আজ
হরতাল। সকালে নাশতা খাওয়ার পর সবাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলিফ্যান্ট রোডের
মাঝখান দিয়ে খানিকক্ষণ হেঁটে বেড়ালাম। একটাও গাড়ি, রিকশা, স্কুটার এমনকি
সাইকেলও নেই আজ রাস্তায়। রাস্তাটাকে মনে হচ্ছে যেন আমার বাড়ির উঠোন!
হরতালের দিনে ফাঁকা রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটা আমাদের মত আরো অনেকেরই বিলাস
মনে হয়। পাড়ার অনেকের সঙ্গেই দেখা হল। হাঁটতে হাঁটতে নিউ মার্কেটের দিকে
চলে গেলাম। কি আশ্চর্য! আজকের কাঁচাবাজারও বসে নি। চিরকাল দেখে আসছি
হরতাল হলেও কাঁচা বাজারটা অন্তত বসে। আজ তাও বসে নি। শেখ মুজিবরসহ সবগুলো
ছাত্র, শ্রমিক ও রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে যে সর্বত্র যানবাহন, হাটবাজার,
অফিস-আদালত ও কলকারখানায় পূর্ণ হরতাল পালনের ডাক দেওয়া হয়েছে, সবাই সেটা
মনেপ্রাণে মেনে নিয়েই আজ হরতাল করছে।
নিউ মার্কেটের দিক থেকে ফিরে হাঁটতে হাঁটতে আবার উল্টো দিকে গেলাম হাতিরপুল পর্যন্ত। আমাদের সঙ্গে কিটিও হাঁটছে। রাস্তায় লোকেরা ওর সোনালি চুলের দিকে বাঁকা চোখে তাকাচ্ছে। ভাবছি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যাই।
বসার ঘরে ঢুকে রুমী “আরেক কাপ চা হোক।” বলেই হাক দিল, “সুবহা-ন।”
সুবহান এ ঘরে আসতেই আমি বললাম, “পাঁচ কাপ চা দিয়ে যাও।”
সুবহান চা বানিয়ে এনে সেন্টার টেবিলে ট্রে-টা রেখে রুমীকে লক্ষ্য করে বলল, “ভাইয়া, তিনটার সুমায় পল্টনের মিটিংয়ে যাইবেন?”
রুমী গম্ভীর গলায় শুধোল, “কেন তুমি যেতে চাও আমাদের সঙ্গে?”
সুবহান কাঁচুমাচু মুখে বলল, “আমায় যুদি পারমিশুন দ্যান।”
আমি হাসি চেপে গম্ভীর মুখে বললাম, “তাড়াতাড়ি রান্না সারতে পারলে যেতে পারবে।”
সুবহান কৃতার্থের হাসি হেসে প্রায় দৌড়ে রান্নাঘরে চলে গেল।
রুমী নিচু গলায় বলল, “ওর মধ্যে কিন্তু বেশ রাজনৈতিক চেতনা আছে।”
চা খেয়ে উঠে দাড়াল, “আম্মা একটু বটতলা ঘুরে আসি। ছাত্রলীগ আর ডাকসু মিটিং ডেকেছে।”
আমি আপত্তি জানিয়ে বললাম, “এখন আর হেঁটে হেঁটে অদ্দুর যাবার দরকারটা কি? তুই তো কোনো দলের মেম্বার নস। তোর এত সব মিটিংয়ে যাওয়া কেন?”
রুমী বলল, “এখন কি আর ব্যাপারটা দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে নাকি আম্মা? এখন তো-এ আগুন ছড়িয়ে গেছে সবখানে।”
এই এক স্বভাব রুমী। কথায় কথায় ইংরেজী-বাংলা কত যে কবিতার উদ্ধৃতি দিতে পারে ও। মনেও থাকে বটে। আমি নাচার হয়ে বললাম, “যাবি যা। তবে দেরী করিস না। যা করবি, কর, কিন্তু ঠিক সময়ে খাওয়া-দাওয়া করে। বুঝলি?”
“আচ্ছা আম্মা।” বলে রুমী বেরিয়ে গেল।
আমি খবর কাগজের দিকে চোখ নামালাম। ঢাকায় যতগুলো ছাত্র, শ্রমিক, রাজনৈতিক দল আছে সবাই আজ মিটিং ডেকেছে। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও ডাকসুর যৌথ উদ্যোগে এগারোটায় বটতলায়, তিনটেয় পল্টন ময়দানে। ন্যাপ এগারোটায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে, বিকেলে পল্টনে। ন্যাপের কর্মসূচীর সঙ্গে সমর্থনে রয়েছে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, কৃষক সমিতির। বাংলাদেশ জাতীয় লীগের সভা বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে– বিকেল সাড়ে তিনটেয়। নবগঠিত ফরোয়ার্ড স্টুডেন্টস ব্লকের সভাও ঐ বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গনেই – বিকেল চারটেয়।
সব দলই মিটিং শেষে বিক্ষোভ মিছিল বের করবে।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত করে পূর্ব পাকিস্তানে ভীমরুলের কেক ঢিল ছুঁড়েছে।
তিনটের সময় রুমী, জামী, শরীফ, সুবহান– সবাই চলল পল্টন ময়দানের দিকে। রিকশা করে গেল। গাড়ি নিল না। অত ভিড়ে গাড়ি নিয়ে আরামের চেয়ে ঝামেলাই বেশি। কিটি জিজ্ঞেস করল, সে মিটিংয়ে যেতে পারবে কি না। আমি সকালের কথা ভেবে একটু ইতস্তত করে বললাম, “তোমার না যাওয়াই ভালো। ভিড়ের মধ্যে কখন না জানি চ্যাপ্টা হয়ে যাও। দেখ না, আমি যাচ্ছি না।” কিটি বুদ্ধিমতী। আসল কথাটা বুঝে মুখ কালো করে নিজের ঘরে চলে গেল।
বারেকও যেতে চেয়েছিল। কিন্তু বাবা ঘুম থেকে উঠবেন চারটেয়, তাঁকে ওঠানো, মুখ ধোয়ানো– আমি যেতে দিলাম না। তাছাড়া একটু মায়ের বাসায় যাওয়া দরকার।
সকালে হেঁটে পারব না বলে যাইনি। দুটোর পর রিকশা চলছে।
সাড়ে চারটেয় বাবাকে চা-নাশতা খাইয়ে তাঁর সঙ্গে খানিক কথা বলে বারেককে কাছে বসিয়ে রেখে আমি গেলাম মা’র বাসায়– ধানমন্ডি ছয় নম্বর রাস্তায়।
- শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বই থেকে
Post a Comment Blogger Facebook