মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন লেখায় পাকিস্তানীদের গণহত্যা আর ভয়ংকর সব অপরাধের কথা বলতে গেলেই কিছু মানুষ পাকিস্তানীদের কুকর্ম ধামাচাপা দিতে মোটামুটি আকাশ থেকে ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলীর ভুট্টোর বাংলাদেশ সফরের প্রসঙ্গ টেনে আনেন। তাদের কথা হচ্ছে স্বাধীনতার ঠিক তিন বছরের মাথায় যদি বঙ্গবন্ধু ভুট্টোকে এইদেশে আমন্ত্রণ করে আনতে পারেন, তাহলে ৩০ লাখ শহীদের লাশের উপর দাঁড়িয়ে তারা পাকিস্তান সমর্থন করলে দোষ কোথায়? খুবই উদ্ভট এই যুক্তি প্রায়ই শুনি, দেখে স্তম্ভিত হই মায়ের ধর্ষককের সাথে বুক মেলাবার জন্য কি নির্লজ্জভাবেই না যুক্তি দেখাচ্ছে কিছু মানুষ। ভুট্টো ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে এসেছিল, এদ্দুর জেনেই তারা বঙ্গবন্ধুকে গালি দিয়ে নিজেদের পাকিপ্রেম জায়েজ করতে চায়, অথচ কেন ভুট্টো এসেছিল, কিভাবে তাকে ঘাড়ে ধরে বাংলাদেশে আনা হয়েছিল, সেই ইতিহাস জানার বিন্দুমাত্র আগ্রহ এদের ভেতর নেই। আজ সেই ইতিহাসটাই জানাবো আপনাদের!
১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ কমনওয়েলথের সদস্যপদের আবেদন করলে ভুট্টো বিরোধিতা করেন। তাঁর দাবি, বাংলাদেশ পাকিস্তানের অংশ। ভুট্টোর এই আচরণে বঙ্গবন্ধু ক্ষুব্ধ হন। ১৫ জানুয়ারি লন্ডনের অবজারভার–এর গ্যাভিন ইয়ংকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘ভুট্টো যদি বাংলাদেশের কমনওয়েলথ সদস্যপদ পেতে বাধা দেন বা চালাকি করেন, আমি পশ্চিম পাকিস্তানের দখল নেব এবং সেটিকেও বাংলাদেশের অংশ করব। আমিই পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। আর তিনি সেনাবাহিনীর কৃপায় সেই দেশটির প্রেসিডেন্ট। গণতান্ত্রিকভাবে আমি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং সেখানকার প্রদেশগুলোতে আমি আমার লোকজনকে নিয়োগ দেব।’
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শেষে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুর সামনে তখন একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, যার ৮০ ভাগের উপর রাস্তাঘাট, ব্রিজ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত, ভাঙা, গৃহস্থের গোয়ালায় গরু নেই, পেটে ভাত নেই, ফসলের জমি পোড়া, ফসল নেই, নদীতে মাছ আছে কিন্তু নদীতে তার চেয়ে বেশি লাশ। মাছগুলো সেই লাশকেই তাদের আধার বানিয়েছে। যার ফলে জেলেরা সেই মাছ ধরেও না আবার মানুষ সেই মাছ খায়ও না। কোটি কোটি ক্ষুধার্থ মুখ, নিঃস্ব অর্থনীতি, শূন্য ব্যাংক। অজস্র শহীদ স্বজনের চাপা আর্তনাদে ভারী বাংলাদেশ, ভারতে বন্দী ৯১০০০ যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানী সেনার বিচার করতে হবে। বিচার করতে হবে গণহত্যার সাথে জড়িত বিহারীদের, পাকিস্তানে ফেরত পাঠাতে হবে বাকি বিহারীদের। কিন্তু ওদিকে পাকিস্তানে মৃত্যুর অপেক্ষায় আটকে আছে সাড়ে তিন থেকে চার লাখ বাঙ্গালী, যদি এদিকে বাংলাদেশ পাকিস্তানীদের বিচার করে, তাহলে ওদিকে বাঙ্গালীদের জীবন বিপন্ন, বিহারীদেরও ফিরিয়ে নেবে না পাকিস্তান।
এমন কঠিন অবস্থায় বঙ্গবন্ধু সবার আগে দেশ গঠনে মনোযোগ দিলেন। সাহায্য চাইলেন আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠী থেকে শুরু করে সকল রাষ্ট্রের কাছে, এমনকি যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তীব্র বিরোধিতা করেছিল, তাদের কাছেও দেশটা গড়ে তুলতে সাহায্য চাইলেন। কারণ ওচিত্যবোধের চেয়েও জাতির জনকের কাছে তখন তার দেশের মানুষের মুখে দুবেলা দুমুঠো খাবার তুলে দেওয়া বেশি জরুরী। মজার ব্যাপারটা হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় সামান্য সহায়তা না করলেও, ক্ষেত্রবিশেষে প্রবল বিরোধিতা করলেও স্বাধীন বাংলাদেশকে ঋণ দেয়ার সময় দাতাগোষ্ঠীরা বললো, পাকিস্তান আমলে নেওয়া ঋণের দায়ভার দিতে হবে বাংলাদেশকেই। কিন্তু বাংলাদেশ বরাবরই বলে এসেছে, একাত্তর-পূর্ববর্তী সব দায়দেনা পাকিস্তানকেই মেটাতে হবে। দাতাগোষ্ঠী পাকিস্তানের প্রতি ছিল সহানুভূতিশীল। তারা বেশ কয়েকবার দেনা পরিশোধের সময়সীমা পরিমার্জন করেছিল। অন্যদিকে দেনার একটা অংশ যাতে বাংলাদেশ বহন করে, সে জন্য আন্তর্জাতিক চাপ ছিল। ওই সময় বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের ঋণের দায় নেবার চাপ দিলে বঙ্গবন্ধু দৃঢ়তার সঙ্গে এই দায় নিতে অস্বীকার করেছিলেন।
এই চাপটাও ঠিক তখন এসেছে, যখন আমরা পাকিস্তানের কাছ থেকে আমাদের প্রাপ্য সম্পদের ভাগ চাচ্ছি। ১৯৭৪ সালে করা এক হিসাবে দেখা যায়, পাকিস্তানের সম্পদে বাংলাদেশের দাবির আর্থিক মূল্য প্রায় ৪০০ কোটি ডলার। এর সঙ্গে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির আনুমানিক দাম ধরা হয়েছিল আরও ১০০ থেকে ১৫০ কোটি ডলার। ১৯৭১-৭২ সালের মূল্যমান অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট প্রাপ্য হিসাব করা হয়েছিল ৫০০ থেকে ৫৫০ কোটি ডলার। যদিও পরবর্তীতে কানাডার ট্রেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এ চৌধুরী ও এস এ বাশার বিস্তারিত এক গবেষণায় দেখিয়েছিলেন যে আমাদের মোট প্রাপ্যের পরিমাণ ২৩০০ কোটি ডলারেরও বেশি, কিন্তু তখনকার সময়ে এই সাড়ে পাঁচশো কোটি ডলারই পাকিস্তানের কাছ থেকে আদায় করা বিশাল চ্যালেঞ্জ ছিল। কারণ নির্লজ্জ পাকিস্তানীদের সাথে যোগ দিয়েছিল গণহত্যার পক্ষে থাকা বিশ্বমোড়লেরা। সবচেয়ে মজার ব্যাপারটা ছিল, পাকিস্তানের যে ঋণের দায়ভার আমাদের উপর চাপানোর চেষ্টা করা হচ্ছিল, সেটাও মওকুফযোগ্য হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল দাতারা, যদি আমরা বন্দী পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর বিচার বাতিল করি।
তার মানে কি দাঁড়ালো বুঝতে পারছেন? পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের বিচার বাতিল করো, তাদের ফিরিয়ে দাও, প্রাপ্য টাকা চেয়ো না, পাকিস্তানের কোন অপরাধের বিচার চেয়ো না, ব্যাস, আমরা বাংলাদেশকে সব ধরণের সহায়তা করতে রাজি আছি। ঠিক এটাই ছিল তৎকালীন বিশ্বমোড়লদের প্রস্তাব। জাতিসংঘের সদস্যপদ পাচ্ছি না আমরা কারণ পাকিস্তানের পেয়ারে দিওয়ানা চীন ভেটো দিয়ে যাচ্ছে বারবার, বলছে পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের বিচার বাতিল করো, আমরা স্বীকৃতি দিচ্ছি, জাতিসংঘেও সদস্যপদ পাবে। তারা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল, “After resolution of the war trials issue, Peking will recognise Dacca, and the way will be open for Bangladesh to be admitted to the United Nations”
বাংলাদেশকে এভাবে আন্তর্জাতিকভাবে চাপে রেখে সিমলায় ইন্দিরা গান্ধীর সাথে ভুট্টো বসলো দুই দেশের বৈরিভাব দূর করে যুদ্ধবন্দীদের মুক্ত করতে। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, ভারতের কাছে যারা যুদ্ধবন্দী তারাই আবার বাংলাদেশের কাছে যুদ্ধাপরাধী। সুতরাং দুই পক্ষের বৈঠকে এ মীমাংসা হবার নয়। এখানে ত্রিপাক্ষিক বৈঠক হতে হবে। সেখানে নির্লজ্জ বেইমান ভুট্টো ইন্দিরা গান্ধীকে এর জবাবে বললো, “যদি বাংলাদেশ একজন সেনা সদস্যের বিচারও শুরু করে তাহলে পাকিস্তানও পাকিস্তানে থাকা বাঙ্গালিদের রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে বিচার করবে”। ভুট্টোর ইকুয়েশনটা বুঝতে পেরেছেন?
