জুলাই থেকে আগস্টের মাঝামাঝি এই সময়টায় ঢাকায় ইতিমধ্যে বড়সড় ধাক্কা খাওয়া পাকিস্তানীদের উপর আরো রুদ্ররোষে ঝাঁপিয়ে পড়বার জন্য সেক্টর- ২ এর সমন্বয়ক ও অস্ত্র বন্টনের দায়িত্বে থাকা শহীদুল্লাহ খান বাদল এবং সেকেন্ড ইন কমান্ড গেরিলা প্রশিক্ষক মেজর এটিএম হায়দার পুরোনো ও নতুন ট্রেনিং পাওয়া ছাত্র মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আবার ঢাকা যাবার নির্দেশ দেন। ১০ জন তরুণের আলাদা একটি দল প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মুরাদনগর দিয়ে ঢাকায় ঢোকেন। এদের নেতৃত্বে ছিলেন হাবিবুল আলম বীর প্রতীক। প্রায় ৫০-৬০ পাউন্ড বিস্ফোরক ও ডেটোনেটর, ২-৩টি এনেগ্রা-৯৪ গ্রেনেড, দুটি ভারতীয় এসএমজি এবং আলমের ব্যক্তিগত চীনা এসএমজি। অস্ত্র ও গোলাবারুদ এনে রাখা হয়েছিল আলমের ১/৩ দিলু রোদ, নিউ ইস্কাটনের বাড়িতে।
জনাব হাতেম নামে আলমের এক ভগ্নিপতি ছিলেন। ভদ্রলোক পেশায় ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার, চাকুরি করতেন ওয়াপদায়। হাসিখুশি সাধাসিধে মানুষটা প্রায়ই আলমদের বাড়ি আসতেন, তার সাথে আলমের ছিল বেশ বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক। ভাই-বোনদের মধ্যে সবার বড় আসমা আলমদের গেরিলা অপারেশন সম্পর্কে সবই জানতো; সত্যি বলতে কি গেরিলাদের আশ্রয় দেওয়া, সেবাযত্ন করা, অস্ত্র-গোলাবারুদ পরিষ্কার করা, যত্ন নেওয়ার কাজটা আসমাই করতো। সে কারণেই হাতেমকে জীপটা ব্যবহার করতে দেবার জন্য আসমাকে বলে আলম।
কারণ ঢাকায় আসার পর থেকেই আলমেরা একটা জীপ খুঁজছিল, যা নিয়ে নির্বিঘ্নে তারা ঢাকায় অপারেশন চালাতে পারবে। তো, একদিন যখন হাতেম তার নিশান পেট্রোল জীপটি নিয়ে আলমদের বাড়ি এলেন, তখন আলম সিদ্ধান্ত নিল সে জীপটি যেভাবেই হোক নিয়ে নেবে। হাতেম চলে যাবার পর আলমের কথামত আসমা হাতেমকে ফোন করে বললেন যেন জীপটি ব্যবহার করার অনুমতি দেন তিনি। আসমা মুভি দেখতে যাবেন। বেশ কিছুক্ষণ অনুরোধের পর রাজি হয়ে গেলেন হাতেম, কিন্তু গোঁ ধরে বসলেন যে তিনিও যেতে চান মুভি দেখতে। এখন তাকে তো আর বলা যায় না যে, আলমেরা জীপটি নিয়ে আসলে ঢাকা শহরে গেরিলা অপারেশন চালাতে যাচ্ছে। কিন্তু তাকে কিভাবে কাটানো যায়?
