিন খান সাহেবের বড় দুই মেয়ে খুকী ও খুকুমণি বেড়াতে এসেছিল। ওরাও গ্রামের দিকে পালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওদের কারো কোনরকম ক্ষতি হয় নি। ওদের কপাল ভালো- মিলিটারির তাড়া খেয়ে দৌড়োতে হয় নি, সম্পূর্ণ অচেনা গ্রামের লোকেরা খুব যত্ন করেছে ওদের। গ্রামের লোকজনের মানসিকতা এই রকম: শহরের লোকজন গ্রামে তো আসে না বেশি, বিপদে প’ড়ে এসেছেন, তাদের ঠিকমত খাতির-যত্ন করা উচিত। খুঁকী আরো বলল, "কি বলব খালাম্মা অনেক গ্রামে বুড়ো মানুষরা পথের ধারে খানিক দূরে দূরে গুড় আর মটকাভর্তি পানি নিয়ে বসে থেকেছে। লোকজন হেঁটে যেতে যেতে যাতে মাঝে-মাঝে পানি খেয়ে নিতে পারে। অনেক বাড়িতে রাতদুপুরে মুরগি জবাই করে রেঁধে খাইয়েছে। মাচায় তোলা ভালো কাঁথা-বালিশ পেড়ে শুতে দিয়েছে।"

সত্যিই ওদের কপাল ভালো। সকলের বেলায় এরকম আতিথেয়তা জোটে না। আতিথেয়তা জুটলেও মিলিটারির গুলি থেকে রেহাই মেলে না।

খুকুমণিরা থাকতে থাকতেই রেবা এল। ঘণ্টাখানেক গল্প করে তারপর গেল।

রেবা চলে যাবার পর গোসল করবার উদ্যোগ করছি, এমন সময় হঠাৎ দেখি রেণু আর চাম্মু এসে হাজির। ওরা রইল আড়াইটে-তিনটে পর্যন্ত। শরীফ দুটোয় অফিস থেকে ফিরলে সবাই খেতে বসলাম। অনেক পীড়াপীড়ি করার পর রেণু আমাদের সাথে খেতে বসল, কিন্তু চাম্মুকে কিছুতেই বসাতে পারলাম না। সে শুধু দু’বার দু’কাপ চা খেল, ব্যস।

ওরা যেতে, সাড়ে তিনটেয় আবু আর নজু এল। গতকাল বিকেলে নিউ মার্কেটে আবুর সঙ্গে দেখা- সে রাজশাহী থেকে ঢাকা ট্যুরে এসেছে। তখনই তাকে বাসায় আসতে বলেছিলাম। উদ্দেশ্য: রাজশাহীর খবর জানা। কেননা এ মাসের প্রথমদিকে ডঃ সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেনের কাছে গিয়ে রাজশাহী সম্বন্ধে জানতে চেয়ে প্রায় কিছুই জানতে পারি নি। ওসমান গণি স্যার একদিন ফোন করে বললেন, "ডঃ সাজ্জাদ হোসেন রাজশাহী থেকে ঢাকা এসেছেন।" ডঃ হোসেন বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর। ওঁর সঙ্গে আমার পরিচয় অল্প, তবু গনি স্যারকে বললাম, "স্যার ওঁর ঠিকানাটা বলুন, আমি যাব ওঁর কাছে।" ওসমান গনি স্যার একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, "যেতে চাচ্ছ, যাও। তবে বেশি খোঁচাখুঁচি কোরো না।"

বুঝলাম। তবে রাজশাহীতে আমাদের আত্মীয়বন্ধু অনেক রয়েছে, রাজশাহীর খবর একজন প্রত্যক্ষদর্শীর মুখে শোনার জন্য মন উদগ্রীব হয়ে আছে। কিন্তু ডঃ হোসেন গম্ভীর গলায় সংক্ষিপ্ত বাক্যে বললেন, "রাজশাহীতে সবকিছু ঠিকঠাক আছে, প্রথমদিকে উচ্ছৃঙ্খল প্রকৃতির কিছু লোকজন জনসাধারণের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ করে তুললেও এখন সব শান্তিপূর্ণভাবে চলছে।" ওসমান গনি স্যারের উপদেশ মনে করে ডঃ হোসেনকে বেশি প্রশ্ন করি নি।

এখন আবুকে পেয়ে ওকে মনের সুখে জেরা করতে শুরু করলাম।

"রাজশাহী তো প্রথমদিকে জয় বাংলার দখলে ছিল, তাই না?"

"হ্যাঁ, তবে মার্চের শেষ কয়দিন ই.বি.আর, ই.পি.আর ও পুলিশদের সঙ্গে পাকি আর্মির খুব যুদ্ধ হয়। তাদের সঙ্গে যোগ হয় স্থানীয় অনেক লোকজন। তারপর পাক আর্মি ক্যান্টনমেন্টে ঘেরাও হয়ে যায়। মুক্তিবাহিনীর লোকেরা ক্যান্টনমেন্টের চারপাশ দিয়ে ট্রেঞ্চ খুঁড়ে ওদেরকে এমনভাবে ঘেরাও করে রাখে যে ওরা খাবার কেনার জন্যও বেরোতে পারত না। মুক্তিবাহিনীর প্ল্যান ছিল না- খাইয়ে পাক আর্মিকে ঘায়েল করা।"

"পাক আর্মি এমনি চুপচাপ বসে থাকত? গোলাণ্ডলি ছুঁড়ত না?"