ওদিকে ১৯৭২ সাল থেকেই বাংলাদেশি পাসপোর্টে হজ্জে যাওয়া বন্ধ। কেন জানেন? পুরো একাত্তরের সময়টায় পাকিস্তানকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে লাখো বাঙ্গালী ভাইদের পৈশাচিক হত্যাকান্ডে সমর্থন দেবার জন্য দুঃখ প্রকাশ কিংবা ক্ষমা চাওয়া তো বহু দূরে থাক, সৌদি আরব ১৯৭২ সাল থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের পাসপোর্টে মুসলমানদের হজে যাওয়া বন্ধ করেছিল কারণ বাংলাদেশ গণহত্যার অপরাধে ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী সেনা কর্মকর্তার বিচারের দাবীতে অটল ছিল। শুধু সৌদি আরব নয়, মধ্যপ্রাচ্যের বাকি মুসলিম রাষ্ট্রগুলোও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিয়ে ঠিক এই দাবীই জানিয়েছিল যে, পাকিস্তানের দাবী মেনে নাও, বিচার বাতিল কর।
খুব জানতে ইচ্ছা করে মাঝে মাঝে, এমন ভয়ংকর এক সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকে গালাগালি দেওয়া আমাদের অনলাইন বিপ্লবীরা কি করতেন? কিভাবে প্রবল চাপের মুখে দাঁড়িয়েও নিজের দেশের, জনগণের স্বার্থটা বের করে নিয়ে আসতেন? বঙ্গবন্ধু কিন্তু একবারও পিছু হটেননি। এমন কোণঠাসা বাংলাদেশকে নিয়ে গেলেন ন্যামে। নন এলাইড মুভমেন্ট নামে ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া একটা অর্গানাইজেশন। যেখানে রয়েছে মার্কিন-সোভিয়েত প্রভাবমুক্ত ২৫টি উন্নয়নশীল দেশ। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন যে তাকে সোভিয়েত-আমেরিকার প্রভাবের বাইরে থাকা রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে এগোতে হবে, আউট অফ বক্স কিছু করতে হবে। সে চিন্তা থেকেই ন্যাম সম্মেলনে দুর্দান্ত কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে মিশর, লিবিয়াকে সাথে নিয়ে আরেকবার মধ্যপ্রাচ্যের সাথে সম্পর্ক করার প্রচেষ্টা নিলেন। মিশরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত সত্যিকারের বন্ধুর মত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়ে প্রথমে সৌদি আরবকে রাজি করালেন, তারপর সৌদি বাদশাহ ফয়সাল, আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বুমেডিয়েনসহ মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর প্রধানদের নিয়ে নতুন করে অচলাবস্থা নিরসনের উদ্যোগ নিলেন।
এই উদ্যোগের প্রাথমিক সাফল্য এলো আন্তর্জাতিক আদালতে যখন ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানের মামলা প্রত্যাহার করলো। পাঠক নিশ্চয়ই একটু অবাক হয়ে ভাবছেন, পাকিস্তান আবার ভারতের বিরুদ্ধে কবে মামলা করলো? জ্বি, নির্লজ্জ ভুট্টো আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী হস্তান্তর করবার জন্য। ভারত নাকি অন্যায়ভাবে এই ১৯৫ জনকে আটকে রেখেছে, তাই এই যুদ্ধাপরাধীদের হস্তান্তরে বাধ্য করার জন্যই পাকিস্তান আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করতে চাচ্ছিল! যাক, মামলার সকল কাগজপত্র জমা দেবার তারিখ ১৫ই ডিসেম্বর ১৯৭৩ থেকে ১৭ই মে ১৯৭৪ পর্যন্ত বর্ধিত করা হলেও মিশর ও আরব লীগের নেতৃবৃন্দ অচলাবস্থা কাটাবার উদ্যোগ নেওয়ায় শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান ১৯৭৩ সালের ১৪ই ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক আদালতের রেজিষ্টারের কাছে একটি চিঠিতে মামলাটি আর না চালাবার সিদ্ধান্ত জানায় এবং মামলাটি আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারাধীন মামলার তালিকা থেকে বাদ দেবার জন্য অনুরোধ জানায় । এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাষ্টিস ১৫ ই ডিসেম্বর ১৯৭৩ এক আদেশের মাধ্যমে, আদেশ নং – ৩৯৩, এই মামলাটি বাতিল ঘোষনা করে এবং তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
আন্তর্জাতিক আদালত থেকে পাকিস্তানের মামলাটি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত আরবলীগ নেতৃবৃন্দের একটি বড় কূটনৈতিক সাফল্য বলে বিবেচিত হয়। তাই তারা এই ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যকার বিদ্যমান সমস্যা ভারতের মধ্যস্থতা ব্যতীত সরাসরি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা শুরু করে। বাধ্য হয়েই বঙ্গবন্ধুকে সেই প্রস্তাব মেনে নিতে হয়, কারণ পাকিস্তানের বিপক্ষে কূটনীতিতে জিততে আরব লীগের সমর্থন দরকার বাংলাদেশের। বাংলাদেশের কাছ থেকে এই সম্মতি পেয়ে আরব লীগ নেতৃবৃন্দ এবার পাকিস্তানের উপর চাপ প্রয়োগ শুরু করে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দান করার জন্য। কারণ এর মাধ্যমে পাকিস্তান বাধ্য হবে একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের দাবীগুলো নিয়ে কথা বলতে, আলোচনার টেবিলে বসতে। এই চেষ্টার জবাবে জুলফিকার আলী ভূট্টো কি বলেছিল জানেন? বাংলাদেশ ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রত্যাহার করলেই কেবলমাত্র পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে।
সেই পুরান ক্যাচাল! আমাদের নানামুন্না নিষ্পাপ বাচ্চাগুলোকে ছেড়ে দাও, আমরা সব দাবী মেনে নিচ্ছি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এতো চাপের মুখেও একটাবারের জন্যও পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবী থেকে একচুল সরেননি। কিন্তু পাকিস্তান ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে গেছে তাদের নরপিশাচ গণহত্যাকারীদের বাঁচানোর। ১৯৭৪ সালের ২২-২৪ শে ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিতব্য ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনকে কেন্দ্র করে আরব লীগের নেতৃবৃন্দ জোর তৎপরতা শুরু করে। কারণ বাংলাদেশ তখনো ওআইসির সদস্য নয়। যদি বাংলাদেশকে ওআইসির সদস্য করে সম্মেলনে দাবীগুলো নিয়ে আলোচনা চালানো যায়, সেই চেষ্টা চলতে থাকে। কিন্তু সম্মেলন শুরুর আগে প্রায় সকল সদস্য রাষ্ট্রের সম্মতি থাকা সত্বেও (ইরান, তুরস্ক ও পাকিস্তান ব্যতীত) সেই পাকিস্তানের আপত্তির কারণে বাংলাদেশের ওআইসির সদস্যপদ আবারো অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে।
শেষ পর্যন্ত উপায়ান্তর না দেখে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, সৌদি রাজা ফয়সাল এবং জর্ডানের রাজা হুসেইন এর উদ্যোগে সাতটি মুসলিম দেশের প্রতিনিধি ঢাকা সফর করে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের উদ্যোগ থেকে সরে আসার জন্য বঙ্গবন্ধুকে রাজী করাতে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এই শর্তসাপেক্ষে পাকিস্তানের স্বীকৃতি গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান এবং এই বিষয়ে আরো আলোচনা প্রয়োজন বলে অভিমত দেন।
স্রেফ একবার ভাবেন তো, কতটা প্রজ্ঞা আর দৃঢ়তা থাকলে এতগুলো নেতৃস্থানীয় মুসলিম দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের চাপ উপেক্ষা করে নিজের দেশের স্বার্থে অটল থাকা যায়! বঙ্গবন্ধু বরং উল্টো জানিয়ে দেন যে তিনি ওআইসির সম্মেলনেই এই ব্যাপারে আলোচনা করতে চান। বঙ্গবন্ধুর দৃঢ়তা দেখে এই প্রতিনিধিদল পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভূট্টোর সাথে সাক্ষাৎ করে এবং সেখানে তারা বঙ্গবন্ধুর স্পষ্ট ও দৃঢ় অবস্থান জানায়। একইসাথে তারা যুদ্ধাপরাধী সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলাদেশের ওআইসি সম্মেলনে অংশগ্রহণের গুরুত্ব তুলে ধরে।
কিন্তু গোঁয়ার ভুট্টো বারবারই বেঁকে বসছিল, তার একটাই দাবী, আগে বাংলাদেশ পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবী প্রত্যাহার করবে, তারপরে তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে ও আলোচনায় বসবে। ফলে আরব লীগ বঙ্গবন্ধুকে চাপ দেওয়া অব্যাহত রাখে, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর পক্ষ থেকে কাতার বাংলাদেশকে এও বলে যে “চলমান অচল অবস্থা কাটাতে বাংলাদেশ ইচ্ছুক সেটা প্রমাণে বাংলাদেশের সামনে এই সম্মেলনই শেষ সুযোগ”। কিন্তু জাতির জনক কোন চাপেই বিনুমাত্র কর্ণপাত না করে তার দাবীতে অটল থাকেন এবং পাকিস্তান স্বীকৃতি না দিলে ওআইসি সম্মেলনে যোগ না দেবার নীতিগত সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ পুনরায় জানিয়ে দেয়।
এই প্রবল অচলাবস্থায় শেষ পর্যন্ত পরাজয় ঘটে ভুট্টোর। আরব লীগ নেতৃবৃন্দের প্রবল চাপে অনেকটা নাটকীয়ভাবে ১৯৭৪ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারী পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করতে বাধ্য হয়। একই দিন ইরান এবং তুরস্কও বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশ কূটনৈতিক বিজয় ছিনিয়ে আনে জন্মশত্রু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে! আর এর পুরো কৃতিত্বই বঙ্গবন্ধুর। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বেই আসে এই জয়।
তবে এই অনমনীয় দৃঢ়তা ঠিক দেড় বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের প্রথম বীজ বপন করে। যার বাহ্যিক ইঙ্গিত ছিল চীন ও সৌদি আরবের স্বীকৃতি না দেওয়া। পাকিস্তান স্বীকৃতি দিলেও যুদ্ধাপরাধী সমস্যা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানে অস্বীকৃতি জানায়। এর মাধ্যমে পাকিস্তান আরব লীগ নেতৃবৃন্দের কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় কৌশলগত কারনে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েও চীনের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া থেকে সরে না আসা পর্যন্ত জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করার ব্যাপারটি আটকে রাখে ।
২২ শে ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানের স্বীকৃতি লাভ করার পর বাংলাদেশের একই দিন থেকে লাহোরে অনুষ্ঠিতব্য ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেয়াতে আর কোন বাধা থাকেনা। জাতিসংঘের স্বীকৃতি আটকে গেলেও বঙ্গবন্ধুর এক প্রকার একলা প্রচেষ্টায় এই যে ওআইসিতে যোগ দিলো বাংলাদেশ, এটা আরেকবার আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে বঙ্গবন্ধুর সাফল্য প্রমাণ করে। এই অবস্থায় ২২শে ফ্রেব্রুয়ারী সকালে কুয়েতের আমীরের ভাই কুয়েতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে মুসলিম দেশগুলির একটি প্রতিনিধিদল একটি বিশেষ বিমানে করে ঢাকা আসেন এবং বঙ্গবন্ধুকে এসকর্ট করে লাহোরে নিয়ে যান ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেবার জন্য । ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় যে বঙ্গবন্ধুর কারাগারের পাশে কবর খোঁড়া হত তাকে দেখিয়ে, সেই পাকিস্তানে এবার স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে পা রাখেন তিনি। সেই পাকিস্তানীরাই তাকে সাদর অভিবাদন জানাতে বাধ্য হয়। স্রেফ পাকিস্তানীদের মত নির্লজ্জ গোঁয়ারদের জন্য লজ্জারই না, বরং সদ্য স্বাধীন একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও এটা ছিল অনেক বড় এক অর্জন!
আর এর পথে ধরেই এসেছিল জাতিসংঘের ১৩৬ তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রাপ্তি। যেহেতু পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে, সুতরাং বাধ্য হয়েই চীন তাদের ভেটো তুলে নেয় এবং বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পায়। প্রথমে কমনওয়েলথ, তারপর ওআইসি, তারপর ইরান, তুরস্ক এবং প্রধান শত্রু পাকিস্তানের স্বীকৃতি এবং শেষে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ - কূটনৈতিকভাবে এটা বাংলাদেশের জন্য বিশাল একগুচ্ছ সাফল্য হলেও এর জন্য ঘরে বাইরে সবচেয়ে বড় মাশুল দিতে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকেই। অনেকেই ইসলামী সম্মেলনে যোগ দেওয়াকে ভাবছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ নীতির সাথে আপোষ করা, বিচ্যুত হওয়া। কিন্তু যে সমাধানটা কেউ দিতে পারেননি সেটা হচ্ছে, আরব-আফ্রিকার নেতৃবৃন্দ যথা মিশরের আনোয়ার সাদাত, আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ারি বুমেদিন, লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফি, প্যালেস্টাইনের প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাত ও ইরানের শাহ - এর দূতিয়ালিতে যদি বঙ্গবন্ধু ওআইসিতে গিয়ে পাকিস্তানের উপর চাপ প্রয়োগের সুযোগটা না গ্রহণ করতেন, তাহলে আর কারা আমাদের দাবী পূরণে এগিয়ে আসতো?
