পাকিস্তানীরা ভেঙে পড়া প্রশাসন - আইন ব্যবস্থাকে আবার দাঁড় করাতে চাচ্ছিল সেসময় - ‘সব কিছু ঠিক আছে’ - এমনটা দেখাতে। কর্মস্থলে যোগ দিলে প্রশাসনিক প্রয়োজনেই হয়তো তাঁকে কাজে বহাল করা হবে - এমনটাই ধারণা ছিল তাঁর। শাস্তি হয়তো পেতে হবে কিন্তু তাঁর খোঁজে মিলিটারিরা বাড়ি পর্যন্ত চলে এলে বিপদে পড়বে তাঁর পুরো পরিবার। তাই ঝুঁকি নিয়েই নিজের এক ছেলেকে সাথে নিয়ে রওনা হলেন। সেখানে পৌছে জানা গেল, এখানকার আরো দুজন অফিসারকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ওনারাও ফিরে এসে কর্মস্থলে যোগ দিয়েছিলেন। ছেলেকে বাসায় রেখে তিনি গেলেন ক্যাম্পে। সময় যায়, দিন পেরিয়ে রাত নামে - তাঁর ফিরে আসার নাম নেই। একা বাড়িতে ঊনিশ বছরের সেই তরুণ চরম উদ্বেগ উৎকন্ঠায় সময় পার করছে।
পরিচিত একজন এসে খবর দেয় - “ভাইযান আপনে বাড়ি চলে যান। স্যারকে ওরা মেরে ফেলছে”। পরের দুই দিন ছেলেটি পরিচিত অপরিচিত সম্ভাব্য সকল স্থানে যায় - একটু আলোর আশায়, হয়তো খবরটা ভুল, হয়তো বাবাকে বন্দী করে রাখা হয়েছে। কিন্তু আলো পাবে কোথা থেকে? সূর্য তো সেই ২৫ মার্চেই ডুবে গিয়েছিল যে। ছেলেটির কাছে নিজের বাবা হারানোর কষ্টের থেকেও বেশি যন্ত্রণার হয়ে দেখা দেয়, এই সংবাদটি নিজের পরিবারের কাছে নিয়ে যাওয়াটা। কী বলবে সে তার মা’কে? কী বলবে ভাই-বোনদের? পরিবার নিয়ে কোথায় যাবে তারা এখন? বাড়িতে ফিরে বাবার মৃত্যু সংবাদটি তাকেই দিতে হয়। কখনো নিজের অতি - আপনজনের মৃত্যু সংবাদ অন্য কোন অতি - আপনজনকে দিয়েছেন? না দিলে বুঝবেন না, এই যন্ত্রণা কত ভয়াবহ।
স্বাধীনতার পর স্থানীয় লোকজনদের থেকে তথ্য নিয়ে ঐ স্থানটি সনাক্ত করা হয়, যেখানে ঐ পুলিশ অফিসারকে হত্যা করে ফেলে যাওয়ার পর স্থানীয়রা মাটি চাপা দেয়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে, সেই ছেলেটিকেই বাবার লাশ সনাক্ত করতে হয়, লাশটি মাটির তল থেকে উঠাতে হয়। এর থেকে কষ্টের আর কী হতে পারে?
