image

image
 

A+ A-
Voice of 71 Voice of 71 Author
Title: একাত্তরের দিনগুলি: ০২ জুন, ১৯৭১
Author: Voice of 71
Rating 5 of 5 Des:
২ জুন ১৯৭১, বুধবার সকালে একরাম ভাইয়ের ট্রাংকল পেলাম। ভালোমত বরিশালে পৌছেছেন। গতকাল বিকেলের রকেট পি,আর,এস-য়ে বরিশাল রওনা হয়েছ...
২ জুন ১৯৭১, বুধবার

সকালে একরাম ভাইয়ের ট্রাংকল পেলাম। ভালোমত বরিশালে পৌছেছেন।

গতকাল বিকেলের রকেট পি,আর,এস-য়ে বরিশাল রওনা হয়েছিলেন। সঙ্গে ছিল বড় ছেলে আবু আর ভাস্তে আঞ্জু।

এখন ট্রাংকল পেয়ে খবরটা লিলিবুকে দেবার জন্য বেরোলাম। ওখানে খানিকক্ষণ বসে মা'র বাসা গেলাম।

গতকাল থেকে সর্দি লেগেছে, সেই সঙ্গে অল্প জ্বরজ্বর ভাব। আজ বিছানায় শুয়ে থাকলে ভালো হত। কিন্তু একবার বেরিয়ে যখন পড়েছিই, তখন সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে হলো না। মার সঙ্গে অামার এক খালা বাড়ি বেড়াতে গেলাম। সেখান থেকে মাকে আবার ৬ নংয়ে পৌঁছিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে দেড়টা।

সর্দি সারানোর দেশী টোটকা কাঁচাপেঁয়াজ কুচি, শুকনো মরিচ পোড়া আর খাঁটি সর্ষের তেল গরম ভাতে মেখে খেলাম। 

এত হাঙ্গামা করে এতবড় লেবু গাছটা এনে এত কষ্ট করে পুঁতলাম, কিন্তু কোনো কাজ দিল না। আজ দেখছি, এর পাতাগুলো মরতে শুরু করেছে। রুমী বললো, "যে কেউ দেখে বুঝে ফেলবে এর তলায় কিছু লুকোনো আছে। গাছটা তুলে ফেলে দিতে হবে।"

এতবড় গাছ তুলে ফেলা কি চাট্টিখানি কথা? ডালগুলো ছোট ছোট টুকরো করে কেটে, কান্ডটাও টুকরো করে কেটে গোড়াটা তুলে ফেলা হলো। তারপর গাড়ির বুটিকে নিয়ে দুরের একটা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসা হলো। খুব কষ্ট লাগল গাছটা এভাবে কসাইয়ের মতো টূকরো করে কাটতে। ছোটবেলা থেকে জেনে আসছি- ফলের গাছ নষ্ট করতে নেই। কিন্তু কি করবো, জান বাঁচানোর তাগিদে গাছ কেটে ফেলে দিতে হলো। এখন আবার নতুন করে চিন্তা করো- আর কোথায় কিভাবে গহনা লুকিয়ে রাখা যায়।

আজ সর্দিটা খুব বেড়ে গেছে। জ্বরটাও যেন। সর্দি সারার একমাত্র ওষুধ বিছানায় ওয়ে বিশ্রাম। দুটো নোভালজিন গিলে শুয়ে রইলাম। একটু পরেই রেবার ফোন : টাট্টু আমাদের বাসায় এসেছে কি না!

কি ব্যাপার! 

খুব উদ্বেগেও রেবার গলা সহজে কাঁপে না। রাগ হলেও সে চেচিঁয়ে কথা বলতে পারে না। খুবই ঠান্ডা মেজাজের মেয়ে। কিন্তু আজ ফোনে তার গলায় কাঁপন বুঝতে পারলাম।

দুপুরে আরো দুটো নোভলজিন খেয়ে জ্বরটা দাবালাম। বিকেল হতে না হতেই রুমী, জামী, শরীফসহ গুলশানের দিকে ছুটলাম। গিয়ে দেখি রেবা একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে বিছানায় পড়ে রয়েছে, চারপাশে তার আত্মীয়স্বজন বিষণ্ন বদনে বসে আছে। মিনিভাই, রেবা ও জাহিরের মুখে টুকরো টুকরো করে পুরো ঘটনাটা শুনলাম : সকালে টাট্টু দেরি করে ঘুমোয়। নাশতা হলে ডেকে তুলতে হয়। আজো ডাকাডাকি হচ্ছিলো, কিন্তু আজ আর তার সাড়া পাওযা যায় না। শেষে রেবা ঘরে ঢুকে দেখে মশারি ফেলাই আছে কিন্তু টাট্টু ভেতরে নেই। প্রথম দিকে হৈচৈ না করে টাট্টুর বড় ভাই জাহির খুব সন্তপর্ণে টাট্টুর বন্ধুদের কাছে খবর নেয়। না, টাট্টু তাদের কারো কাছে যায় নি। তবে টাট্টুর দুই বন্ধুকেও তাদের নিজ নিজ বাড়িতে পাওয়া যায় নি। জাহির একটু আধটু আঁচ পেত- টাট্টু কিছু একটার সাথে জড়িত আছে। কিন্তু টাট্টু কোনোদিন খোলাখুলি বড় ভাইয়ের সাথে এ নিয়ে কোনো আলোচনা করে নি। তরে সবাই ধারণা করছেছে টাট্টু লুকিয়ে মুক্তিযুদ্ধে চলে গেছে। আবার ভয়ও হচ্ছে, পথে কোথাও খানসেনাদের হাতে ধরা পড়ল কি না? ধরা পড়লেওতো জানবার কোন উপায় নেই।
রেবাকে এই প্রথম আকুল হয়ে কাঁদতে দেখলাম। মিনিভাই- ও খুব বিচলিত, তবে বাড়ির কর্তা বলেই বোধহয় শান্তভাবটা বজায় রাখার চেষ্টা করিছেন। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে, ভেতরটা তাঁর ভেঙে যাচ্ছে।

সন্ধ্যের মুখে বাসায় ফিরে এলাম। কিন্তু কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিনা। টাট্টু একলাইনের একটা চিঠি রেখে গেলেও তো পারত।

আজ স্বাধীন বাংলা বেতারেও তেমন মন লাগাতে পারলাম না। সেই কে যেন, আজো 'চরমপত্র' পড়লেন। রোজই পড়েন। কে পড়ছে নাম জানার জন্য প্রথম কদিন কান খাড়া করেছিলাম। কিন্তু না, কোনো নাম বলা হয় নি।

ঘুরেফিরে খালি টাট্টুর কথাই মন এলোমেলো করছে। জামীর মুখ চুন। টাট্টু তাকেও কিছু বলে নি। বন্ধুর এই 'বিশ্বাসঘাতকতায়' জামী খুবই মর্মাহত। আমি হঠাৎ গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বললাম, "চল নিচে যাই। মুড়ির মোয়া বানাব।" একটা কিছু কাজ করা দরকার।

- শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বই থেকে

About Author

Advertisement

Post a Comment Blogger

 
Top