এক ভারত আর সোভিয়েত রাশিয়া ছাড়া তো বাকি সবাইই আমাদের বিপক্ষে ছিল, বিরুদ্ধে ছিল, আমাদের দাবীগুলো আদায় হত কিভাবে? এই যে ধাপে ধাপে বিশ্বমোড়লদের বিপক্ষে একলা দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু একেবারেই অসম্ভব একটা কূটনৈতিক যুদ্ধ চালালেন এবং আমাদের দাবী নিয়ে অন্তত আলোচনার স্থান ও পরিধি ক্রমেই বাড়াতে সক্ষম হলেন (এরপর জাতিসংঘে গিয়েও বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবী তুলেছিলেন), তার জন্য যে তাকে নিজের জীবন দিয়ে মুল্য চুকাতে হয়েছিল, এই ঘটনাপ্রবাহ কি একবারও আমরা ভেবে দেখতে চেয়েছি?
এখন ভুট্টো আশা করেছিল যে বঙ্গবন্ধুকে লাহোরে ওআইসির এই সম্মেলনে এনে আরব দেশগুলোকে দিয়ে চাপ দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ওআইসিতে এমন শক্ত অবস্থান নিলেন যে পাকিস্তানের পক্ষে সরাসরি কোন সিদ্ধান্ত আসলো না। ওদিকে যেহেতু বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সফরে গেছেন, স্বাভাবিক কূটনৈতিক শিষ্টাচার রক্ষা করতে বাংলাদেশে ভুট্টোকে আসতে হবে। পাকিস্তানের সব সম্পদ ও দায়দেনা উভয় দেশ সমান ভাগ করে নেবে; ভাগ-বাঁটোয়ারার বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য একটা যৌথ কমিশন গঠন করা হবে; এবং পাকিস্তান সৌজন্য দেখিয়ে প্রতীকী অর্থে ২০ থেকে ৩০ কোটি ডলার দেবে দুই মাসের মধ্যে এই তিনটি দাবী সামনে রেখে মূলত ভুট্টোকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানালেও বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনা ছিল আরো বিস্তৃত। আরো যে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়িত হয়েছিল ভুট্টো ঢাকায় আসার পর, সেগুলো হচ্ছেঃ
১। আটকে পড়া বাঙ্গালীদের প্রত্যাবাসনঃ তখনো সামরিক, বেসামরিক কর্মকর্তা ছাড়াও তাদের পরিবারসহ দুই লাখ বাঙ্গালীকে পাকিস্তানে আটকে রেখেছিল ভুট্টোর সরকার। যেসব বাঙ্গালী পাকিস্তানের পক্ষে ছিল, তাদের কোন সমস্যা না হলেও যারা বাংলাদেশের পক্ষে ছিলেন, তাদের ভোগ করতে হয়েছিল অবর্নণীয় অত্যাচার। আটকে রেখে ক্রমাগত নির্যাতন করা হত তাদের, না পারতেন পালাতে, না পারতেন মরতে। বঙ্গবন্ধু শেষ পর্যন্ত তাদের স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন, বিনিময়ে পাকিস্তানের ৯১০০০ সেনাকে ফিরিয়ে দিতে হয়েছিল। মজার ব্যাপারটা হচ্ছে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে এই যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানী সেনাদের বিচার করার চুক্তি করেছিল পাকিস্তান, আজ পর্যন্ত তাদের কেশাগ্রও উৎপাটিত হয়নি। এই জানোয়ারেরা পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে নিরুপদ্রবে বাকি জীবন পার করে দিয়েছে। নির্লজ্জ বেহায়া গণহত্যাকারী দেশ পাকিস্তানের একাত্তর পরবর্তী নানা প্রজন্ম পেরিয়ে আজ আফ্রিদি-শোয়েব মালিক-জুনাইদ খানদের প্রজন্ম পর্যন্ত একজন পাকিস্তানীও এই অপরাধীদের কাঠগড়ায় নেবার চেষ্টা করেনি। স্রেফ ইমরান খানের চাচা নিয়াজীর পেনশনটা বাতিল হয়েছিল। কি চমৎকার বিচার, তাই না? আর আজ ৪৭ বছর পর সেই গণহত্যার সমর্থনকারী, নরপিশাচের লালনপালনকারী পাকিস্তানী আফ্রিদি-মিসবাহ-শোয়েব মালিকদের জন্য উল্লাসে গলা ফাটাই আমরা, পারলে তাদের কোলে উঠে যাই। আর বঙ্গবন্ধুকে গালি দেই ভুট্টোর সাথে তোলা ছবি দেখে।
২। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নতি দেখিয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ আন্তর্জাতিকভাবে ভালো একটা ইমেজ গড়ে তোলা এবং বিভিন্ন দেশের সমর্থন আদায় এবং দেশ গঠনের জন্য সাহায্য-সহযোগিতা প্রাপ্তি ছিল অন্যতম উদ্দেশ্য। কারণ সেই একাত্তর থেকেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাকফুটে ছিলাম আমরা, সোভিয়েত রাশিয়া আর ভারত ছাড়া আমেরিকা, চীন, সৌদি আরবসহ সকল মুসলিম দেশসহ প্রায় কোন দেশই সরাসরি আমাদের পক্ষে দাঁড়ায়নি, একাত্তরের পর আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে আমাদের অবস্থা আরো বাজে হয়ে পড়ে। কারণ পরাজিত নির্লজ্জ পাকিস্তান দুনিয়াজুড়ে আমাদের ব্যাপারে বিষ ছড়িয়ে যাচ্ছিল, মুসলিম দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানদের বলা হচ্ছিল যে, বাংলাদেশ ভারত দখল করে নিয়েছে, সেখানে মুসলমানদের উপর অত্যাচার চলছে। এই পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু অসাধারণ কূটনৈতিক দক্ষতায় একের পর এক মুসলিম রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন, ইউরোপ, আফ্রিকা এবং এশিয়ার নানা দেশ সফরের মাধ্যমে সেসব দেশের সাথে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলার পথ প্রশস্ত করেন এবং পাকিস্তানের শোষণ ও গ্ণহত্যার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসটা বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরেন। ফলে আস্তে আস্তে আমাদের দেশের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মনোভাব পাল্টাতে থাকে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তার অন্যতম একটি পদক্ষেপ ছিল ভুট্টোকে ঢাকায় আনা, যেন যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা দেশ হয়েও ইতিবাচকভাবে নিজেদের একটা শক্তিশালী ইমেজ গড়ে তোলা যায় এবং এই ইমেজ কাজে লাগিয়ে পাকিস্তানের মাথার উপরে থাকা আমেরিকা এবং চীনের উপর চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে নিজেদের দাবীগুলো আদায়ের ব্যবস্থা করা যায়। এই দাবীগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল সম্পদ বন্টন ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। বঙ্গবন্ধু জানতেন যে পাকিস্তান যতই চুক্তি করুক না কেন, তাদের সেনা কর্মকর্তা এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে না, তারা কোন না কোন ভাবে পাশ কাটাতে চেষ্টা করবে, তাই তিনি তার এই দাবী কখনোই ছাড়েননি।
৩। জাতিসংঘের সদস্যপদ প্রাপ্তি। যেহেতু পাকিস্তান বাংলাদেশকে সমর্থন দিতে বাধ্য হয়েছে, সুতরাং চীন তাদের ভেটো তুলে নেওয়ায় বাংলাদেশ লাভ করে জাতিসংঘের সদস্যপদ। আর সে বছরের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর বাংলায় ভাষণের মধ্য দিয়ে জাতিসংঘে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু। খুবই গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টটা হচ্ছে সেই ভাষণেও বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবী তুলেছিলেন, তুলেছিলেন পাকিস্তানের কাছে আমাদের প্রাপ্য সম্পদের দাবী। ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে লন্ডনে কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে বিষয়টি আবারও তোলা হয়। এবং ততদিনে আন্তর্জাতিকভাবে বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশের একটা ইতিবাচক ভাবমুর্তি তৈরি হওয়ায় পাকিস্তান এবং তার মিত্রদের জন্য এই দাবীগুলো ভয়ংকর অসস্তির সৃষ্টি করেছিল। ফলে বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে দেওয়া খুব বেশি জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাদের জন্য। যে বাংলাদেশের জন্য ৪৭-৭১ রাজপথ আর জেলেই কাটিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধের পরেও সেই বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের স্বার্থকে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে নিজের মৃত্যু ডেকে এনেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে তার মৃত্যুর পর ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২১ বছর বাংলাদেশের কোন সরকার আর দেশের স্বার্থ দেখেনি, পাকিস্তানের কাছ থেকে প্রাপ্য সম্পদ উদ্ধারের জন্য দাবী জানায়নি, পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবী জানায়নি। বরং পাকিস্তান এবং আইএসআই-এর প্রেসক্রিপশনে বাংলাদেশে ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদের শেকড় গেড়েছে খুব সুনিপুণভাবে।
আজ যারা ভুট্টোর সাথে বঙ্গবন্ধুর হাস্যজ্জ্বল ছবি দেখিয়ে বলতে চায় যে তোর বাপ বঙ্গবন্ধুই তো স্বাধীনতার পর ভুট্টোর সাথে কোলাকুলি করছিল, তখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গেছিল কই, তারা কখনো কল্পনাও করতে পারবে না যে সদ্য স্বাধীন জন্মানো শিশু বাংলাদেশের জন্য স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন সেই সময়ের পৃথিবীটা কত কঠিন ছিল, যেখানে বিশ্বমোড়লেরা গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত পাকিস্তানকে বাঁচানোর চেষ্টা করে চলছে প্রতিনিয়ত, মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাস ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে আন্তর্জাতিকভাবে, সেই মিত্রহীন পৃথিবীতে শত্রুর সাথে যুক্তি দিয়ে, ব্যক্তিত্ব দিয়ে, প্রজ্ঞা আর অকুতোভয় সাহস দিয়ে কূটনীতির কঠিন ময়দানে একলা লড়াই করে একটা পর একটা বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ভুট্টো বাংলাদেশ সফরকালে হঠাৎ বঙ্গবন্ধু দু-দেশের সম্পদ বাটোয়ারা সম্পর্কে প্রশ্ন উপস্থাপন করেন। দাবী জানান অতি দ্রুত বাংলাদেশের প্রাপ্য অংশ বুঝিয়ে দেবার। তখন থতমত খেয়ে ভুট্টো বলে যে সে অর্থনীতি বিভাগের কোনও লোক সঙ্গে আনেনি এবং চেক বইও ফেলে এসেছে। ভুট্টো চিন্তাও করেনি যে বাংলাদেশ এ বিষয়টা উপস্থাপন করবে।
এক পর্যায়ে ভুট্টো কোনভাবেই রাজী হচ্ছিলো না সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে যেতে। তখন বঙ্গবন্ধু বললেন, ভুট্টো যদি জাতীয় স্মৃতিসৌধে না যায় তবে তাকে দু’ঘণ্টার মধ্যে বাংলাদেশ ত্যাগ করতে হবে কারণ বাংলাদেশ তার সফর বাতিল করে দেবে। অপমানিত হওয়ার ভয়েই ভুট্টো সাভার সৃতিসৌধে গিয়েছিলেন। এরজন্য পাকিস্তানে নিন্দার ঝড় বয়ে গিয়েছিল, কেন ভুট্টো ৩০ লাখ শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে স্মৃতিসৌধে গেল, সেটার জন্য তাকে কাঠগড়ায় তুলেছিল আমাদের পাকিপ্রেমী প্রজন্মের মতে নান্নামুন্না নিষ্পাপ পাকিস্তানের জনগণ। সব কিছুরই প্রতিশোধ নিয়েছিল ভুট্টো। কারণ সে জানতো যে বাংলাদেশে এনে সুন্দর হেসে হেসে কথা বলে আসলে বঙ্গবন্ধু জিতে নিচ্ছিলেন, যদি তিনি বেঁচে থাকেন, পাকিস্তানকে পাই পাই করে বাংলাদেশের প্রাপ্য হিসেব দিতে হবে, পাকইস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে। সেদিন ভুট্টো এই কথাটা বুঝতেপারলেও আজ ৪৭ বছর পর বঙ্গবন্ধুর উত্তরসুরি হয়ে আমরা সেটা বুঝতে চাই না, বরং একটা রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে আরেক রাষ্ট্রের প্রধান ভুট্টোর প্রতি কূটনৈতিক শিষ্টাচার পালন করা বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানপ্রেমী বানিয়ে দেই! আমাদের মতন অকৃতজ্ঞ আর কে আছে!