মুক্তিযুদ্ধের ভয়ঙ্কর সময়টাতে দেশের অধিকাংশ পরিবারকেই এ ধরণের যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে। দেশের লাখ লাখ পরিবারের মধ্যে, এটাও একটি মাত্র পরিবারের গল্পের সামান্য একটু অংশ। বাবার মৃত্যুর পর পুরো পরিবারটি পালিয়ে বেড়িয়েছে, উদ্বাস্তু হয়েছে, আরো লাখও পরিবারের মতোই। অনেকে একসাথে থাকা নিরাপদ নয় বলে, আলাদা হয়ে যেতে হয়েছে হয়তো পরিবারের কয়েকজনকে। পরিবারের সদস্যরা কে কোথায় আছে - সেটাও জানা ছিল না তাদের। এই গল্প খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে। কিন্তু যারা এর ভিতর দিয়ে গেছে, তাদের জন্য এটা মোটেও স্বাভাবিক ছিলনা।
এই গল্পটি আলাদা করে কেন বললাম? আপনারা অনেকেই হয়তো এই কাহিনী শুনে থাকবেন বা পড়ে থাকবেন। কারণ গল্পের এই ঊনিশ বছরের তরুণটি হলেন ড.মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার। আর সেই পুলিশ অফিসারটি ছিলেন তাঁর বাবা শহীদ ফয়জুর রহমান। এই কাহিনীটি পাওয়া যাবে হুমায়ূন আহমেদ এবং জাফর ইকবাল স্যারের যৌথভাবে রচিত ‘একাত্তর এবং আমার বাবা’ বইটিতে। এই কাহিনী আবার বলার কারণ সাম্প্রতিক সময়ের কিছু অহেতুক বিতর্ক।
সম্প্রতি মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার বিজয় দিবস উপলক্ষে রচিত তাঁর এক কলামে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের কিছু স্মৃতিচারণ করেছেন। যুদ্ধের শেষের দিকে, তিনি তখন ঢাকায় একটি বাড়িতে লুকিয়ে আছেন, কারণ তিনি, হুমায়ূন আহমেদ এবং তাঁদের বোন শেফু - এনাদের তিন জনকে মিলিটারী এবং রাজাকাররা খুঁজছিল। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া, ফয়জুর রহমান সাহেবের এই তিন সন্তানের অপরাধ ছিল - যুদ্ধের আগে তাঁরা অস্ত্র হাতে মিছিল করতেন! পাকিস্তানীদের চোখে ফয়জুর রহমান ছিলেন বেঈমান, তাই স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর সন্তানদের উপরেও সন্দেহ ছিল স্বাভাবিকভাবেই।
জাফর ইকবাল স্যারের লেখা থেকেই দেখে নেই সে সময়ের অবস্থা-
“১৯৭১ সালের বিজয়ের আগের দিনগুলোর স্মৃতি আমাদের এখনো এত স্পষ্টভাবে মনে আছে যে মনে হয়, এটি মাত্র সেদিনের ঘটনা। আমাদের পুরো পরিবার তখন পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন, কে কোথায় আছে, কেমন আছে, আদৌ বেঁচে আছে কি না — আমরা কিছুই জানি না। আমি যাত্রাবাড়ীতে একটা পরিবারের সঙ্গে অনেক শিশুকে নিয়ে আছি। ১৯৭১ সালের যাত্রাবাড়ী আজকের যাত্রাবাড়ীর মতো নয়, মোটামুটি ফাঁকা। রাস্তার দুই পাশে বাড়িঘর নেই। আমি সেখানে আছি তার চারপাশে ছোট একটা জনবসতি।মুক্তিযুদ্ধকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেয়ার উপকারিতা যেমন অনেক, একইভাবে কিছু সমস্যাও থেকে যায় - যেমন এই মাধ্যমগুলোতে গল্পের প্রয়োজনে অনেক কিছুই সিনেমাটিক করে দেখানো হয়, যেমন - নায়ক রিভলবার হাতে যুদ্ধ করতে নেমে গেছে, বা নায়ক একাই বিশ-ত্রিশ জন পাকিস্তানী আর্মিকে মেরে ফেলছে। অথবা মুক্তিযোদ্ধা মানেই পেশীবহুল সুদর্শন শক্তিশালী একজন মানুষ। কিন্তু সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধারা সিনেমার হিরো না, তারা সাধারণ মানুষ, আপনি প্রতিদিন যাদের দেখেন তাদের মতোই সাধারণ মানুষ। মুক্তিযোদ্ধারা, আপনি যে রিকশায় চড়েন সেই রিকশাওয়ালার মতো, কিংবা গ্রামে ফসলের মাঠে যে কৃষক হালচাষ করে সেই কৃষকের মতো, টিএসসিতে বসে সিগারেট ফোঁকা ছেলেটির মতো, আমার মতো, আপনার মতো। আর এই মুক্তিযুদ্ধের অসাধারণত্বই হচ্ছে এই সাধারণদের বীরত্ব।