"হ্যাঁ ছুঁড়ত। কিন্তু তাতে মুক্তিবাহিনীর বিশেষ ক্ষতি হত না। তারপর ঢাকা থেকে প্লেন এসে মুক্তিবাহিনীর ওপর যখন বম্বিং শুরু করল, তখন একটু বেকায়দা হয়ে গেল।"

"কত তারিখে বম্বিং শুরু হয়?"

"তারিখ তো মনে নেই মামী। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে হবে।"

"তোমাদের পাড়ায় বোমা পড়েছিল?"

“না, আমরা ছিলাম মালোপাড়ায়। সেটা শহরের মাঝখানে। প্রথমে ক্যান্টনমেন্টের দিকে বম্বিং হয়, সেটা শহর থেকে তিন মাইল দুরে। প্রথমদিন বম্বিংয়ের খবর পেয়েই আমরা শহর ছেড়ে ১২/১৪ মাইল দুরে একটা গ্রামে চলে যাই আমার এক বন্ধুর সঙ্গে। ওইগ্রামে তার বাড়ি।”

“গ্রামে কতদিন ছিলে?”

“তা প্রায় মাসখানেক। অনেকে নদী পেরিয়ে বর্ডার ক্রস করে যাচ্ছিল। কিন্তু মামী, আমার ছোট বাচ্চাটা তখন মাত্র দু’মাসের। ওকে নিয়ে নদী পার হওয়া যেত না। তাই বন্ধুর গ্রামের বাড়িতে গেলাম। পরে শুনেছি, ক্যান্টনমেন্টের চারপাশে মুক্তিবাহিনীর ওপর বম্বিং করে পাক আর্মি হেলিকপ্টারে করে সৈন্যদের জন্য খাবার নামিয়ে দেয়। আর দু’একদিন দেরি হলে সৈন্যগুলো না খেয়ে মারা যেত। তারপর শোনা গেল ঢাকা থেকে আর্মি আসছে রাজশাহী শহর দখল করতে। তখন আরো বহু লোক শহর ছেড়ে পালালো।”

“রাজশাহীতে আর্মি কবে ঢোকে?”

“সঠিক বলতে পারব না- খুব সম্ভব ১২/১৩ তারিখে।”

“তোমরা রাজশাহী ফিরে কি দেখলে?”

“দেখলাম, সারা শহর লন্ডভন্ড। বহু জায়গা আগুনে পোড়া। শুনলাম, বহু লোককে গুলি করে মেরে ফেলেছে।”

“শহরে ফিরে এসে অফিসে যোগ দিলে?”

“আমার অফিস আর বাড়ি একই বিল্ডিংয়ে। একতলায় অফিস, দোতলায় বাসা। কি আর করব?”

“সে তো বটেই। তা অফিসে জয়েন করার পর তোমার ওপর কোন ঝামেলা করে নি?”

“না, আসলে গভর্নমেন্ট অফিস নয় বলেই বোধহয় কোন ঝামেলা হয় নি।”

আবু জীবন বীমা কোম্পানিতে চাকরি করে।

“ঢাকা এলে কিসে করে?”

“কোচে।”

“রাস্তায় কি দেখলে?”

“রাজশাহী থেকে ঢাকা পর্যন্ত পুরো রাস্তার দু’পাশে সমস্ত গ্রাম পোড়া। ঢাকা থেকে রাজশাহী যাবার সময় সৈন্যরা রাস্তার দু’পাশের সমস্ত গ্রাম জ্বালাতে জ্বালাতে গেছে। লোকজন যারা পালাতে পারে নি তারা গুলি খেয়ে মরেছে। গরু-ছাগল মরে প্রায় সাফ হয়ে গেছে।”

শরীফ বলল, “রাজশাহী বর্ডারে মুক্তিযুদ্ধ কি রকম হচ্ছে, খবর-টবর পাও?”

“পাই মামা। শুধু রাজশাহী বর্ডারে নয় দেশের চারদিকেই বর্ডার ধরে যুদ্ধ হচ্ছে।”

আমি বললাম, “দেশের ভেতরেও কিন্তু গেরিলা তৎপরতা শুরু হয়েছে।”

শরীফ বলল, “আমরা যারা বর্ডার ক্রস করে যুদ্ধে অংশ নিতে পারি নি, তাদের কিন্তু দেশে বসেও অনেক কিছু করার আছে। তুমি ছোট বাচ্চা নিয়ে নদী পেরিয়ে যেতে পার নি বলে আফসোস করছিলে। আফসোস করার কিছু নেই। তুমি রাজশাহীতে ঘরে বসেই যুদ্ধে অংশ নিতে পার।

আবু জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইল, বলণীম, “শহরে যেসব গেরিলা আসবে, তাদের বাড়িতে লুকিয়ে আশ্রয় দেবে, তাদের খাওয়াবে। একজায়গা থেকে আরেক জায়গায় খবর পৌছে দেবে। পারলে টাকা-পয়সা যোগাড় করে তাদের সাহায্য করবে।”

আবু খুব ধীর নম্রস্বরে বলল, “আপনাদের কথা আমি মেনে চলব। যতটা সাধ্যে কুলায়।”

- শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বই থেকে

About Author

Advertisement

Post a Comment Blogger

 
Top