ভুট্টো এবং পাকিস্তানের জন্য সবচেয়ে অপমানজনক ছিল গণহত্যা চালিয়ে শেষ করে দিতে চাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া। এটা ছিল বাংলাদেশের জন্য অন্যতম বড় বিজয়ও। কারণ ১৯৭৩ সালে প্রণীত পাকিস্তানের সংবিধানে ভুট্টো ‘পূর্ব পাকিস্তান’ শব্দটি বহাল রেখেছিল! তখনো ভুট্টো বাংলাদেশকে বলতো ইস্ট পাকিস্তান, স্বপ্ন দেখতো আবার বাংলাদেশ দখল করে নেওয়ার। তারই প্রমাণ পাওয়া যায় পাকিস্তানের সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে, সেখানে বলা হয়েছে “পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের জনগণ যখন বিদেশি আগ্রাসন থেকে মুক্ত হতে পারবে এবং তার প্রভাব-প্রতিপত্তির বাইরে আসতে পারবে, তখন সেটি ফেডারেশনের প্রতিনিধিত্ব করবে”। মজার ব্যাপার কি জানেন, আজো পাকিস্তানের সংবিধানে এই ধারাটা আছে, তারা আজো বাংলাদেশকে আবার দখলের স্বপ্ন দেখে। এহেন বাংলাদেশকে যখন স্রেফ বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় কূটনীতিতে বাধ্য হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হয়েছিল, তখন এর চেয়ে বড় অপমান অবশ্যই আর কিছুই হতে পারে না। ভুট্টো এবং তার পাকিস্তান এই অপমানের বদলা নিয়েছিল ১৯৭৫ সালে, বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনের কুশীলব হয়ে এবং তারপরের আজ ৪২ বছর ধরে স্বাধীন বাংলাদেশের একটা বিশাল অংশের জনগণকে পাকিস্তানপ্রেমী হিসেবে গড়ে তুলতে সফল হয়ে। এরাই আজ ১৯৭৪ সালের ভুট্টোর সফরের জন্য বঙ্গবন্ধুকে দোষারোপ করে, এরাই পাকিস্তানের জয়ে গলা ফাটিয়ে উল্লাস করে, এদেরই একটা অংশ স্বাধীনতার মাত্র ৩ বছরের মাথায় ৩০ লাখ শহীদের রক্তাক্ত এই জমিনে ভুট্টোকে স্যান্ডেল এবং পচা ডিম ছুঁড়ে মারার বদলে সাদরে সম্ভাষণ জানিয়েছিল, ফুলেল অভ্যররথনা জানিয়ে বরণ করে নিয়েছিল। জাতি হিসেবে এর চেয়ে বড় লজ্জার আর কি হতে পারে?
চলুন ভুট্টোর সফরের সময় তাকে দেখতে জড়ো হওয়া এবং অভ্যর্থনা জানানো বাঙ্গালীদের ব্যাপারে একজন প্রত্যক্ষদর্শী মতিউর রহমানের সাক্ষ্য পড়ে আসিঃ
১৯৭৪ সালে ভুট্টোকে যে কূটনীতির মারপ্যাঁচে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে এবং বাংলাদেশে আসতে বাধ্য করেছিলেন বঙ্গবন্ধু, সেই অপমানের প্রতিশোধ ভুট্টো কিভাবে নিয়েছিল, কিভাবে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের পেছনে কলকাঠি নেড়েছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে, ইতিহাসের সেই দলিলগুলো একবার দেখে আসি চলুনঃ
১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ কমনওয়েলথের সদস্যপদের আবেদন করলে ভুট্টো বিরোধিতা করেন। তাঁর দাবি, বাংলাদেশ পাকিস্তানের অংশ। ভুট্টোর এই আচরণে বঙ্গবন্ধু ক্ষুব্ধ হন। ১৫ জানুয়ারি লন্ডনের অবজারভার–এর গ্যাভিন ইয়ংকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘ভুট্টো যদি বাংলাদেশের কমনওয়েলথ সদস্যপদ পেতে বাধা দেন বা চালাকি করেন, আমি পশ্চিম পাকিস্তানের দখল নেব এবং সেটিকেও বাংলাদেশের অংশ করব। আমিই পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। আর তিনি সেনাবাহিনীর কৃপায় সেই দেশটির প্রেসিডেন্ট। গণতান্ত্রিকভাবে আমি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং সেখানকার প্রদেশগুলোতে আমি আমার লোকজনকে নিয়োগ দেব।’
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শেষে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুর সামনে তখন একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, যার ৮০ ভাগের উপর রাস্তাঘাট, ব্রিজ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত, ভাঙা, গৃহস্থের গোয়ালায় গরু নেই, পেটে ভাত নেই, ফসলের জমি পোড়া, ফসল নেই, নদীতে মাছ আছে কিন্তু নদীতে তার চেয়ে বেশি লাশ। মাছগুলো সেই লাশকেই তাদের আধার বানিয়েছে। যার ফলে জেলেরা সেই মাছ ধরেও না আবার মানুষ সেই মাছ খায়ও না। কোটি কোটি ক্ষুধার্থ মুখ, নিঃস্ব অর্থনীতি, শূন্য ব্যাংক। অজস্র শহীদ স্বজনের চাপা আর্তনাদে ভারী বাংলাদেশ, ভারতে বন্দী ৯১০০০ যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানী সেনার বিচার করতে হবে। বিচার করতে হবে গণহত্যার সাথে জড়িত বিহারীদের, পাকিস্তানে ফেরত পাঠাতে হবে বাকি বিহারীদের। কিন্তু ওদিকে পাকিস্তানে মৃত্যুর অপেক্ষায় আটকে আছে সাড়ে তিন থেকে চার লাখ বাঙ্গালী, যদি এদিকে বাংলাদেশ পাকিস্তানীদের বিচার করে, তাহলে ওদিকে বাঙ্গালীদের জীবন বিপন্ন, বিহারীদেরও ফিরিয়ে নেবে না পাকিস্তান।
এমন কঠিন অবস্থায় বঙ্গবন্ধু সবার আগে দেশ গঠনে মনোযোগ দিলেন। সাহায্য চাইলেন আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠী থেকে শুরু করে সকল রাষ্ট্রের কাছে, এমনকি যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তীব্র বিরোধিতা করেছিল, তাদের কাছেও দেশটা গড়ে তুলতে সাহায্য চাইলেন। কারণ ওচিত্যবোধের চেয়েও জাতির জনকের কাছে তখন তার দেশের মানুষের মুখে দুবেলা দুমুঠো খাবার তুলে দেওয়া বেশি জরুরী। মজার ব্যাপারটা হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় সামান্য সহায়তা না করলেও, ক্ষেত্রবিশেষে প্রবল বিরোধিতা করলেও স্বাধীন বাংলাদেশকে ঋণ দেয়ার সময় দাতাগোষ্ঠীরা বললো, পাকিস্তান আমলে নেওয়া ঋণের দায়ভার দিতে হবে বাংলাদেশকেই। কিন্তু বাংলাদেশ বরাবরই বলে এসেছে, একাত্তর-পূর্ববর্তী সব দায়দেনা পাকিস্তানকেই মেটাতে হবে। দাতাগোষ্ঠী পাকিস্তানের প্রতি ছিল সহানুভূতিশীল। তারা বেশ কয়েকবার দেনা পরিশোধের সময়সীমা পরিমার্জন করেছিল। অন্যদিকে দেনার একটা অংশ যাতে বাংলাদেশ বহন করে, সে জন্য আন্তর্জাতিক চাপ ছিল। ওই সময় বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের ঋণের দায় নেবার চাপ দিলে বঙ্গবন্ধু দৃঢ়তার সঙ্গে এই দায় নিতে অস্বীকার করেছিলেন।
এই চাপটাও ঠিক তখন এসেছে, যখন আমরা পাকিস্তানের কাছ থেকে আমাদের প্রাপ্য সম্পদের ভাগ চাচ্ছি। ১৯৭৪ সালে করা এক হিসাবে দেখা যায়, পাকিস্তানের সম্পদে বাংলাদেশের দাবির আর্থিক মূল্য প্রায় ৪০০ কোটি ডলার। এর সঙ্গে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির আনুমানিক দাম ধরা হয়েছিল আরও ১০০ থেকে ১৫০ কোটি ডলার। ১৯৭১-৭২ সালের মূল্যমান অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট প্রাপ্য হিসাব করা হয়েছিল ৫০০ থেকে ৫৫০ কোটি ডলার। যদিও পরবর্তীতে কানাডার ট্রেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এ চৌধুরী ও এস এ বাশার বিস্তারিত এক গবেষণায় দেখিয়েছিলেন যে আমাদের মোট প্রাপ্যের পরিমাণ ২৩০০ কোটি ডলারেরও বেশি, কিন্তু তখনকার সময়ে এই সাড়ে পাঁচশো কোটি ডলারই পাকিস্তানের কাছ থেকে আদায় করা বিশাল চ্যালেঞ্জ ছিল। কারণ নির্লজ্জ পাকিস্তানীদের সাথে যোগ দিয়েছিল গণহত্যার পক্ষে থাকা বিশ্বমোড়লেরা। সবচেয়ে মজার ব্যাপারটা ছিল, পাকিস্তানের যে ঋণের দায়ভার আমাদের উপর চাপানোর চেষ্টা করা হচ্ছিল, সেটাও মওকুফযোগ্য হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল দাতারা, যদি আমরা বন্দী পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর বিচার বাতিল করি।
তার মানে কি দাঁড়ালো বুঝতে পারছেন? পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের বিচার বাতিল করো, তাদের ফিরিয়ে দাও, প্রাপ্য টাকা চেয়ো না, পাকিস্তানের কোন অপরাধের বিচার চেয়ো না, ব্যাস, আমরা বাংলাদেশকে সব ধরণের সহায়তা করতে রাজি আছি। ঠিক এটাই ছিল তৎকালীন বিশ্বমোড়লদের প্রস্তাব। জাতিসংঘের সদস্যপদ পাচ্ছি না আমরা কারণ পাকিস্তানের পেয়ারে দিওয়ানা চীন ভেটো দিয়ে যাচ্ছে বারবার, বলছে পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের বিচার বাতিল করো, আমরা স্বীকৃতি দিচ্ছি, জাতিসংঘেও সদস্যপদ পাবে। তারা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল, “After resolution of the war trials issue, Peking will recognise Dacca, and the way will be open for Bangladesh to be admitted to the United Nations”
বাংলাদেশকে এভাবে আন্তর্জাতিকভাবে চাপে রেখে সিমলায় ইন্দিরা গান্ধীর সাথে ভুট্টো বসলো দুই দেশের বৈরিভাব দূর করে যুদ্ধবন্দীদের মুক্ত করতে। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, ভারতের কাছে যারা যুদ্ধবন্দী তারাই আবার বাংলাদেশের কাছে যুদ্ধাপরাধী। সুতরাং দুই পক্ষের বৈঠকে এ মীমাংসা হবার নয়। এখানে ত্রিপাক্ষিক বৈঠক হতে হবে। সেখানে নির্লজ্জ বেইমান ভুট্টো ইন্দিরা গান্ধীকে এর জবাবে বললো, “যদি বাংলাদেশ একজন সেনা সদস্যের বিচারও শুরু করে তাহলে পাকিস্তানও পাকিস্তানে থাকা বাঙ্গালিদের রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে বিচার করবে”। ভুট্টোর ইকুয়েশনটা বুঝতে পেরেছেন?