তখন শেষ যুদ্ধ শুরু হয়েছে। দিনরাত গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাই। শেলিং হচ্ছে, একটি-দুটি শেল আশপাশে পড়ছে, সে রকম খবরও ভেসে আসছে। মাঝেমধ্যে এত কাছে থেকে এত তীব্র গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাই যে মনে হয়, এই বুঝি সেগুলো আমাদের গায়ে এসে লাগবে। এ রকম সময়ে কিছু না করে চুপচাপ বসে থাকা যায় না, তাই কিছু একটা করার উদ্দেশ্যে একটি কোদাল দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে ঘরের উঠানে একটা ট্রেঞ্চ খুঁড়ে ফেলা হলো। ট্রেঞ্চের ওপরে একটা ঢেউটিনের আস্তরণ। যখন গোলাগুলির শব্দ খুব বেড়ে যায়, তখন বাচ্চাগুলোকে নিয়ে সেই ট্রেঞ্চের ভেতর বসে থাকি।
বাড়িটার পাশেই রাস্তা, সেই রাস্তা দিয়ে মিলিটারির বহর যাচ্ছে - আসছে। একদিন মিলিটারিরা সেই রাস্তা দিয়ে যাওয়া একটা স্কুটারের সব যাত্রীকে মেরে ফেলল। আমরা দেখতে পাই, স্কুটারের ভেতর থেকে মৃত মানুষগুলোর হাত - পা বের হয়ে আছে। মৃত মানুষগুলো প্রকাশ্য রাস্তায় স্কুটারের ভেতর দিনের পর দিন পড়ে আছে, কেউ সেটা নিয়ে বিচলিত হচ্ছে না”।
সেই সময়টার ভয়াবহতা এখন এই সময়ে বসে আমরা কল্পনাও করতে পারিনা। এটা কোন গেইম ছিলনা যে ইচ্ছা হল, খেলতে চলে গেলাম। সেটা ছিল প্রতিনিয়ত জমদূতের সাথে বসবাস, প্রতিনিয়ত মৃত আপনজনদের হারানোর ব্যথা আর জীবিত আপনজনদের জন্য দুশ্চিন্তার সাথে বসবাস। সে ছিল সাক্ষাৎ নরক। তখন এই মানুষ গুলোর মধ্য থেকেই যুদ্ধে গিয়েছিল অনেকে - সময়ের প্রয়োজনে, সিনেমাটিক বীরত্ব দেখাতে নয়। কাজেই বাবাকে হারিয়ে, পরিবারের সকল সদস্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় মৃত্যু পরোয়ানা মাথায় নিয়ে থাকা ঊনিশ বছরের একজন তরুণকে আমরা কোন ভাবেই ব্লেম করতে পারিনা- ‘তুমি কেন যুদ্ধে যাওনি?’ কিন্তু প্রশ্ন করতে পারি। আর এই প্রশ্নের উত্তর জাফর ইকবাল স্যার নিজেই দিয়েছেন- “মুক্তিযুদ্ধ যে এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে, এটা আমরা বুঝতে পারিনি। আমরা ভেবেছি এই যুদ্ধ আরো অনেকদিন ধরে চলবে। আমরা আমাদের পুরো পরিবার নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম তখন। আমি মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারিনি এটা আমার জীবনের একটা বড় আক্ষেপ”। (তোমাদের প্রশ্ন,আমার উত্তর)
কাজেই এই সময়ে বসে যতই বলা হোক ‘ইশ কেন যে ৭১ এ জন্মালাম না, তাহলে যুদ্ধে যেতে পারতাম’- সত্যিকারের ব্যাপারটা ততটা সহজ ছিল না। মুক্তিযুদ্ধে না যাওয়াটা কোন অপরাধ নয়, অপরাধ ছিল সে সময় পাকিস্তানীদের সাহায্য করাটা। মুক্তিযুদ্ধে না যাওয়ার জন্য কোন ভাবেই আমরা তাঁকে দোষারোপ করতে পারিনা, যেখানে আবার মানুষটা জাফর ইকবাল। কেন? কারণ মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে তাঁর একক যে অবদান, বাকিদের সামষ্টিক অবদানও তত হবে কিনা সন্দেহ! দেশে যখন বিএনপি - জামাত ক্ষমতাধর হয়েছে, রাজাকারের গাড়িতে দেশের পতাকা উঠেছে, স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি শক্তিশালী হয়েছে - তখন তিনি ক্রমাগত এই অপশক্তির বিরুদ্ধে লিখে গেছেন। দেশে যখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে মুছে ফেলা হয়েছে, তখন তিনি একা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গুলো কিশোর উপন্যাস - কলামের মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন। এর জন্য তাঁকে হুমকী পেতে হয়েছে, কাফনের কাপড় পাঠানো হয়েছে তাঁকে হুমকী হিসেবে, তাঁর বাড়িতে বোমাহামলা করা হয়েছে, মৌলবাদীদের আক্রমণের সবথেকে বড় টার্গেটে পরিণত হয়েছেন তিনি। যে মানুষটি বিদেশে আরাম - আয়েশে কাটিয়ে দিতে পারতেন, সম্মানজনক জীবন যাপন করতে পারতেন - সব ছেড়েছুড়ে দেশে এসে তিনি বোমা হামলার শিকার হয়েছেন, নিজের জীবন বিপন্ন করেছেন। কেন? সেটা আপনারা বুঝবেন না, বিপ্লবী ফেসবুকজীবীগণ!
