মেহেরুন্নেন্সার বাবা ক্যান্সারে মারা গিয়েছিলেন অকালে। ছোট ভাই দুটো আর আর মাকে নিয়ে গড়া ছোট্ট পরিবারের হাল ধরবার জন্য নিজের সৃজনশীল কবি মনকে শক্ত বাঁধনে বেঁধে পত্রিকায় কপি লেখা আর প্রুফ দেখার কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। সেসময়ের প্রায় সব পত্রিকাতেই তার কবিতা ছাপা হত, কিন্তু সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে একটা সময় আর শিল্প-সংস্কৃতিতে সময় দিতে পারলেন না তিনি। নিজের অপার সম্ভবনাময় প্রতিভা ছোট ভাই দুটোকে মানুষ করার পেছনেই ব্যয় হচ্ছিল। তবুও, এতো কষ্টের ভেতরেও মার্চের সেই উত্তাল সময়ে কবিতা লেখা থেমে ছিল না তার। বিশেষ করে-
“সাত কোটি জয় বাংলার বীর! ভয় করি নাকো কোন/কবিতাটা প্রকাশ হবার পর সাড়া ফেলে চারিদিক। তার কলমের শক্তি জানান দেয় তার ভেতরের বারুদের গল্প। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী, বিহারী ও রাজাকারদের রক্তচক্ষূকে উপেক্ষা করে পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবসে নিজ বাড়ির ছাদে উড়িয়েছিলেন লাল-সবুজের পতাকা। অবাঙ্গালী ও বিহারীদের হাতে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত মিরপুরের বাঙ্গালিদের রক্ষার জন্য যিনি প্রিয় বান্ধবী কাজী রোজীকে সাথে নিয়ে গঠন করেছিলেন - “অ্যাকশন কমিটি”। একজন মুক্তিযোদ্ধা, সাহসী বিপ্লবী কবির পরিচয়টা এক পাশে রাখলেও সেই ৪৬ বছর আগে একজন নারীর এমন অসামান্য তেজ ও দীপ্তিভরা পথচলা আমাদের বিস্ময়াবিভূত করে। অথচ তাকে ন্যুনতম স্বীকৃতি তো দূরে থাক, আমরা তাকে ভালোভাবে চেনা তো দূরে থাক, আমরা তার নামটাও জানি না!
বেয়নেট আর বুলেটের ঝড় ঠেলে- চির বিজয়ের পতাকাকে দেবো,
সপ্ত আকাশে মেলে
আনো দেখি আনো সাত কোটি এই দাবীর মৃত্যু তুমি
চির বিজয়ের অটল শপথ
জয় এ বাংলায় তুমি....”
তার এই প্রবল সাহসী যুদ্ধ পাকিস্তানীরা এবং তাদের দোসর রাজাকার আলবদরেরা মেনে নিতে পারলো না। ২৫শে মার্চের সেই পৈশাচিকতম গণহত্যার পর মিরপুর এলাকা পুরোপুরি চলে গেল অবাঙ্গালী বিহারী নরপিশাচদের হাতে। তারা মেতে উঠলো জবাই-কুপিয়ে বাঙ্গালী হত্যার বর্বোরচিত উৎসবে! সেই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের এক পর্যায়ে মার্চের ২৭ তারিখ মিরপুরের কুখ্যাত কসাই কাদের মোল্লার (যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসী হয়েছে) নেতৃত্বে বিহারী এবং রাজাকারদের একটি দল মিরপুর ৬ নম্বর ডি ব্লকে কবি মেহেরুন্নেসার বাড়িতে আক্রমণ করে। মানুষটা একটা স্বাধীন বাংলাদেশ চেয়েছিলেন, অনলবর্ষী কবিতা বেরোত তার আঙ্গুল ফুঁড়ে... কত বড় সাহস, ভাবা যায়?