ওদিকে ১৯৭২ সাল থেকেই বাংলাদেশি পাসপোর্টে হজ্জে যাওয়া বন্ধ। কেন জানেন? পুরো একাত্তরের সময়টায় পাকিস্তানকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে লাখো বাঙ্গালী ভাইদের পৈশাচিক হত্যাকান্ডে সমর্থন দেবার জন্য দুঃখ প্রকাশ কিংবা ক্ষমা চাওয়া তো বহু দূরে থাক, সৌদি আরব ১৯৭২ সাল থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের পাসপোর্টে মুসলমানদের হজে যাওয়া বন্ধ করেছিল কারণ বাংলাদেশ গণহত্যার অপরাধে ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী সেনা কর্মকর্তার বিচারের দাবীতে অটল ছিল। শুধু সৌদি আরব নয়, মধ্যপ্রাচ্যের বাকি মুসলিম রাষ্ট্রগুলোও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিয়ে ঠিক এই দাবীই জানিয়েছিল যে, পাকিস্তানের দাবী মেনে নাও, বিচার বাতিল কর।
খুব জানতে ইচ্ছা করে মাঝে মাঝে, এমন ভয়ংকর এক সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকে গালাগালি দেওয়া আমাদের অনলাইন বিপ্লবীরা কি করতেন? কিভাবে প্রবল চাপের মুখে দাঁড়িয়েও নিজের দেশের, জনগণের স্বার্থটা বের করে নিয়ে আসতেন? বঙ্গবন্ধু কিন্তু একবারও পিছু হটেননি। এমন কোণঠাসা বাংলাদেশকে নিয়ে গেলেন ন্যামে। নন এলাইড মুভমেন্ট নামে ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া একটা অর্গানাইজেশন। যেখানে রয়েছে মার্কিন-সোভিয়েত প্রভাবমুক্ত ২৫টি উন্নয়নশীল দেশ। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন যে তাকে সোভিয়েত-আমেরিকার প্রভাবের বাইরে থাকা রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে এগোতে হবে, আউট অফ বক্স কিছু করতে হবে। সে চিন্তা থেকেই ন্যাম সম্মেলনে দুর্দান্ত কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে মিশর, লিবিয়াকে সাথে নিয়ে আরেকবার মধ্যপ্রাচ্যের সাথে সম্পর্ক করার প্রচেষ্টা নিলেন। মিশরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত সত্যিকারের বন্ধুর মত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়ে প্রথমে সৌদি আরবকে রাজি করালেন, তারপর সৌদি বাদশাহ ফয়সাল, আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বুমেডিয়েনসহ মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর প্রধানদের নিয়ে নতুন করে অচলাবস্থা নিরসনের উদ্যোগ নিলেন।
এই উদ্যোগের প্রাথমিক সাফল্য এলো আন্তর্জাতিক আদালতে যখন ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানের মামলা প্রত্যাহার করলো। পাঠক নিশ্চয়ই একটু অবাক হয়ে ভাবছেন, পাকিস্তান আবার ভারতের বিরুদ্ধে কবে মামলা করলো? জ্বি, নির্লজ্জ ভুট্টো আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী হস্তান্তর করবার জন্য। ভারত নাকি অন্যায়ভাবে এই ১৯৫ জনকে আটকে রেখেছে, তাই এই যুদ্ধাপরাধীদের হস্তান্তরে বাধ্য করার জন্যই পাকিস্তান আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করতে চাচ্ছিল! যাক, মামলার সকল কাগজপত্র জমা দেবার তারিখ ১৫ই ডিসেম্বর ১৯৭৩ থেকে ১৭ই মে ১৯৭৪ পর্যন্ত বর্ধিত করা হলেও মিশর ও আরব লীগের নেতৃবৃন্দ অচলাবস্থা কাটাবার উদ্যোগ নেওয়ায় শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান ১৯৭৩ সালের ১৪ই ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক আদালতের রেজিষ্টারের কাছে একটি চিঠিতে মামলাটি আর না চালাবার সিদ্ধান্ত জানায় এবং মামলাটি আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারাধীন মামলার তালিকা থেকে বাদ দেবার জন্য অনুরোধ জানায় । এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাষ্টিস ১৫ ই ডিসেম্বর ১৯৭৩ এক আদেশের মাধ্যমে, আদেশ নং – ৩৯৩, এই মামলাটি বাতিল ঘোষনা করে এবং তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
আন্তর্জাতিক আদালত থেকে পাকিস্তানের মামলাটি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত আরবলীগ নেতৃবৃন্দের একটি বড় কূটনৈতিক সাফল্য বলে বিবেচিত হয়। তাই তারা এই ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যকার বিদ্যমান সমস্যা ভারতের মধ্যস্থতা ব্যতীত সরাসরি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা শুরু করে। বাধ্য হয়েই বঙ্গবন্ধুকে সেই প্রস্তাব মেনে নিতে হয়, কারণ পাকিস্তানের বিপক্ষে কূটনীতিতে জিততে আরব লীগের সমর্থন দরকার বাংলাদেশের। বাংলাদেশের কাছ থেকে এই সম্মতি পেয়ে আরব লীগ নেতৃবৃন্দ এবার পাকিস্তানের উপর চাপ প্রয়োগ শুরু করে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দান করার জন্য। কারণ এর মাধ্যমে পাকিস্তান বাধ্য হবে একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের দাবীগুলো নিয়ে কথা বলতে, আলোচনার টেবিলে বসতে। এই চেষ্টার জবাবে জুলফিকার আলী ভূট্টো কি বলেছিল জানেন? বাংলাদেশ ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রত্যাহার করলেই কেবলমাত্র পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে।
সেই পুরান ক্যাচাল! আমাদের নানামুন্না নিষ্পাপ বাচ্চাগুলোকে ছেড়ে দাও, আমরা সব দাবী মেনে নিচ্ছি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এতো চাপের মুখেও একটাবারের জন্যও পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবী থেকে একচুল সরেননি। কিন্তু পাকিস্তান ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে গেছে তাদের নরপিশাচ গণহত্যাকারীদের বাঁচানোর। ১৯৭৪ সালের ২২-২৪ শে ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিতব্য ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনকে কেন্দ্র করে আরব লীগের নেতৃবৃন্দ জোর তৎপরতা শুরু করে। কারণ বাংলাদেশ তখনো ওআইসির সদস্য নয়। যদি বাংলাদেশকে ওআইসির সদস্য করে সম্মেলনে দাবীগুলো নিয়ে আলোচনা চালানো যায়, সেই চেষ্টা চলতে থাকে। কিন্তু সম্মেলন শুরুর আগে প্রায় সকল সদস্য রাষ্ট্রের সম্মতি থাকা সত্বেও (ইরান, তুরস্ক ও পাকিস্তান ব্যতীত) সেই পাকিস্তানের আপত্তির কারণে বাংলাদেশের ওআইসির সদস্যপদ আবারো অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে।
শেষ পর্যন্ত উপায়ান্তর না দেখে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, সৌদি রাজা ফয়সাল এবং জর্ডানের রাজা হুসেইন এর উদ্যোগে সাতটি মুসলিম দেশের প্রতিনিধি ঢাকা সফর করে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের উদ্যোগ থেকে সরে আসার জন্য বঙ্গবন্ধুকে রাজী করাতে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এই শর্তসাপেক্ষে পাকিস্তানের স্বীকৃতি গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান এবং এই বিষয়ে আরো আলোচনা প্রয়োজন বলে অভিমত দেন।
স্রেফ একবার ভাবেন তো, কতটা প্রজ্ঞা আর দৃঢ়তা থাকলে এতগুলো নেতৃস্থানীয় মুসলিম দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের চাপ উপেক্ষা করে নিজের দেশের স্বার্থে অটল থাকা যায়! বঙ্গবন্ধু বরং উল্টো জানিয়ে দেন যে তিনি ওআইসির সম্মেলনেই এই ব্যাপারে আলোচনা করতে চান। বঙ্গবন্ধুর দৃঢ়তা দেখে এই প্রতিনিধিদল পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভূট্টোর সাথে সাক্ষাৎ করে এবং সেখানে তারা বঙ্গবন্ধুর স্পষ্ট ও দৃঢ় অবস্থান জানায়। একইসাথে তারা যুদ্ধাপরাধী সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলাদেশের ওআইসি সম্মেলনে অংশগ্রহণের গুরুত্ব তুলে ধরে।
এই প্রবল অচলাবস্থায় শেষ পর্যন্ত পরাজয় ঘটে ভুট্টোর। আরব লীগ নেতৃবৃন্দের প্রবল চাপে অনেকটা নাটকীয়ভাবে ১৯৭৪ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারী পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করতে বাধ্য হয়। একই দিন ইরান এবং তুরস্কও বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশ কূটনৈতিক বিজয় ছিনিয়ে আনে জন্মশত্রু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে! আর এর পুরো কৃতিত্বই বঙ্গবন্ধুর। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বেই আসে এই জয়।
তবে এই অনমনীয় দৃঢ়তা ঠিক দেড় বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের প্রথম বীজ বপন করে। যার বাহ্যিক ইঙ্গিত ছিল চীন ও সৌদি আরবের স্বীকৃতি না দেওয়া। পাকিস্তান স্বীকৃতি দিলেও যুদ্ধাপরাধী সমস্যা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানে অস্বীকৃতি জানায়। এর মাধ্যমে পাকিস্তান আরব লীগ নেতৃবৃন্দের কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় কৌশলগত কারনে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েও চীনের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া থেকে সরে না আসা পর্যন্ত জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করার ব্যাপারটি আটকে রাখে ।
২২ শে ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানের স্বীকৃতি লাভ করার পর বাংলাদেশের একই দিন থেকে লাহোরে অনুষ্ঠিতব্য ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেয়াতে আর কোন বাধা থাকেনা। জাতিসংঘের স্বীকৃতি আটকে গেলেও বঙ্গবন্ধুর এক প্রকার একলা প্রচেষ্টায় এই যে ওআইসিতে যোগ দিলো বাংলাদেশ, এটা আরেকবার আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে বঙ্গবন্ধুর সাফল্য প্রমাণ করে। এই অবস্থায় ২২শে ফ্রেব্রুয়ারী সকালে কুয়েতের আমীরের ভাই কুয়েতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে মুসলিম দেশগুলির একটি প্রতিনিধিদল একটি বিশেষ বিমানে করে ঢাকা আসেন এবং বঙ্গবন্ধুকে এসকর্ট করে লাহোরে নিয়ে যান ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেবার জন্য । ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় যে বঙ্গবন্ধুর কারাগারের পাশে কবর খোঁড়া হত তাকে দেখিয়ে, সেই পাকিস্তানে এবার স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে পা রাখেন তিনি। সেই পাকিস্তানীরাই তাকে সাদর অভিবাদন জানাতে বাধ্য হয়। স্রেফ পাকিস্তানীদের মত নির্লজ্জ গোঁয়ারদের জন্য লজ্জারই না, বরং সদ্য স্বাধীন একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও এটা ছিল অনেক বড় এক অর্জন!
