১৮ এপ্রিল, ১৯৭১, রবিবার
বাদশা আসবে দশটায়, তার সঙ্গে রিকশায় করে পুরনো ঢাকায় যাব। শরীফ গাড়ি নিয়ে যেতে দিতে নারাজ-একই গাড়ি বিভিন্ন রাস্তায় ঘুরছে দেখলে আর্মি সন্দেহ করতে পারে। আমি, রুমী বা জামীকে নিয়ে যেতে সাহস পাই নে। অতএব, ভাগনীজামাই বাদশাই আমার ভরসা। সে ডাক্তার মানুষ। তার কাজ-কারবার ঐ পুরনো ঢাকারই মিটফোর্ড হাসপাতালে।
শরীফ রুমী-জামীকে নিয়ে চুল কাটাতে যাবে ঢাকা ক্লাবে। ওরা বেরোবার উদ্যোগ করছে, হঠাৎ দেখি বেয়াই-বেয়ান এসে হাজির। শরীফের বন্ধু ইঞ্জিনিয়ার আমিরুল ইসলাম, ওকে আমরা বেয়াই বলে ডাকি। রোববার সকালে ওরা প্রায়ই এরকম বেড়াতে বেরোয়। আজ কিন্তু ওদের মুখ থমথমে বিষন্ন। আরেক ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু নূরুর রহমানের মৃত্যুসংবাদ দিল। গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিল। পথে এক জায়গায় পাক আর্মি ওদের গোটা দলটার ওপর গুলি চালায়।
মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। আমাদের জানাশোনার গণ্ডির ভেতরে, খুব নিকট একজনের মৃত্যুসংবাদ এই প্রথম শুনলাম। এত হাসিখুশি, আমুদে মানুষ ছিল নূরুর রহমান। যেখানেই যেত, সবাইকে মাতিয়ে তুলত। সেই মানুষ আর্মির গুলি খেয়ে মারা গেছে?
বেয়াই বলল, “নূরু একা গেলে হয়তো মারা পড়ত না। সে তার বন্ধুর পরিবারের অনেক লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছিল তার গ্রামের বাড়িতে। দলে ছোট ছেলেপিলেও ছিল।”
“বন্ধুটি কে? তার কিছু হয়নি তো?”
“বন্ধুটির নাম ভিখু চৌধুরী। সে আর তার বউও মারা গেছে।”
ভয়ানকভাবে চমকে উঠলাম, “ভিখু চৌধুরী? আমাদের ভিখু আর মিলি নয় তো? ”
“মিলি? হ্যাঁ হ্যাঁ, মিসেস চৌধুরীর নাম মিলি তো বটে!”
ব্যাকুল হয়ে বললাম, “ভিখু আমাদের আত্মীয়। এবং বন্ধুও। কবে ঘটেছে এ ঘটনা? কার কাছে শুনলেন?”
“তিন তারিখে। নূরুর কাজের ছেলেটাও ওদের সঙ্গে ছিল। সে এতদিন পরে ফিরে এসেছে। গতকাল আমার বাসায় গিয়ে সব বলেছে।”
উঃ! কি সাংঘাতিক। আজ আঠারো তারিখ, পনের দিন আগে ঘটে গেছে এই মর্মান্তিক ঘটনা। কেউ কিছু জানি না। কি রকম বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মধ্যে বাস করছি আমরা ঢাকা শহরে। ভিখু অর্থাৎ মাসুদুল হক চৌধুরী সুলেখা প্রেসের মালিক, আসাদ গেটের কাছে নিউ কলোনিতে তার বাসা। আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়-ইদানীং যাওয়া-আসা একটু কমই হত। কিন্তু এক সময় অনেক বছর আগে এই ভিখু আর মিলি কতো প্রিয় ছিল আমাদের।
আমি বেয়াইকে জিগ্যেস করলাম, “ভিখুর ছেলেমেয়েদের কথা কিছু জানেন? তারা বেঁচে আছে তো? আর কে কে ছিল দলে?”
ভিখুর ছেলেমেয়েদের কিছু হয় নি। ওর মা আর বোন গুলিতে জখম হয়েছে। তবে বেঁচে আছে।”
“ওরা কোথায় আছে এখন জানেন কি?”
“না, জানি না।”
বাদশা এল। শরীফ বলল, “তোমরা কিন্তু একই রিকশাতে ঘুরো না। একেক জায়গায় নেমে রিকশা ছেড়ে দিয়ো যেন কিছু কেনাকাটা করতে বেরিয়েছ। দু’চারটে দোকানে ঢ়ুকে এদিক ওদিকে খানিক হেঁটে তারপর আরেকটা রিকশা নিয়ো।”
লালবাগ দিয়ে শুরু করলাম। চকবাজারে নেমে দু’চারটে দোকান ঘুরলাম। চকবাজার না বলে তার ধ্বংসাবশেষ বলাই ভালো। তবু ওরই মধ্যে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে বসে আছে কিছু মানুষ যারা এখনো পাক আর্মির গুলি খেয়ে শেষ হয়ে যায় নি। তারপর ইসলামপুর, শাঁখারি পট্টি, ওয়াইজঘাট, পাটুয়াটুলী, সদরঘাট, নবাবপুর ঘুরে জিন্নাহ এভিনিউ দিয়ে বেরিয়ে এলাম। সবখানেই বর্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ধ্বংসলীলার চিহ্ন প্রকট, কিন্তু শাঁখারিপট্টির অবস্থা দেখে বুক ভেঙে গেল। ঘরবাড়ি যেভাবে ভেঙেছে, মনে হয় ভারি গোলা ব্যবহার করতে হয়েছিল। এতদিনে লাশ সব সরিয়ে ফেলেছে, কিন্তু বাতাসে এখনো পঁচা গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। মেঝেয়, বাবান্দায়, সিঁড়িতে এখনো পানি রয়েছে, রাস্তাতেও পানি। মনে হচ্ছে জমাট রক্ত ধুয়ে সাফ করার কাজ এখনো শেষ হয় নি। প্রায় সব ঘরেরই দরজা-জানালা ভাঙা, কোন কোন দরজার সামনের চট ঝুলছে। চটগুলোর চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে এগুলো সদ্য কিনে ঝোলানো হয়েছে।
প্রতিটি বিধ্বস্ত ঘরের সামনে একটা করে কাগজ ঝুলছে। কি যেন সব লেখা।
কাছে গিয়ে দু’একটা পড়লাম। উর্দুতে লেখা কতগুলো মুসলিম নাম। শুনলাম, বিহারিদের এ জায়গাটা ভাগ বাটোয়ারা করে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। যারা পেয়েছে, তারা বরাদ্দকৃত ঘরের সামনে নিজ নিজ নাম লেখা কাগজ সেঁটে বা ঝুলিয়ে আপন মালিকানার স্বাক্ষর রেখে দিয়েছে।
- শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বই থেকে
Post a Comment Blogger Facebook