শেষমেষ তাকে আসমা ফোন করে জানালো, এই ছবিটা আসলে বাচ্চাদের ছবি, এটা দেখে তার লাভ নেই। তাকে এটাও বলে আসমা যে খুব দ্রুতই তাকে নিয়ে মুভি দেখতে যাওয়া হবে। সাধাসিধে লোক হওয়ায় তিনি আর কোন সন্দেহ না করে আসমাকে বলেন, বিকেলে তার বাসায় এসে আলম যেন জীপটা নিয়ে যায় কারণ গাড়ীটা ওয়াপদার এবং কেবল অফিস শেষে ফিরলেই আলম জীপটা পেতে পারে। শেষ পর্যন্ত আলমের কৌশলে কাজ হলো এবং একটা বেশ ভালো জীপ যোগাড় করা গেল।
ওদের হাতে সময় ছিল ১৪-১৬ ঘন্টা। আলম বাকি তিনজন মুক্তিযোদ্ধা আনু, শহীদ এবং জিয়ার সাথে যোগাযোগ করলো। আনু জানালো, সে দরকার হলে মুক্তিযোদ্ধা টুটুলকে আনবে। যেহেতু বাকি দুজন গাড়ি চালাতে পারতো না, তাই আলম সিদ্ধান্ত নিল সে জীপের স্টিয়ারিং হুইল ধরবে, জিয়ার হাতে থাকবে ভারতীয় এসএমজি। এক্সপ্লোসিভগুলো থাকবে আনুর হাতে এবং সেই এগুলো টার্গেটে বসাবে।
এই ছোট্ট দলটার লক্ষ্য ছিল হোম ইকোনমিক্স কলেজের পাশের পেট্রোল পাম্পটি উড়িয়ে দেওয়া। নিউমার্কেটের ঠিক বামপাশেই এই স্থাপনাটা ছিল শাহেদ শেখ নামের এক উর্দুভাষী পাকিস্তানী ব্যবসায়ীর। জায়গাটার একপাশে ছিল হোম ইকোনমিক্স কলেজ, অন্যপাশে ছিল প্রধান রাস্তা। রাস্তাটি হাতের বামে আজিমপুর কলোনী এবং ডানে নিউ মার্কেট রেখে চলে গেছে পশ্চিম দিকে। আলমেরা নাটকের ক্লাব এজিয়ানে সদস্য থাকার সময় থেকে শাহেদ শেখকে চিনত। ক্লাবের ইংরেজী নাটকগুলো পরিচালনা করত সে। আলম-শহীদ-জিয়া খবর পেয়েছিল শাহেদ শেখ পাকিস্তানী আর্মিকে সর্বাত্মক সহায়তা করছে। তাই তাকে একটা শিক্ষা দেওয়ার জন্য এবং পাকিস্তানীদের ভয় দেখানোর জন্য এই অপারেশন নিউমার্কেট চালাবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
তারা প্ল্যান করে যে, পেট্রোল পাম্পের তেলের ট্যাংকের উপর এনাগ্রা গ্রেনেডটা উল্টো করে বসানো হবে, যেন এটা মাটির নিচের তেলের ট্যাংকের ঠিক উপরের দিকটায় আঘাত হানে। আনুর দায়িত্ব ছিল, গ্রেনেডটা বসিয়ে এর উপর এক্সপ্লোসিভ লেপে দেওয়া এবং তিনটি কাঠি দিয়ে একটা ট্রাইপড তৈরি করে ট্যাংকের উপর রাখা। শহরের সব পেট্রোল পাম্পের গ্যাসোলিন ট্যাংকগুলো মাটির ৪-৫ ফুট নিচে থাকে এবং কালো একটি স্টিলের কভার দিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড এই ট্যাংকটি ঢাকা থাকে এবং কালো এই স্টিলের কভারটি তুললে দেখা যায় ভেতরে একটা লাল রঙয়ের প্যাঁচানো স্টিলের কভার তালা মারা। এটার উপরেই এক্সপ্লোসিভ লেপা গ্রেনেড বসানোর সিদ্ধান্ত হয়।
বিকেল ৩টায় আলম হাতেম সাহেবের বাসায় যায়। সেখান থেকে জীপটা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে শহীদ মিনার ও ঢাবির অংক ও ভূগোল বিভাগ ভবন পাশে ফেলে বিজ্ঞান অনুষদ কার্জন ভবনের সামনে দিয়ে হাইকোর্ট ভবনটা বাঁয়ে রেখে চলে আসে। প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে জীপটা নিয়ে সারা শহরময় ঘুরে বেড়াবার কারণ হলো, আলম আগে কখনো জীপ চালায়নি, তাই অপারেশনের সময় যেন জীপ চালাতে সমস্যা না হয়, আর যদি কেউ অনুসরণ করেই থাকে, সে যেন ইতিমধ্যে ক্লান্ত ও বিরক্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেয়।
তো জীপটি নিয়ে ফিরে আসার পর বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে জিতা আর আনু আলমের বাসায় আসে। তিনজন মিলে এনাগ্রা গ্রেনেড আর ট্রাইপড প্রস্তুত করে। গ্রেনেডটা পিইকে এক্সপ্লোসিভের সাথে সংযুক্ত করে তিন মিনিটের একটা ফিউজ লাগিয়ে ডেটোনেটর লাগানো হয়। আনু তিনটি কাঠের টুকরা দিয়ে ট্রাইপডটা প্রস্তুত করে। ইন্ডিয়ান এসএমজিটা রাখা হয় সামনের সিটের নিচে যেন জিয়া প্রয়োজনের সময় দ্রুত সেটা ব্যবহার করতে পারে। তিনজন মিলে জীপে করে দিলু রোড থেকে নিউ মার্কেটের দিকে এগোতে থাকে, আনু বসেছিল পেছনে আর সামনে জিয়া ড্রাইভ করতে থাকা আলমের পাশে। আলম আনু আর জিয়াকে জিজ্ঞেস করলো, "তোমরা ঘাবড়ে গেছো নাকি?"। জিয়া আর আনু জবাব দিল, অবশ্যই না!