আর এর পথে ধরেই এসেছিল জাতিসংঘের ১৩৬ তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রাপ্তি। যেহেতু পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে, সুতরাং বাধ্য হয়েই চীন তাদের ভেটো তুলে নেয় এবং বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পায়। প্রথমে কমনওয়েলথ, তারপর ওআইসি, তারপর ইরান, তুরস্ক এবং প্রধান শত্রু পাকিস্তানের স্বীকৃতি এবং শেষে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ - কূটনৈতিকভাবে এটা বাংলাদেশের জন্য বিশাল একগুচ্ছ সাফল্য হলেও এর জন্য ঘরে বাইরে সবচেয়ে বড় মাশুল দিতে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকেই। অনেকেই ইসলামী সম্মেলনে যোগ দেওয়াকে ভাবছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ নীতির সাথে আপোষ করা, বিচ্যুত হওয়া। কিন্তু যে সমাধানটা কেউ দিতে পারেননি সেটা হচ্ছে, আরব-আফ্রিকার নেতৃবৃন্দ যথা মিশরের আনোয়ার সাদাত, আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ারি বুমেদিন, লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফি, প্যালেস্টাইনের প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাত ও ইরানের শাহ - এর দূতিয়ালিতে যদি বঙ্গবন্ধু ওআইসিতে গিয়ে পাকিস্তানের উপর চাপ প্রয়োগের সুযোগটা না গ্রহণ করতেন, তাহলে আর কারা আমাদের দাবী পূরণে এগিয়ে আসতো?
এক ভারত আর সোভিয়েত রাশিয়া ছাড়া তো বাকি সবাইই আমাদের বিপক্ষে ছিল, বিরুদ্ধে ছিল, আমাদের দাবীগুলো আদায় হত কিভাবে? এই যে ধাপে ধাপে বিশ্বমোড়লদের বিপক্ষে একলা দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু একেবারেই অসম্ভব একটা কূটনৈতিক যুদ্ধ চালালেন এবং আমাদের দাবী নিয়ে অন্তত আলোচনার স্থান ও পরিধি ক্রমেই বাড়াতে সক্ষম হলেন (এরপর জাতিসংঘে গিয়েও বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবী তুলেছিলেন), তার জন্য যে তাকে নিজের জীবন দিয়ে মুল্য চুকাতে হয়েছিল, এই ঘটনাপ্রবাহ কি একবারও আমরা ভেবে দেখতে চেয়েছি?
এখন ভুট্টো আশা করেছিল যে বঙ্গবন্ধুকে লাহোরে ওআইসির এই সম্মেলনে এনে আরব দেশগুলোকে দিয়ে চাপ দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ওআইসিতে এমন শক্ত অবস্থান নিলেন যে পাকিস্তানের পক্ষে সরাসরি কোন সিদ্ধান্ত আসলো না। ওদিকে যেহেতু বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সফরে গেছেন, স্বাভাবিক কূটনৈতিক শিষ্টাচার রক্ষা করতে বাংলাদেশে ভুট্টোকে আসতে হবে। পাকিস্তানের সব সম্পদ ও দায়দেনা উভয় দেশ সমান ভাগ করে নেবে; ভাগ-বাঁটোয়ারার বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য একটা যৌথ কমিশন গঠন করা হবে; এবং পাকিস্তান সৌজন্য দেখিয়ে প্রতীকী অর্থে ২০ থেকে ৩০ কোটি ডলার দেবে দুই মাসের মধ্যে এই তিনটি দাবী সামনে রেখে মূলত ভুট্টোকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানালেও বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনা ছিল আরো বিস্তৃত। আরো যে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়িত হয়েছিল ভুট্টো ঢাকায় আসার পর, সেগুলো হচ্ছেঃ
১। আটকে পড়া বাঙ্গালীদের প্রত্যাবাসনঃ তখনো সামরিক, বেসামরিক কর্মকর্তা ছাড়াও তাদের পরিবারসহ দুই লাখ বাঙ্গালীকে পাকিস্তানে আটকে রেখেছিল ভুট্টোর সরকার। যেসব বাঙ্গালী পাকিস্তানের পক্ষে ছিল, তাদের কোন সমস্যা না হলেও যারা বাংলাদেশের পক্ষে ছিলেন, তাদের ভোগ করতে হয়েছিল অবর্নণীয় অত্যাচার। আটকে রেখে ক্রমাগত নির্যাতন করা হত তাদের, না পারতেন পালাতে, না পারতেন মরতে। বঙ্গবন্ধু শেষ পর্যন্ত তাদের স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন, বিনিময়ে পাকিস্তানের ৯১০০০ সেনাকে ফিরিয়ে দিতে হয়েছিল। মজার ব্যাপারটা হচ্ছে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে এই যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানী সেনাদের বিচার করার চুক্তি করেছিল পাকিস্তান, আজ পর্যন্ত তাদের কেশাগ্রও উৎপাটিত হয়নি। এই জানোয়ারেরা পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে নিরুপদ্রবে বাকি জীবন পার করে দিয়েছে। নির্লজ্জ বেহায়া গণহত্যাকারী দেশ পাকিস্তানের একাত্তর পরবর্তী নানা প্রজন্ম পেরিয়ে আজ আফ্রিদি-শোয়েব মালিক-জুনাইদ খানদের প্রজন্ম পর্যন্ত একজন পাকিস্তানীও এই অপরাধীদের কাঠগড়ায় নেবার চেষ্টা করেনি। স্রেফ ইমরান খানের চাচা নিয়াজীর পেনশনটা বাতিল হয়েছিল। কি চমৎকার বিচার, তাই না? আর আজ ৪৭ বছর পর সেই গণহত্যার সমর্থনকারী, নরপিশাচের লালনপালনকারী পাকিস্তানী আফ্রিদি-মিসবাহ-শোয়েব মালিকদের জন্য উল্লাসে গলা ফাটাই আমরা, পারলে তাদের কোলে উঠে যাই। আর বঙ্গবন্ধুকে গালি দেই ভুট্টোর সাথে তোলা ছবি দেখে।
২। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নতি দেখিয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ আন্তর্জাতিকভাবে ভালো একটা ইমেজ গড়ে তোলা এবং বিভিন্ন দেশের সমর্থন আদায় এবং দেশ গঠনের জন্য সাহায্য-সহযোগিতা প্রাপ্তি ছিল অন্যতম উদ্দেশ্য। কারণ সেই একাত্তর থেকেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাকফুটে ছিলাম আমরা, সোভিয়েত রাশিয়া আর ভারত ছাড়া আমেরিকা, চীন, সৌদি আরবসহ সকল মুসলিম দেশসহ প্রায় কোন দেশই সরাসরি আমাদের পক্ষে দাঁড়ায়নি, একাত্তরের পর আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে আমাদের অবস্থা আরো বাজে হয়ে পড়ে। কারণ পরাজিত নির্লজ্জ পাকিস্তান দুনিয়াজুড়ে আমাদের ব্যাপারে বিষ ছড়িয়ে যাচ্ছিল, মুসলিম দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানদের বলা হচ্ছিল যে, বাংলাদেশ ভারত দখল করে নিয়েছে, সেখানে মুসলমানদের উপর অত্যাচার চলছে। এই পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু অসাধারণ কূটনৈতিক দক্ষতায় একের পর এক মুসলিম রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন, ইউরোপ, আফ্রিকা এবং এশিয়ার নানা দেশ সফরের মাধ্যমে সেসব দেশের সাথে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলার পথ প্রশস্ত করেন এবং পাকিস্তানের শোষণ ও গ্ণহত্যার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসটা বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরেন। ফলে আস্তে আস্তে আমাদের দেশের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মনোভাব পাল্টাতে থাকে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তার অন্যতম একটি পদক্ষেপ ছিল ভুট্টোকে ঢাকায় আনা, যেন যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা দেশ হয়েও ইতিবাচকভাবে নিজেদের একটা শক্তিশালী ইমেজ গড়ে তোলা যায় এবং এই ইমেজ কাজে লাগিয়ে পাকিস্তানের মাথার উপরে থাকা আমেরিকা এবং চীনের উপর চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে নিজেদের দাবীগুলো আদায়ের ব্যবস্থা করা যায়। এই দাবীগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল সম্পদ বন্টন ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। বঙ্গবন্ধু জানতেন যে পাকিস্তান যতই চুক্তি করুক না কেন, তাদের সেনা কর্মকর্তা এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে না, তারা কোন না কোন ভাবে পাশ কাটাতে চেষ্টা করবে, তাই তিনি তার এই দাবী কখনোই ছাড়েননি।
৩। জাতিসংঘের সদস্যপদ প্রাপ্তি। যেহেতু পাকিস্তান বাংলাদেশকে সমর্থন দিতে বাধ্য হয়েছে, সুতরাং চীন তাদের ভেটো তুলে নেওয়ায় বাংলাদেশ লাভ করে জাতিসংঘের সদস্যপদ। আর সে বছরের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর বাংলায় ভাষণের মধ্য দিয়ে জাতিসংঘে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু। খুবই গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টটা হচ্ছে সেই ভাষণেও বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবী তুলেছিলেন, তুলেছিলেন পাকিস্তানের কাছে আমাদের প্রাপ্য সম্পদের দাবী। ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে লন্ডনে কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে বিষয়টি আবারও তোলা হয়। এবং ততদিনে আন্তর্জাতিকভাবে বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশের একটা ইতিবাচক ভাবমুর্তি তৈরি হওয়ায় পাকিস্তান এবং তার মিত্রদের জন্য এই দাবীগুলো ভয়ংকর অসস্তির সৃষ্টি করেছিল। ফলে বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে দেওয়া খুব বেশি জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাদের জন্য। যে বাংলাদেশের জন্য ৪৭-৭১ রাজপথ আর জেলেই কাটিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধের পরেও সেই বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের স্বার্থকে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে নিজের মৃত্যু ডেকে এনেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে তার মৃত্যুর পর ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২১ বছর বাংলাদেশের কোন সরকার আর দেশের স্বার্থ দেখেনি, পাকিস্তানের কাছ থেকে প্রাপ্য সম্পদ উদ্ধারের জন্য দাবী জানায়নি, পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবী জানায়নি। বরং পাকিস্তান এবং আইএসআই-এর প্রেসক্রিপশনে বাংলাদেশে ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদের শেকড় গেড়েছে খুব সুনিপুণভাবে।