তাই মুশরিক, কাফের, ভারতের দালাল ইত্যাদি বিশেষণ দিয়ে প্রথমে ওরা মেহেরুন্নেসার ভাই দুজনকে কোপাতে শুরু করলো। এটা দেখে মেহেরুন্নেসার মা কোরআন শরীফ বুকে চেপে ধরে ওদের কাছে কাকুতিমিনতি করে বলতে লাগলেন, আমরা মুসলিম, আমাদের মেরো না। কিন্তু ঐ বর্বর নরপিশাচগুলো সেদিন কিছুই শোনেনি। চোখের সামনে মেহেরুন্নেসার ভাই দুজনকে জবাই করে ওরা ঐ মায়ের সামনেই মেহেরুন্নেসাকে প্রচন্ড যন্ত্রণা আর নির্যাতনে একটু একটু করে হত্যা করে।
মেহেরুন্নেসার দুই ভাইয়ের মাথা নিয়ে ফুটবলের মতো খেলেছিল সেদিন ওরা। আর মেহেরুন্নেসার দেহ থেকে মাথা আলাদা করে চুল দিয়ে ফ্যানের সঙ্গে বেঁধে মাথাটা টাঙ্গিয়ে দিয়েছিল কাদের মোল্লা, আর দেহটা কাপড় শুকানোর তারে কাপড় শুকাবার মত করে ঝুলিয়ে রেখেছিল বিহারীরা। এই বীভৎস পৈশাচিকতার পুরোটাই তারা দেখতে বাধ্য করেছিল ওরা মেহেরুন্নেসার মাকে! যখন তিন সন্তানকে মায়ের সামনেই মেরে ফেলা হলো, এরপর ওরা কোরআন শরীফ বুকে চেপে থাকা মাকেও জবাই করে। কত বড় নৃশংস জালিম হলে নিজেকে মুসলমান পরিচয় দিয়ে কিছু মানুষ এমন অচিন্তনীয় নৃশংসতা চালাতে পারে, ভাবতে পারেন? পাশের বাসার এক প্রতিবেশী দেখেছিলেন এই পুরো ঘটনা, পরে তিনি পাগল হয়ে যান, সবসময় বলতে থাকতেন কিভাবে ওরা এই পুরো পরিবারের চারজনকে কসাই কাদের মোল্লা এবং বিহারী এবং রাজাকারেরা মেরেছে। হা হা অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছিল সেদিন কাদের মোল্লাসহ পাকিস্তানী ভাইয়েরা, কোরআন শরীফ বুকে জড়িয়ে একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসেবে প্রাণভিক্ষা চেয়েও বাঁচতে পারেননি মেহেরুন্নেসার মা।
প্রিয় পাঠক, আর কিছু না, স্রেফ এটুকু চিন্তা করুন তো, আপনার সামনে আপনার সন্তানকে কেউ জবাই করছে, আর আপনাকে বাঁচিয়ে রেখেছে শুধুমাত্র আপনার সন্তানকে বীভৎসভাবে জবাইয়ের সেই দৃশ্য দেখবার জন্য! একটা সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে ভাবতে চেষ্টা করুন তো দৃশ্যটা! কি, পারছেন?
কসাই কাদের মোল্লার বিচার চলাকালে আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দী দিয়েছিলেন শহীদ কবি মেহেরুন্নেসার বন্ধু কবি কাজী রোজি। তার বর্ণনা থেকে উঠে এসেছে কবি মেহেরুন্নেসার উপর নির্যাতনের চিত্রঃ
একাত্তরে নিহত কবি মেহেরুন্নেসা আমার ঘনিষ্ট বন্ধু ছিল। আমরা একই এলাকায় থাকতাম। একাত্তরে মিরপুরে অবাঙালী ও বিহারীরা বাঙালীদের ভীষণভাবে অপমানিত ও লাঞ্চিত করত। এ থেকে রেহাই পাবার জন্য ঐ নির্বাচনের সময় আমরা একটা এ্যাকশন কমিটি গঠন করি। আমি ছিলাম ঐ কমিটির সভাপতি, কবি মেহেরুন্নেসাসহ আরও অনেকে ছিল সদস্য। মিরপুরের অবাঙালীরা এজন্য আমাদের প্রতি বৈরী মনোভাব পোষণ করত। এটা বুঝতে পেরে আমরা অ্যাকশন কমিটির পক্ষ থেকে মিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিন মিটিং-মিছিল করতে থাকি।অথচ এই কাদের মোল্লার সর্বনিম্ন শাস্তি ফাঁসীর দাবিতে যখন আমরা রাস্তায় নামলাম, তখন অনেকেই ইনিয়েবিনিয়ে বলতে চেয়েছিল, এই কাদের মোল্লা সেই কাদের মোল্লা না! ইনি একজন নিষ্পাপ নিরপরাধ মানুষ। মজার ব্যাপারটা হচ্ছে, এই কাদের মোল্লার ফাঁসীর পর তার বাপের দেশ পাকিস্তান থেকেই যখন হাহাকার আর ক্ষোভ জানিয়ে বলা হলো, কাদের মোল্লা একজন সাচ্চা পাকিস্তানী দেশপ্রেমিক ছিলেন, তখন আর এদের পারলে পাকিস্তান সরকারকেও আওয়ামীলীগের দালাল বানিয়ে দেয়। একটা নরপিশাচের প্রতি মেহেরুন্নেসাদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে মেহেরুন্নেসার জীবনের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীন বাতাসে শ্বাস নিয়ে কিছু মানুষ কাদের মোল্লাকে নিষ্পাপ প্রমাণে যুদ্ধ করছে, এরচেয়ে কুৎসিত নির্লজ্জ জঘন্য দৃশ্য আজো তৈরি হয়নি!
