image

image
 

A+ A-
Voice of 71 Voice of 71 Author
Title: একাত্তরের দিনগুলি: ১১ মে, ১৯৭১
Author: Voice of 71
Rating 5 of 5 Des:
১১ মে, মঙ্গলবার, ১৯৭১ দুপুরে ভাত খেতে বসেছি, হঠাৎ জোরে কলিংবেল বাজল। বাজল তো বাজল আর থামে না। কে রে কলিংবেলে আঙুল চেপে দাঁড়িয়ে আছে? ...
১১ মে, মঙ্গলবার, ১৯৭১

দুপুরে ভাত খেতে বসেছি, হঠাৎ জোরে কলিংবেল বাজল। বাজল তো বাজল আর থামে না। কে রে কলিংবেলে আঙুল চেপে দাঁড়িয়ে আছে? আমি রেগে হাঁক দিলাম, “এ্যাই বারেক দেখ ত’ কোন বেয়াদব এরকম বেল টিপে ধরে রেখেছে।”

বারেক দরজা খুলতেই ঘরে ঢুকল রুমী! চমকে দেবার দুষ্টু চাপা হাসিতে মুখ উদ্ভাসিত। আমি খুশিতে চেচিয়ে উঠলাম, “রুমী তুই?”

রুমী কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে টেবিলে বসল, “হ্যাঁ আম্মা, ফিরে আসতে হলো।”

বারেক ইতোমধ্যেই একটা প্লেট এনে রুমীর সামনে রেখেছে, তাকে বলতেও হয় নি। রুমী প্লেটে ভাত তুলভে তুলতে বারেকের দিকে তাকিয়ে বলল, “বারেক রান্নাঘর থেকে দুটো শুকনো মরিচ পুড়িয়ে আনতো। দেখবি বেশি পুড়ে যায় না যেন। সাবধানে অল্প আঁচে সেঁকবি আস্তে আস্তে বুঝলি?”

বারেক চলে গেলে রুমী নিচু গলায় বলল, “আমাদের যে রাস্তা দিয়ে যাবার কথা ছিল, সেখানে ঘাপলা হয়েছে। আমার কনট্যাকট অন্য রাস্তা জানে না। তাই কটা দিন অপেক্ষা করা ছাড়া আর উপায় নেই।”

রুমীর মুখে হাসি নেই কিন্ত আমার হাসি আর ধ’রে না।

খাওয়ার পর সবাই বেডরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে শুনলাম রুমীদের যেতে না পারার কাহিনী। মবু আর শিরাতের আসল নামও রুমী আজ বলতে আপত্তি করল না। মবু অর্থাৎ মনিরুল আলম, সংক্ষেপে মনু আর ইশরাক। ইশরাক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সের ছাত্র, মনু এম.এ’র। দু’জনেই বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। মনু আবার গানও গায়।

মনু-ইশরাকের দলে রুমী ছাড়াও ছিলেন কামাল লোহানী, প্রতাপ হাজরা, বাফার কিছু হিন্দু কর্মচারী ও শিল্পী- তাঁদের পরিবার-পরিজন, আর একজন আহত হাবিলদার। রুমীরা সদরঘাট দিয়ে বুড়িগঙ্গা পার হয়ে প্রায় সাত-আট মাইল পথ হেঁটে যায়। আহত হাবিলদারটিকে প্রায় চ্যাংদোলা করে নিতে হয়েছিল। কিছুদূর এগিয়ে তাকে তার জানা এক গ্রামে পৌছে দেয়। বিকেলের দিকে ঝড়বৃষ্টি হয়, ফলে গ্রামের কাঁচা রাস্তা কাদায় প্যাচপেচে হয়ে যায়। এই ভাবে অনেক কষ্টে ওরা ধলেশ্বরীর পাড়ে পৌছায়। ধলেশ্বরী পার হয়েই সৈয়দপূর। সেখান থেকে আট মাইল দূরে শ্রীনগর। শ্রীনগর থানা তখলো মুক্তাঞ্চল। সেখানে প্রতিদিন ঢাকা খেকে বহুলোকে পরিবার- পরিজন নিয়ে ছুটে যাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য। মনুরা স্পীডবোটে করে সৈয়দপূর থেকে শ্রীনগর পৌছায় সন্ধ্যারাতে। ওখান থেকে আধমাইল দুরে নাগরভাগ গ্রামে ডাঃ সুকুমার বর্ধনের বাড়ি। রুমীদের দল সে রাতটা ডাঃ বর্ধনের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। পরদিন যাত্রার তোড়জোড় শুরু হয়। শ্রীনগর থেকেই নৌকা ভাড়া করে বর্ডারের উদ্দেশে রওনা দিতে হবে। কিন্তু নানা লোকের মুখে খবর পেতে থাকে যে, পাক আর্মি ধলেশ্বরী পার হয়ে সৈয়দপুর দিয়ে বিক্রমপুর অঞ্চলে প্রবেশ করছে। তখন সবাই মিলে চিন্তাভাবনা করতে বসে কি করা যায়। নাগরভাগ থেকে সিকিমাইল দূরে আরেকটা গ্রাম- বাসাইল ভোগ- সাংবাদিক ফয়েজ আহমদের বাড়ি। ২৫ মার্চের রাতে ঢাকায় প্রেসক্লাবে পাক আর্মির শেলের ঘায়ে তিনি বাম উরুতে আঘাত পান। এখনো ভালো করে সেরে ওঠেন নি। কামাল লোহানীসহ কয়েকজন ফয়েজ আহমদের বাড়িতে যান পরামর্শের জন্য। নানারকম চিন্তাভাবনা-সলাপরামর্শের পর ঠিক হয়- পাক আর্মি পুরো অঞ্চল ঘেরাও করে ফেলার আগেই ওদের দলকে যে করেই হোক, ওখান খেকে বেরিয়ে যেতে হবে। সে অনুযায়ী ১০ তারিখ ভোররাতে ওরা ফয়েজ আহমদসহ তাঁর বাড়ি থেকে রওয়ানা দেয় কুমিল্লার শ্রীরামপুরের পথে। ঐদিক দিয়ে বর্ডার ক্রস করতে হবে। কিন্তু পথে জানা গেল শ্রীরামপুরে ইতোমধ্যেই পাক আর্মি এসে গেছে। তখন ওরা দিক পরিবর্তন করে ঢাকার দিকে আসা সাব্যস্ত করে। এই আসাটা খুব বিপদসঙ্কুল ছিল। কারণ সৈয়দপুর তখন মিলিটারিকবলিত। সেদিন বিকেলে ঝড়বৃষ্টিও প্রচুর হয়েছিল। রুমীরা অনেক ঘুরপথে একবার এগিয়ে, একবার পিছিয়ে, কখনো স্পীডবোটে, কখনো ভাঙা বাসে, কখনো কাদাভরা পথে পায়ে হেঁটে প্রাণ হাতে নিয়ে ঢাকা পৌছায় রাত ন’টার দিকে। রাতটা সবাই কামাল লোহানীর বাড়িতে গাদাগাদি করে থাকে। আজ সকালে সবাই একসঙ্গে ও বাড়ি থেকে বেরোয় নি। দু’তিনজন করে খানিক পর পর বেরিয়েছে যাতে পাড়ার লোকে সন্দেহ করতে না পারে। তাও রুমী সোজা বাড়ি আসে নি। দুপুর পর্যন্ত ইশরাকের সঙ্গে থেকে তারপর এসেছে।

- শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বই থেকে

About Author

Advertisement

Post a Comment Blogger

 
Top