আজ যারা ভুট্টোর সাথে বঙ্গবন্ধুর হাস্যজ্জ্বল ছবি দেখিয়ে বলতে চায় যে তোর বাপ বঙ্গবন্ধুই তো স্বাধীনতার পর ভুট্টোর সাথে কোলাকুলি করছিল, তখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গেছিল কই, তারা কখনো কল্পনাও করতে পারবে না যে সদ্য স্বাধীন জন্মানো শিশু বাংলাদেশের জন্য স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন সেই সময়ের পৃথিবীটা কত কঠিন ছিল, যেখানে বিশ্বমোড়লেরা গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত পাকিস্তানকে বাঁচানোর চেষ্টা করে চলছে প্রতিনিয়ত, মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাস ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে আন্তর্জাতিকভাবে, সেই মিত্রহীন পৃথিবীতে শত্রুর সাথে যুক্তি দিয়ে, ব্যক্তিত্ব দিয়ে, প্রজ্ঞা আর অকুতোভয় সাহস দিয়ে কূটনীতির কঠিন ময়দানে একলা লড়াই করে একটা পর একটা বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ভুট্টো বাংলাদেশ সফরকালে হঠাৎ বঙ্গবন্ধু দু-দেশের সম্পদ বাটোয়ারা সম্পর্কে প্রশ্ন উপস্থাপন করেন। দাবী জানান অতি দ্রুত বাংলাদেশের প্রাপ্য অংশ বুঝিয়ে দেবার। তখন থতমত খেয়ে ভুট্টো বলে যে সে অর্থনীতি বিভাগের কোনও লোক সঙ্গে আনেনি এবং চেক বইও ফেলে এসেছে। ভুট্টো চিন্তাও করেনি যে বাংলাদেশ এ বিষয়টা উপস্থাপন করবে।
এক পর্যায়ে ভুট্টো কোনভাবেই রাজী হচ্ছিলো না সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে যেতে। তখন বঙ্গবন্ধু বললেন, ভুট্টো যদি জাতীয় স্মৃতিসৌধে না যায় তবে তাকে দু’ঘণ্টার মধ্যে বাংলাদেশ ত্যাগ করতে হবে কারণ বাংলাদেশ তার সফর বাতিল করে দেবে। অপমানিত হওয়ার ভয়েই ভুট্টো সাভার সৃতিসৌধে গিয়েছিলেন। এরজন্য পাকিস্তানে নিন্দার ঝড় বয়ে গিয়েছিল, কেন ভুট্টো ৩০ লাখ শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে স্মৃতিসৌধে গেল, সেটার জন্য তাকে কাঠগড়ায় তুলেছিল আমাদের পাকিপ্রেমী প্রজন্মের মতে নান্নামুন্না নিষ্পাপ পাকিস্তানের জনগণ। সব কিছুরই প্রতিশোধ নিয়েছিল ভুট্টো। কারণ সে জানতো যে বাংলাদেশে এনে সুন্দর হেসে হেসে কথা বলে আসলে বঙ্গবন্ধু জিতে নিচ্ছিলেন, যদি তিনি বেঁচে থাকেন, পাকিস্তানকে পাই পাই করে বাংলাদেশের প্রাপ্য হিসেব দিতে হবে, পাকইস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে। সেদিন ভুট্টো এই কথাটা বুঝতেপারলেও আজ ৪৭ বছর পর বঙ্গবন্ধুর উত্তরসুরি হয়ে আমরা সেটা বুঝতে চাই না, বরং একটা রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে আরেক রাষ্ট্রের প্রধান ভুট্টোর প্রতি কূটনৈতিক শিষ্টাচার পালন করা বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানপ্রেমী বানিয়ে দেই! আমাদের মতন অকৃতজ্ঞ আর কে আছে!
ভুট্টো এবং পাকিস্তানের জন্য সবচেয়ে অপমানজনক ছিল গণহত্যা চালিয়ে শেষ করে দিতে চাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া। এটা ছিল বাংলাদেশের জন্য অন্যতম বড় বিজয়ও। কারণ ১৯৭৩ সালে প্রণীত পাকিস্তানের সংবিধানে ভুট্টো ‘পূর্ব পাকিস্তান’ শব্দটি বহাল রেখেছিল! তখনো ভুট্টো বাংলাদেশকে বলতো ইস্ট পাকিস্তান, স্বপ্ন দেখতো আবার বাংলাদেশ দখল করে নেওয়ার। তারই প্রমাণ পাওয়া যায় পাকিস্তানের সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে, সেখানে বলা হয়েছে “পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের জনগণ যখন বিদেশি আগ্রাসন থেকে মুক্ত হতে পারবে এবং তার প্রভাব-প্রতিপত্তির বাইরে আসতে পারবে, তখন সেটি ফেডারেশনের প্রতিনিধিত্ব করবে”। মজার ব্যাপার কি জানেন, আজো পাকিস্তানের সংবিধানে এই ধারাটা আছে, তারা আজো বাংলাদেশকে আবার দখলের স্বপ্ন দেখে। এহেন বাংলাদেশকে যখন স্রেফ বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় কূটনীতিতে বাধ্য হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হয়েছিল, তখন এর চেয়ে বড় অপমান অবশ্যই আর কিছুই হতে পারে না। ভুট্টো এবং তার পাকিস্তান এই অপমানের বদলা নিয়েছিল ১৯৭৫ সালে, বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনের কুশীলব হয়ে এবং তারপরের আজ ৪২ বছর ধরে স্বাধীন বাংলাদেশের একটা বিশাল অংশের জনগণকে পাকিস্তানপ্রেমী হিসেবে গড়ে তুলতে সফল হয়ে। এরাই আজ ১৯৭৪ সালের ভুট্টোর সফরের জন্য বঙ্গবন্ধুকে দোষারোপ করে, এরাই পাকিস্তানের জয়ে গলা ফাটিয়ে উল্লাস করে, এদেরই একটা অংশ স্বাধীনতার মাত্র ৩ বছরের মাথায় ৩০ লাখ শহীদের রক্তাক্ত এই জমিনে ভুট্টোকে স্যান্ডেল এবং পচা ডিম ছুঁড়ে মারার বদলে সাদরে সম্ভাষণ জানিয়েছিল, ফুলেল অভ্যররথনা জানিয়ে বরণ করে নিয়েছিল। জাতি হিসেবে এর চেয়ে বড় লজ্জার আর কি হতে পারে?
চলুন ভুট্টোর সফরের সময় তাকে দেখতে জড়ো হওয়া এবং অভ্যর্থনা জানানো বাঙ্গালীদের ব্যাপারে একজন প্রত্যক্ষদর্শী মতিউর রহমানের সাক্ষ্য পড়ে আসিঃ
প্রাথমিকভাবে পাকিস্তানের স্বীকৃতি আদায়। দায়দেনার বিষয়টি অবশ্য এখনও ঝুলে আছে কূটনীতির চালের মধ্যে। ইসলামী সম্মেলন সংস্থার সদস্যপদ প্রাপ্তিও ছিল অন্যতম সাফল্য। ঢাকায় ভুট্টোকে স্বাগত জানানো হলো। বিমানবন্দরে উনিশবার তোপধ্বনি। পিআইএ বিমান তেজগাঁও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের পর বঙ্গবন্ধু ভুট্টোকে স্বাগত জানান। লাহোর ইসলামী সম্মেলনকালেই বঙ্গবন্ধু ভুট্টোকে ঢাকা সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বাদ-প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, কালো পতাকা, উচ্ছ্বাস, হাততালি, জিন্দাবাদ, পুলিশের লাঠিচার্জসহ অনেক কিছুই ঘটেছিল সেদিন। আমাদের কয়েকজন রিপোর্টারকে এই সফর কভার করার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়। চিফ রিপোর্টার আগের রাতেই অ্যাসাইনমেন্ট দেন। আমার ডিউটি ছিল ফার্মগেট এলাকায়। তখন এতটা ব্যস্ত নগরী নয়। হাতে গোনা কিছু গাড়ি। মানুষজনও কম। দেশে জনসংখ্যা আট কোটির কিছু বেশি। ফার্মগেটে শিয়াল ডাকতো এক সময়। যাকগে, ফার্মগেটে পৌঁছালাম বাসে করে। দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। রাস্তাঘাট তখনও বন্ধ হয়নি। মানুষজন জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ করেই দেখি ফার্মগেটের পশ্চিম দিক থেকে উৎসুক মানুষের ভিড়। দুয়েকটা কালো পতাকাও দেখলাম। একশ্রেণীর মানুষের উচ্ছ্বাসও লক্ষ্য করলাম। একবারও মনে হয়নি ভুট্টোকে দেখার জন্য এতটা ভিড় হবে। যেখানে আড়াই তিন বছর আগে এই ভুট্টোকেই বাংলাদেশিরা তাদের এক নম্বর দুশমন মনে করতেন। ২৫ মার্চ ভুট্টো ঢাকায় ছিলেন। পাক বাহিনীর বর্বরতার এক নম্বর স্বাক্ষী। রাস্তায় ট্যাঙ্ক গড়গড় করছে। মেশিন গানের শব্দে ঢাকা রীতিমতো কাঁপছে। নিরীহ মানুষের আর্তনাদ চারদিকে। জুলফিকার আলী ভুট্টোর সে রাতটা যে আনন্দে কেটেছিল তার প্রমাণ মেলে পরদিন তার এক বক্তৃতায়। ঢাকা থেকে করাচি বিমানবন্দরে পৌঁছে ভুট্টো আনন্দের সঙ্গে বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে।’
এই মানুষটি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য কি না করেছেন। পাক সেনা কর্মকর্তাদের উত্তেজিত করেছেন। বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা না দেয়ার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানিদের মধ্যে বিষ ছড়িয়েছেন। ভুট্টো ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। খণ্ডিত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। ভুট্টোর সরকার যেদিন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল সেদিন তার নিজের কাছে কেমন লেগেছিল জানি না। এক অলীক স্বপ্নে বিভোর থাকা ভুট্টো নিজেই শেষ পেরেকটুকু মেরে দিয়েছিলেন। ভুট্টোকে বহনকারী মোটর শোভাযাত্রা যখন এগিয়ে চলেছে তখন ফার্মগেটে দেখলাম বড় বেশি উচ্ছ্বাস। করজোড়ে হাততালি। একি দেখছি ঢাকার রাস্তায়! নোটবুকে ঠুকলাম। ভাবলাম এখানেই বোধ করি শেষ। প্রেস ক্লাবে পৌঁছে শুনলাম তোপখানা রোডে জিন্দাবাদ স্লোগানও হয়েছে। পরিণতিতে নাকি রক্ষীবাহিনী লাঠিচার্জও করেছে। এটা কি ভুট্টোর প্রতি ভালবাসা? কেন এমন হলো। সাধারণভাবে বলা চলে সরকারের প্রতি মানুষের এক ধরনের অনাস্থা। সরকারের জনপ্রিয়তা যে সে সময় অনেক নিচে নেমে গিয়েছিল এতে কোন সন্দেহ নেই। জাসদ, সর্বহারা পার্টি - এমনকি ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টিও সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছিল। জাসদ সভাপতি মেজর (অব.) এম এ জলিল ভুট্টোর সফরসঙ্গীদের সঙ্গে মোলাকাতের জন্য পেরেশান হয়ে গিয়েছিলেন। একপর্যায়ে তারা সফলও হন। ভাবতে অবাক লাগে, মেজর জলিল আসলে কার হয়ে খেলেছিলেন। ভুট্টো সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে অকূটনীতিসুলভ আচরণ করেছিলেন। তাকে অবশ্য কালো পতাকা দেখানো হয়। স্থানীয় জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ঢাকায় রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনায় ভুট্টো বলেছিলেন, ক্ষমতাশালী একনায়কদের অপরাধ ও পাপের জন্য আমাদের দায়ী করবেন না। কার পাপ? ভুট্টো সব দোষ জেনারেলদের ওপর ছেড়ে দিয়ে নিজে ধোয়া তুলসি পাতা সাজতে চেয়েছিলেন। পাপ যে বাপকে ছাড়ে না এটা ভুট্টোর বেলায় শতভাগ প্রযোজ্য। ১১ জন জেনারেলকে ডিঙ্গিয়ে জেনারেল জিয়াউল হককে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীপ্রধান করেছিলেন। অথচ এই জেনারেল জিয়াই ক্ষমতা গ্রহণের পর পুরনো এক হত্যা মামলায় ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝুলান। এখানেই শেষ নয়, এক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় জেনারেল জিয়া প্রাণ হারান, অনেক প্রশ্ন রেখে। সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূতও।