এই দেশের লাখো তরুণ যে এখনো মুক্তিযুদ্ধকে বুকে লালন করে, অনুভব করে সাল - তারিখের ইতিহাসের বাইরেও - এটার পিছনে সব থেকে বেশি অবদান এই মানুষটির। তিনি তাঁর সহজাত সরল ভঙ্গিতে সেই দুঃসময়ের কথা লিখে গেছেন বলে, এটাকে আপনাদের কাছে কাপুরুষতা বলে মনে হল? কাদের সিদ্দিকীর মত বীর মুক্তিযোদ্ধাও যখন জামাতের সাথে হাত মিলিয়ে তাদের সাথে সুর মেলায়, তখন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীর থেকে একজন ‘খাটের তলে লুকিয়ে থাকা’ মুহম্মদ জাফর ইকবাল আমাদের কাছে অনেক বেশি সম্মানের দাবীদার।
এই বিষয়ে এত কথা ব্যয় করাটা সম্ভবত ফলাফলশূন্য। কারণ জাফর ইকবাল এমন একজন মানুষ যিনি আওয়ামীলীগ - বিএনপি - জামাত - বাম নির্বিশেষে সকলের চক্ষুশূল। কারণ তিনি স্পেডকে স্পেড বলতে জানেন। যেকোন অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন। প্রশ্ন ফাঁসের বিরুদ্ধে এই মানুষটি একদম একা লড়ে যাচ্ছেন সেই শুরু থেকে। মুক্তমনা ব্লগারদের হত্যা করার পর যখন দেশের তাবৎ বুদ্ধিজীবীরা নিশ্চুপ, তখন তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ক্রমাগত মুক্তমনা হত্যা নিয়ে লিখে গেছেন। কাজেই, তিনি অনেকেরই শত্রু। তাই অধিকাংশই তক্কে তক্কে থাকে, কখন তাঁর কোন লেখা থেকে কী খুঁত বের করা যায়!
যেমন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রসঙ্গে তাঁর একটি লেখাকে কেন্দ্র করে আবারো একই বিতর্ক তৈরি হয়েছে। তিনি ২০০৯ সালে প্রকাশিত একটি লেখায় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পর্কে বিভিন্ন ‘আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন’। গত ২৯ ডিসেম্বর এক লেখায় তিনি এই প্রকল্পকে স্বাগত জানিয়েছেন। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতেই পারে তিনি ‘ডিগবাজি খেয়েছেন’! ২০০৯ এবং ২০১৭ দুটোই আওয়ামী-রাজত্বের সময়। এর মধ্যে এমন কোন ঘটনা ঘটেনি যার জন্য তিনি ডিগবাজি খাবেন। নিচে লেখা দুটোর লিঙ্ক দিয়ে দেয়া হল- আপনারা মিলিয়ে নিন।
স্যারের ২০০৯ সালের লেখাটির লিংক এবং বিদায়ী বছরের ২৯ ডিসেম্বরের লেখাটির লিংক।
আমি নিজেও দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছিলাম এই লেখা দেখে। তাই আন্দাজে কিছু বলার আগে, সরাসরি তাঁকে জিজ্ঞাসা করাই শ্রেয় মনে করলাম। স্যারের সাথে ই-মেইলে আমার কথোপকথনের স্ক্রিনশট দেয়া হলো-
স্যার প্রথম লেখাটিতে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন পরবর্তীতে তাঁর সেই আশঙ্কা দূর হয়েছে। ২০০৯ সালে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সব কিছু পাকাপাকি ছিল না। এখন আমরা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রযুক্তি সম্পর্কে জানি, চুক্তি সম্পর্কে জানি আর এটাও জানি সৃষ্ট পারমাণবিক বর্জ্র্য রাশিয়াই নিয়ে যাবে। যদিও ব্যক্তিগতভাবে আমি এখনো পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের থেকে অন্য কোন মাধ্যমকেই বেশি গুরুত্ব দেব, কিন্তু দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা অস্বীকার করার উপায় নেই।
এ প্রসঙ্গে ‘বিজ্ঞানচিন্তা’ পত্রিকার সম্পাদকীয় দলের সদস্য শিবলি সারোয়ারের মতামতটি উল্লেখ করা যেতে পারে-
“বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে গ্রিন এনার্জি দিয়ে শক্তির পুরো চাহিদা পূরণ করা সম্ভব না। কেন সম্ভব না, সোলার সেলের ইফিশিয়েন্সি, কারেন্ট টেকনোলজি নিয়ে যাদের পড়াশোনা আছে, তারা ভালোভাবেই জানে। আমাদের সেজন্যে হয় হাইড্রোইলেকট্রিক, নাহয় নিউক্লিয়ার এনার্জি লাগবেই।
নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট আমরা কতোটা আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করবো, নিরাপত্তার বিষয়গুলি আমরা কতোটা গুরুত্ব দিয়ে নিবো, তার ওপর কিন্তু আমাদের দেশে নিউক্লিয়ার এনার্জির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। এমনিতে, আমাদের নিউক্লিয়ার এনার্জি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার লাক্সারি নাই। আমাদের চায়না, কিংবা ইউএসএর মতো বিশাল মরুভূমি নাই, খোলা জায়গা নাই, যে আমরা মাইলের পর মাইল সোলার প্যানেল বসিয়ে কয়েকশো মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ন্যাশনাল গ্রিডে যোগ করতে পারবো। আমাদের উইন্ড এনার্জি ইউজ করার সুযোগও নাই। ফলে, আপাতত, নিউক্লিয়ার ছাড়া আমাদের অদূর ভবিষ্যতে যে বিশাল ইলেকট্রিসিটির চাহিদা তৈরি হবে, সেটার জন্যে একাধিক নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট লাগবে”।
এ প্রসঙ্গে অনলাইন একটিভিস্ট নিশম সরকারের বক্তব্যও উল্লেখ করা যেতে পারে-
ভালো করে পড়লে এবং জাফর বিদ্বেষ আগে থেকেই না থেকে থাকলে দেখা যায় যে, ২০০৯ সালে তিনি কয়েকটা পয়েন্টে আশংকা প্রকাশ করেছিলেন, সেখানে তিনি কোথাও বলেন নাই যে পারমানবিক বিদ্যুতকেন্দ্র এই দেশে বানানো যাবে না, বা বানানো উচিত হবে না। ২০০৯ এ রুপপুর পারমানবিক বিদ্যুতকেন্দ্র এর প্ল্যান তখনও প্রিমিটিভ পর্যায়ে ছিলো। এখন যখন প্ল্যানগুলা কমপ্লিট এবং ওপেন, এবং যখন দেখছে তার প্রশ্নগুলার সাথে কনফ্লিক্ট করে না, তাইলে সমস্যা কি সাপোর্ট করতে? তিনি বর্জ্য নিয়ে চিন্তিত ছিলেন, রাশিয়া রাজী হইছে বর্জ্য নিতে। তিনি প্রযুক্তি নিয়ে চিন্তিত ছিলেন, ৮ বছর পরে তিনি রুপপুরের প্রযুক্তি নিয়া আশ্বস্ত হইছেন। তিনি যেই যেই জায়গায় জায়গায় সংশয় প্রকাশ করছেন, তার সংশয় দূর হইলে সেইটা সাপোর্টে কেনো ডিগবাজি খাওয়া হবে? রাশিয়ার পারমানবিক বর্জ্য ফেরত নেয়ার নিউজ এই লিংকে।
২৯ ডিসেম্বরের ঐ লেখাতে জাফর ইকবাল স্যার কিন্তু প্রশ্ন-ফাসের কথা বলেছেন, অন্যায়ভাবে গুমের বিরুদ্ধে বলেছেন- কিন্তু আমাদের চোখে পড়েছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কথাটাই। আর ওমনি ‘ইউরেকা ইউরেকা’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়েছি আমরা। কারণ শেষ পর্যন্ত আমাদের ‘সমস্যাটা ঐ জাফর ইকবালেই…’!
স্যার, আমরা জানি, আপনার যতটুকু সম্মান প্রাপ্য ছিল আমরা সেটা দিতে পারিনি। আমরা জানি, আপনি আরামের জীবন ছেড়ে এই দেশে এসে পড়ে আছেন - এর পিছনের ব্যাপারটুকু আমরা ভালো মত অনুভব করতে পারিনি। আমরা জানি, সব দিক থেকে এত আক্রমণের পরেও আপনি থেমে থাকবেন না। লিখবেন আপনার সাদাসিধে কথা গুলো... যে কথা গুলো লাখ লাখ তরুণকে দেশপ্রেম শেখাবে, মুক্তিযুদ্ধ অনুভব করতে সাহায্য করবে, বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তুলবে। স্বাধীনতাবিরোধী, দুর্বৃত্ত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কিংবা বিপ্লবী ফেসবুকজীবীরা যাই বলুক না কেন - আপনার সাদাসিধে কথাগুলো চলুক আরো বহু দিন।
লিখেছেন - Rafee Shams
Post a Comment Blogger Facebook