হোম ইকোনমিক্স কলেজের সামনে দিয়ে ইডেন কলেজ হয়ে ডানে ঘুরে আজিমপুর কোয়াটারে প্রবেশ করে জীপ, এখানেই টুটুলের বাসা, সে অপেক্ষায় ছিল বাসার সামনেই। সমস্যাটা হচ্ছে আলমের ভগ্নীপতি হাতেমের বাসা হয়েই টুটুলের বাসায় যেতে হয়। তো হাতেমের বাসার সামনে এসে হঠাৎ করেই হতভম্বের মতো আলম আবিষ্কার করল যে ফুল হাতা শার্ট আর লুঙ্গি পড়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হাতেমের দিকে সে তাকিয়ে আছে। বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে হাতেম হাত তুলে জীপ থামাতে বলেন কিন্তু আলম তাকে এমনভাবে এড়িয়ে যায় যে কখনো তাকে দেখেইনি এবং চেনেও না! মুভি দেখার কথা বলে নেওয়া তার জীপ নিয়ে শহরময় ঘুরে বেড়ানো আলম তাকে এভাবে পাত্তা না দিয়ে চলে যাবে, হাতেম সম্ভবত স্বপ্নেও ভাবেননি। কিন্তু তার বিস্ময় বা রাগ দেখার সময় বা সুযোগ আলমদের ছিল না। একেবার অন্য রাস্তা দিয়ে জীপ ঘুরিয়ে আলম টুটুলের বাসার সামনে এসে টুটুলকে তুলে নিল। তাকে ব্রিফ করলো বাকিরা।
এরপর খুব দ্রুত আলম জীপ ঘুরিয়ে রাস্তার মোড়ে নিয়ে এল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে মুখ করে গাড়িটাকে এমনভাবে পার্ক করা হলো যেন দ্রুত সটকে পড়া যায়। ডান পাশে পড়লো "শেখ পেট্রোল পাম্প"। জীপটা যেইমাত্র থেমেছে, ঠিক তখনই হঠাৎ পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের ৪-৫টা বেডফোর্ড ট্রাকের গর্জন শোনা গেল। এগুলো ফিরে যাচ্ছিল পিলখানায়। এই বহরের সামনে ছিল একটা ডজ ট্রাক এবং তার হুডের উপর একটা এলএমজি লাগিয়ে পিছে দাঁড়িয়ে ছিল এক সৈনিক। এতো দ্রুত পুরো বহর চলে এসেছে যে আর পালানো বা আড়াল নেবার উপায় নাই।
খুবই আশংকাজনক সেই পরিস্থিতিতে আলম চাপা গলায় বললো, "কেউ মুভ করবা না। কয়েক মিনিট অপেক্ষা করি, জীপ থেকে নামবো না আমরা। ওরা চলে যাক। যদি এগিয়ে এসে চ্যালেঞ্জ করে, তাহলে জীপ নিয়ে পালায়ে যাবো। বাট নো রাশ মুভমেন্টস।"
সৌভাগ্যক্রমে কিছুক্ষণের মধ্যে পুরো বহরটা পার হয়ে গেল জীপের পাশ দিয়ে। ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে আসায় সুবিধা হলো গেরিলাদের। আলম খুব সাবধানে জীপের ব্যাকভিউ মিরর দিয়ে পেছনে তাকিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিল যে বহরটা নিউ মার্কেটের সেকেন্ড গেটে থেমেছে কিনা। না, থামেনি। সাথে সাথে গেট খুলে লাফ দিয়ে নামলো সবাই, আনু আর টুটুল এনাগ্রা-৯৪ গ্রেনেড এবং ট্রাইপড নিয়ে সরাসরি চলে গেল তেলের ট্যাংকের দিকে। ট্রাইপডে ঝুলে থাকা