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে আমি ও মেহেরুন্নেসাসহ অনেকেই রেসকোর্স ময়দানে গিয়েছিলাম। এই ভাষণ ছিল স্বাধীনতার ডাক। এরই মধ্যে চলে আসে ২৫ মার্চ। সেদিন সকালে আমি মিটিং করছিলাম। বুঝতে পারছিলাম একটা কিঠু ঘটতে যাচ্ছে। মিটিং শেষ করে বাসায় ফেরার পর খবর পেলাম, আমার ও কবি মেহেরুন্নেসার বাসায় তল্লাশি হবে। কারণ, এ্যাকশন কমিটিতে আমরা দু’জন ছিলাম নারী সদস্য। আমি যখন জানতে পারলাম, আমার বাসায় তল্লাশি হবে, তখন মেহেরুন্নেসার বাসায় খবর পাঠালাম। বললাম, আমি আজই বাসা ছেড়ে চলে যাব। তোমরাও অন্যত্র চলে যাও। এ খবর পাবার পর মেহেরুন্নেসা তার ছোট ভাইকে দিয়ে আমার বাসায় খবর পাঠাল যে, সে, তার মা ও দুই ভাইকে নিয়ে কোথায় যাবে ? আমি বুঝালাম, বাড়ি থেকে চলে যাওয়া একান্ত প্রয়োজন।
তারপর ২৫ মার্চের কালরাতের ঘটনা সবাই জানেন। দিন চলে গেল। ২৭ মার্চ বিকেলে আমি খবর পেলাম, মেহেরুন্নেসা, তার দুই ভাই ও মা কে কাদের মোল্লা ও তার সহযোগী অবাঙালীরা হত্যা করেছে। অবাঙালীদের মধ্যে কেউ কেউ মাথায় সাদা ও লাল পট্টি বেঁধে মেহেরুন্নেসার বাসায় সকাল এগারটায় ঢুকে যায়। মেহেরুন্নেসা যখন দেখল, ওরা তাদের মারতে এসেছে, তখন তিনি বুকে কুরআন শরীফ চেপে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ওরা কবি মেহেরুন্নেসাসহ চারজনকে জবাই করে। পরে গুলজার ও আরও অবাঙালীর কাছ থেকে শুনেছিলাম, কবি মেহেরুন্নেসাকে গলা কেটে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। মেহেরুন্নেসা তখন গলা কাটা মুরগীর মতো ছটফট করছিল। এই বীভৎস সংবাদ পেয়ে কষ্ট পেয়েছিলাম। মেহেরুন্নেসার জন্য আজ অবধি আমি কষ্ট পাই। আজ আমি এখানে কাঁদতে আসিনি। এ হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবীতে এসেছি। আমি সত্যিকার অর্থে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই। আমি বিচার দেখে যেতে পারব কিনা জানিনা। আমার ভিতর কোন রাগ নেই, আছে শুধুই ঘৃণা।
আজ সেই শহীদ কবি মেহেরুন্নেসার ৭৭তম জন্মবার্ষিকী। শুভ জন্মদিন কবি! ভাবতেও আফসোসে কুঁকড়ে যাচ্ছে ভেতরটা যে, আজ ৪৬ বছর পরেও আপনার জন্মদিনে অবাক জিজ্ঞেস করতে হয় আমাদের, মেহেরুন্নেসা কে? এ লজ্জা কোথায় রাখি!
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ Club Obscure
স্কেচঃ S M Saiful Islam
Post a Comment Blogger Facebook