১৯৭৪ সালে ভুট্টোকে যে কূটনীতির মারপ্যাঁচে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে এবং বাংলাদেশে আসতে বাধ্য করেছিলেন বঙ্গবন্ধু, সেই অপমানের প্রতিশোধ ভুট্টো কিভাবে নিয়েছিল, কিভাবে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের পেছনে কলকাঠি নেড়েছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে, ইতিহাসের সেই দলিলগুলো একবার দেখে আসি চলুনঃ
১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খোন্দকার মোশতাক আহমদ নিজেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেন। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জুলফিকার আলী ভুট্টো ভ্রাতৃপ্রতিম মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দেন। একই সঙ্গে তিনি ইসলামি সম্মেলন সংস্থার সব সদস্য এবং তৃতীয় বিশ্বের সব দেশের প্রতি অনুরূপ আহবান জানান। তিনি ‘বাংলাদেশি মুসলিম ভাইদের’ জন্য ৫০ হাজার টন চাল ও ১৫ মিলিয়ন গজকাপড় পাঠানোরও নির্দেশ দেন। (হু কিলড মুজিব, এ এল খতিব)।
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খুনি চক্র প্রথমে বাংলাদেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেছিল। সেই ঘোষণায় উৎসাহিত হয়ে ভুট্টো নতুন সরকারের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন।
ভুট্টোর এই পদক্ষেপ ছিল একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ। ১৯৭৩ সালে প্রণীত পাকিস্তানের সংবিধানে তিনি ‘পূর্ব পাকিস্তান’ শব্দটি বহাল রাখেন। সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের জনগণ যখন বিদেশি আগ্রাসন থেকে মুক্ত হতে পারবে এবং তার প্রভাব-প্রতিপত্তির বাইরে আসতে পারবে, তখন সেটি ফেডারেশনের প্রতিনিধিত্ব করবে।’
দুই মাস আগে, ১৯৭৫-এর জুনে জুলফিকার আলী ভুট্টো কাকুলের পাকিস্তান সামরিক একাডেমিতে সেনা কর্মকর্তাদের এক সমাবেশে বলেন, ‘এ অঞ্চলে শিগগিরই কিছু পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে।’ (জুলফি ভুট্টো অব পাকিস্তান , স্ট্যানলি উলপার্ট)
মুসলিম লীগের নেতা খাজা খয়েরউদ্দিন, যিনি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার কারণে স্বাধীনতার পর কারাগারে ছিলেন, তিনি ভুট্টোকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিলেন, ‘এখন থেকে শুরু হোক।’
পাকিস্তানের প্রভাবশালী সাংবাদিক জেড এ সুলেরি বলেছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে পারত না যদি মুজিব বেঁচে থাকতেন।
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর থেকেই ভুট্টো বাংলাদেশ বিরোধিতার প্রচারণা চালাতে থাকেন। তিনি মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার জন্য ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা চালান। এ ব্যাপারে তিনি পাকিস্তানে অবস্থানরত কথিত বাঙালি নেতাদের ও রাজা ত্রিদিব রায়কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। অপপ্রচার চালিয়েছেন, বাংলাদেশে মুসলমানদের ধর্মকর্ম পালন করতে দেওয়া হয় না। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী কামাল হোসেন এই নিবন্ধকারকে বলেছেন, ‘আমরা যেখানে যেতাম, এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হতাম।’
বাংলাদেশের ভেতরে যাঁরা শেখ মুজিবকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন, ভুট্টো তাঁদের নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেন।
চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির একাংশের নেতা আবদুল হক একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই চালান। আর অর্থ ও অস্ত্রের জন্য ধরনা দিলেন পাকিস্তানের কাছে। ১৯৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ‘আমার প্রিয় প্রধানমন্ত্রী’ সম্বোধন করে এক চিঠি লেখেন তিনি। চিঠির ভাষা ছিল নিম্নরূপ:
‘আমার প্রিয় প্রধানমন্ত্রী,
পুতুল মুজিব চক্র এখন জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এই চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য অর্থ, অস্ত্র ও ওয়ারলেস সরঞ্জাম প্রদানের আবেদন জানাচ্ছি।’
১৯৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর আবদুল হক লিখিত চিঠিটি ভুট্টোর কাছে পৌঁছায় ১৯৭৫ সালের ১৬ জানুয়ারি। চিঠিটি পাওয়ার পর তিনি ‘অত্যন্ত জরুরি’ বলে মন্তব্য করেন এবং এই ‘সৎ লোকটি’কে (আবদুল হক) ‘কার্যকর সাহায্য দেওয়ার সুপারিশ করেন।
আবদুল হক চিঠিটি পাঠিয়েছিলেন সিলেটের মাহমুদ আলীর মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মাহমুদ আলী দখলদার পাকিস্তানিদের পক্ষ নেন এবং এর ইনাম হিসেবে ভুট্টো তাঁকে বাংলাদেশ-সংক্রান্ত (তাঁদের ভাষায় পূর্ব পাকিস্তান) বিশেষ উপদেষ্টার পদে বসান।
ভুট্টোর আরেকজন এজেন্টের নাম আবদুল মালেক। বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা চালানোর উদ্দেশ্যে তিনিও সৌদি আরব যান। সেখান থেকে ১৯৭৫ সালের ২২ জানুয়ারি ভুট্টোকে চিঠি লেখেন ‘আমার প্রিয় নেতা’ সম্বোধন করে।
এই চিঠির জবাবে ভুট্টো ধর্মমন্ত্রী মাওলানা কায়সার নিয়াজীকে সৌদি আরব ও আরব আমিরাতে পাঠান। উদ্দেশ্য সংশ্লিষ্ট দেশের কূটনৈতিক, আর্থিক সাহায্য তথা অস্ত্রের জোগান নিশ্চিত করা। ভুট্টো ভেবেছিলেন, এঁদের মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধান পরিবর্তন করে ইসলামি রিপাবলিক নামকরণের জন্য মুজিব সরকার কিংবা তাঁর উত্তরসূরির প্রতি (তখনই তাঁরা উত্তরসূরি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল!) চাপ সৃষ্টি করা।
স্ট্যানলি উলপার্টের বইয়ে আছে ‘দুই বছর যাবৎ ভুট্টো কয়েকটি মুজিববিরোধী দলকে তাঁর গোপন স্বেচ্ছাধীন তহবিল থেকে অর্থসাহায্য অব্যাহত রাখেন এবং এর বিনিময়ে ফল লাভ করেছিলেন।’ ২০০০ সালে স্ট্যানলি উলপার্টের ঢাকা সফরের সময় লন্ডনপ্রবাসী সাংবাদিক আবদুল মতিন তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘বিনিময়ে ফল লাভ বলতে আপনি কী বুঝিয়েছেন? মুজিব হত্যায় কি পাকিস্তান জড়িত ছিল?’ উলপার্টের উত্তর, ‘হ্যাঁ, আপনি তা বলতে পারেন।’ (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব: কয়েকটি ঐতিহাসিক দলিল, র্যাডিকেল এশিয়া পাবলিকেশন্স, লন্ডন, ২০০৮)
এতো এতো তথ্য-প্রমাণ এবং ঘটনাপ্রবাহ সামান্যতম বোঝার চেষ্টা না করে এরপরেও যারা মুক্তিযুদ্ধের পোস্টে বঙ্গবন্ধু-ভুট্টোর হাস্যজ্জ্বল ছবি দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের দালাল বানিয়ে দেবেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে টিটকারী দেবেন, তাদের কাছে একটা ছোট্ট প্রশ্নঃ যে মানুষটার জন্য আজ স্বাধীন দেশের আলো-হাওয়ায় মাথা উঁচু করে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে পরিচয় দেন, নিজের দেশ নিয়ে গর্ববোধ করেন, তাকে এভাবে অপমান করতে একবারও লজ্জা লাগে না? যেখানে ভুট্টো তার এবং পাকিস্তানের অপমানের প্রতিশোধ নিয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মঞ্চ তৈরি করে, সেখানে আপনি কিভাবে কোন যুক্তিতে ৩০ লাখ শহীদের উত্তরসূরী হয়ে বঙ্গবন্ধুকে, মুক্তিযুদ্ধকে,৩০ লাখ শহীদকে টিটকারি দেন? পরিহাস করেন? আপনার রক্ত কার কথা বলে?
প্রয়োজনীয় তথ্যসূত্রঃ যেগুলো পড়লে সেইসময়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যাবে, ভুট্টোর সফরের পেছনের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে আরো ভালোভাবে বোঝা যাবেঃ
১। বঙ্গবন্ধুর বাকশাল : পটভূমি, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচী -ডা. অজিত কুমার দাস
২। মঙ্গাকবলিত উত্তারাঞ্চল - অখিল পোদ্দার
৩। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব : কয়েকটি ঐতিহাসিক দলিল -আবদুল মতিন
৪। কোন পিরিতির গল্প কইতেছো মামুরা!!!!
৫। মুজিবকে শান্তিতে থাকতে দেননি ভুট্টো
৬। কালের স্পর্ধা নেই বঙ্গবন্ধুকে বিস্মৃত করার
৭। ভুট্টো ঢাকায় করতালি এবং রক্ষীর লাঠিচার্জ
৮। দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা
৯। পাটের বস্তায় রাজনীতি!
১০। ‘জেনেভায় বঙ্গবন্ধু’ (১৯৮৪)
১১। ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব: কয়েকটি প্রাসঙ্গিক বিষয়’ (১৯৯৩)
১২। ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব: মুক্তিযুদ্ধের পর’ (১৯৯৯)
১৩। ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব: কয়েকটি ঐতিহাসিক দলিল’ (২০০৮)
১৪। ‘বিজয় দিবসের পর: বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ (২০০৯)
লিখেছেন - রহমান রা'আদ। লেখাটি নেয়া হয়েছে এগিয়ে চলো থেকে।
Post a Comment Blogger Facebook