মাটিতে ৩৫ মাইল অনেক লম্বা দূরত্ব, কিন্তু আকাশে উড়ে ৩৫ মাইল পার হওয়া খুব সাধারণ, অল্প সময়ের ব্যাপার। একটা টি-৩৩ বিমানের টপ স্পীড ৬০০ মাইল পার আওয়ার! ৩৫ মাইল পার হতে সময় লাগত মাত্র সাড়ে তিন মিনিট! এই সাড়ে তিন মিনিট কিংবা ৩৫ মাইলের হিসাবটাই ইতিহাস বদলে দিতে পারত! কিন্তু ঈশ্বর পাশা খেলেন না, তাই ৩৫ মাইল পার হয়ে সূর্য ছিনিয়ে আনা হয়না একজন ইকারুসের। মাত্র সাড়ে তিন মিনিটের রেসে হেরে যায় বাজির ঘোড়া!
৩৫ বছর ধরে যার সমাধি চিহ্নিত ছিল ‘গাদ্দার’ হিসেবে, সেই মানুষটা চাইলেই বাংলাদেশে থেকে যেতে পারতেন। ১৯৭১ সালের ৯ মে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে গিয়েছিলেন। কি বোকা, তাইনা?
প্রিয়তমা স্ত্রী, প্রাণপ্রিয় দুই কণ্যার ভালোবাসার বন্ধন; সবকিছুর চেয়ে তার কাছে বড় ছিল বাংলা মায়ের ডাক। স্বপ্ন দেখার জন্য সাহস লাগে। কতখানি সাহস থাকলে এক মানবসন্তান শত্রুর ঘরে ঢুকে তার কলিজা ছিঁড়ে নিয়ে আসার চিন্তা করতে পারে, ভেবে দেখো প্রজন্ম! ১৯৭১ সালের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে দুই মাসের ছুটি নিয়ে দেশে এসে তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন দানবের হুংকার আর বিভীষিকা। গড়ে তুলেছেন প্রতিরোধ, আর অকল্পনীয় দূরদর্শীতায় অনুভব করেছেন, ‘ইটের জবাব পাথর দিয়ে দিতে হবে’।
সংসার, পরিবার সবকিছু নিয়ে জুয়া খেলতে নেমেছিলেন তিনি, তাই ফিরে গিয়েছিলেন শত্রুর ঘাঁটিতে, বুকের গহীণ অলিন্দে লুকিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন আগুন! স্বাধীনতার আগুন! ইকারুসের ডানায় ভর করে সূর্যটা এইদেশে এসেছিল ঠিকই, শুধু আসেনি একজন স্বামী; যার শেষ কথা ছিল, “এই দেশটাকে হানাদারেরা গিলে খাবে, এটা আমি কি করে মেনে নেই? আমার মায়ের আঁচল শত্রুরা ছিঁড়ে নেবে…এটা আমি সহ্য করি কিভাবে মিলি? আমি আবার ফিরব মিলি। আমাদের স্বাধীন দেশের পতাকা বুকপকেটে নিয়ে ফিরব”।
ফিরে আসেননি একজন পিতা, যার কণ্যাদের জন্য শেষ বার্তা ছিল, “আমার কণ্যারা
যদি কখনও জিজ্ঞাসা করে, ‘বাবা কেন আমাদের ফেলে চলে গেছে?’ তুমি তাঁদের
বলবে, তোমাদের বাবা তোমাদের অন্য এক মা’র টানে চলে গেছে। যে মা’কে তোমরা
কখনও দেখনি… সে মা’র নাম বাংলাদেশ”।
এই মানুষটা ফেরেননি। মাত্র সাড়ে তিন মিনিটের ব্যবধানে ইতিহাস বদলে গিয়েছিল সেদিন। ৩৫ মাইল পার হতে না পারায় ৩৫ বছর এই বাংলা মায়ের ছেলেটা অবহেলায় পড়ে ছিল ‘গাদ্দার’ পরিচয় নিয়ে! আজ থেকে ৪৬ বছর আগের এই দিনে ছেলেটা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে প্রেম কাকে বলে, ভালোবাসা কেমন হয়। বড় বোকা ছিল ছেলেটা, ভীষণ আনস্মার্ট!
মাত্র ৩০ বছর বয়স ছিল তার। ছিল স্ত্রী আর দুই দেবশিশুর মত মেয়ে! জীবন নিয়ে এমন বাজি কয়জন খেলতে পেরেছে আর? আমরা ব্যস্ত অনেক কিছু নিয়ে, কথায় কথায় গর্বে বুক ফুলিয়ে লাল-সবুজের পতাকা ওড়াই আমরা। অথচ ঘুণাক্ষরেও মনে পড়েনা, এই পতাকাটা একজন আমাদের এনে দিয়ে চুপচাপ হারিয়ে গেছেন। ৩৫টা বছর অপমানিত হয়েছে তার সমাধি। আমরা শুধুই ভুলে যাই।
বিভিন্ন দেশের বিমান বাহিনীতে ‘মিসিং ম্যান ফর্মেশন’ নামে একটা ফ্লাই পাস্টের প্রচলন আছে। প্রয়াত পাইলটের সম্মানে তিন, পাঁচ বা সাত বিমানের ফর্মেশনে একটা স্থান ফাঁকা রেখে ফ্লাই পাস্ট করা হয়। আমি জানিনা আমাদের বিমান বাহিনীতে এই ঐতিহ্য আছে কি না। আমার খুব ইচ্ছে করে, বাংলার আকাশে উদীয়মান সূর্যের পটভূমিতে একটা ‘মিসিং ম্যান’ ফ্লাই পাস্ট হোক। লাল সবুজ ধোঁয়া ছেড়ে খুব নিচু দিয়ে উড়ে যাওয়া ফর্মেশনে একটা শূন্যস্থান আমাদের মনে করিয়ে দিক, এই বাংলার আকাশ মুক্ত রাখার জন্য এক অতিমানব সাড়ে তিন মিনিটের জন্য আজীবন বিজয়ীর খেতাবটা ছিনিয়ে নিয়ে আমাদের একটা পতাকা উপহার দিয়ে গেছেন।
কেউ কি পড়ছেন? কেউ কি শুনছেন? একটু চেষ্টা করবেন কি? বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান নামটা মনে পড়ে? আজ ২০ আগস্ট। ১৯৭১ সালের এই দিনে বোকা ছেলেটা অসম্ভবকে সম্ভব করার পথ দেখিয়ে গিয়েছিল।
লিখেছেন-
Tamur Hasan
Post a Comment Blogger Facebook
Click to see the code!
To insert emoticon you must added at least one space before the code.