এনাগ্রা গ্রেনেডটা বসানো হলো পেট্রোল পাম্পের তেলের ট্যাংকের সেই লাল কাভারের উপর, লেপে দেওয়া হলো এক্সপ্লোসিভ দিয়ে। গ্রেনেডটির মাথার দিকটি ছিল ট্যাংকের উপর, যেন প্রথম ধাক্কাতেই ট্যাংকটা বিস্ফোরিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু তাড়াতাড়ি গ্রেনেডটা বসাতে গিয়ে দুজন খেয়াল করেনি যে, কাঠের ট্রাইপডের একটা পা সরে যাওয়ায় বসানো গ্রেনেডটার মুখ আর তেলের ট্যাংকটির দিকে না গিয়ে দেয়ালের দিকে চলে গেছে। তখন আসলে এত কিছু দেখার সময় ছিল না। ফিউজে আগুন ধরিয়েই জীপের দিকে দৌড় দিল।
আলম জীপ স্টার্ট দিয়ে অপেক্ষায় ছিল, তারা উঠেছে কি ওঠেনি, এক্সিলেটোরে পা দাবিয়ে জীপ টান দিল আলম। ঠিক হাইকোর্ট আর পিডব্লিউ ভবনের মাঝখানে যখন জীপ, প্রচণ্ড বিস্ফোরণে মাটি কেঁপে উঠলো থর থর করে, হইচই পড়ে গেল সর্বত্র। শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল পেট্রোল পাম্প তো বটেই আশেপাশের সবকিছু উড়ে গেছে। প্রচণ্ড আনন্দিত চারজন একে অন্যকে ধরে উল্লাসে ফেটে পড়লো। আলম তাদের বাড়ি নামিয়ে দিয়ে জীপ নিয়ে ফিরে এলো দিলু রোডে।
পর দিন পত্রিকার খবর বেরোলো এবং তুমুল হইচই পড়ে গেল যে কারা যেন নিউমার্কেটের পাশের পেট্রোল পাম্পটা উড়িয়ে দিতে গিয়ে পেট্রোল পাম্পের বদলে সাথের হোম ইকোনমিক্স কলেজের পুরো দেয়ালে বোমা মেরেছে। দেয়ালসহ একটা পাশ ধ্বসে গেছে। আলমদের একটু মন খারাপ হলো, কারণ ওই যে তাড়াহুড়ায় গ্রেনেডের মাথাটা দেওয়ালের দিকে চলে যাওয়ায় পুরো শকটা গিয়ে লেগেছে দেওয়ালে, ট্যাংকে না। তবুও তারা এই ভেবে খুশি হলো যে, পুরোটা ওড়ানো না গেলেও পেট্রোল পাম্পের বিশাল ক্ষয়ক্ষতি করা গেছে, ঢাকা শহরে পাকিস্তানীদের সবকিছু শান্ত নিরুপদ্রব রাখার আয়োজন আরেকবার তুমুল তুলকালামে মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া গেছে, তাদের আরেকবার ভয় দেখানো গেছে, কাঁপিয়ে দেওয়া গেছে ঢাকা!
হাতেমের জীপটি তাকে ফেরত দেয় আলম এবং ওয়াদা করে শীঘ্রই তাকে নিয়ে একটা মুভি দেখে তার মনের আশা পূরন করবে। কিন্তু সর্বক্ষণ জীবন হাতে নিয়ে মৃত্যুর সাথে খেলে বেড়ানো গেরিলা আলম বা আসমার সেই প্রতিশ্রুতি রাখার আর সুযোগ হয়নি!
তথ্যসূত্র- ব্রেভ অফ হার্ট, হাবিবুল আলম বীরপ্রতীক
প্রথম প্রকাশিতঃ http://egiye-cholo.com/newmarket-petrol-pump/
সার্বিক কৃতজ্ঞতা- http://egiye-cholo.com
Post a Comment Blogger Facebook
Click to see the code!
To insert emoticon you must added at least one space before the code.