৩ মার্চ, ১৯৭১, বুধবার
কালরাতে
একদম ঘুম হয়নি। রাত আটটায় হঠাৎ কারফিউ। সারা দিন ধরে যত মিটিং আর মিটি –
শেষে লাঠিসোঁটা-কাঠ-রড নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল, সন্ধ্যের পরেও তার বিরাম ছিল
না। আরো বেরিয়েছিল মশাল মিছিল। রেডিওতে কারফিউয়ের ঘোষণা আমরা শুনিনি।
তাই বুঝিনি কারফিউ ঘোষণার প্রতিবাদেই বেশি বেশি শ্লোগান। ভেবেছি সারা
দিনের জের ওটা। কিন্তু হঠাৎ সাইরেনের বিকট আওয়াজে চমকে উঠেছি। কি ব্যাপার? কি ব্যাপার? একে-ওকে ফোন করে জানতে পারলাম ওটা কারফিউ জারির সাইরেন।
রাত এগারোটার দিকে মাইকেও কারফিউ জারির ঘোষণা দূর থেকে কানে এল। শব্দ শুনে মনে হল, বলাকা নিউ মার্কেটের রাস্তায় এবং আমাদের বাড়ির দক্ষিণ দিকে ইকবাল হলের সামনের রাস্তায়। তার পরপরই বহু কন্ঠের শ্লোগান আরো জোরে শোনা যেতে লাগল। তার মানে কারফিউ অগ্রাহ্য করে মিছিল আর শ্লোগান। কেমন যেন অস্থির লাগতে লাগল। ভাবলাম, কয়েক জায়গায় ফোন করি অবস্থা জানবার জন্য– গুলশানে রেবাকে, মদনমোহন বসাক রোডে মনোয়ারাকে আর ইন্দিরা রোডে কামালকে।
রেবা বলল, “এখানে রাস্তায় কোনো মিছিল নেই; কিন্তু দূর থেকে শ্লোগানের শব্দ পাচ্ছি, আমাদের পেছন দিকটাতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিতা তো।”
মনোয়ারা আমার ফোন পেয়ে কেঁদে ফেলল, “কি যে হচ্ছে আপা! কেউ কারফিউ মানছে না, দলে দলে লোক রাস্তায় নেমে গেছে, ব্যারিকেড বানাচ্ছে, শ্লোগান দিচ্ছে। পুলিশও গুলি করছে। গুলি খেয়ে লোকে আরো ক্ষেপে উঠছে, দ্বিগুণ জোরে শ্লোগান দিচ্ছে। আমার ভাইটাও ওর মধ্যে আছে। জানি না বেঁচে আছে, না গুলি খেয়ে রাস্তায় পড়ে গেছে। কি হবে আপা?”
মনোয়ারার কান্না শুনে মনটা বিকল হয়ে গেল। আর কাউকে ফোন করতে ইচ্ছে হল না। সারারাতই কানে এল শ্লোগানের সম্মিলিত গর্জন।
আজ সকালে খবর কাগজে গত রাতের মিছিল ও গুলির খবর বিস্তারিত পড়লাম স্টেডিয়াম, নবাবপুর, টয়েনবী সার্কুলার রোড, ভজহরি সাহা স্ট্রিট, গ্রীন রোড, কাঁঠালবাগান, কলাবাগান, নিউ মার্কেট, ফার্মগেট– ঢাকার প্রায় সব এলাকাতেই কারফিউ ভঙ্গকারী জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়েছে, বহুলোক মারা গেছে, তার চেয়েও অনেক বেশি আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
কাগজে আরেকটা খবর দেখলাম– বক্স করে দেওয়া হয়েছে:
১১০ নম্বর সামরিক আদেশ জারি।
‘খ’ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক লেঃ জেনারেল সাহেবজাদা মোঃ ইয়াকুব খান গতরাতে এখানে ১১০ নম্বর সামরিক আদেশ বলে পত্রপত্রিকাসমূহে পাকিস্তানের সংহতি বা সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী খবর, মতামত বা চিত্র প্রকাশ নিষিদ্ধ করেছেন।
আদেশ লঙ্ঘনে দশ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড।
খবরগুলো পড়ছি আর বুকের ভেতর কেমন যেন দম আটকানো ভাব হচ্ছে। ভাবলাম মনোয়ারাকে ফোন করি– খবর নিই ওর ভাইটা কেমন আছে। বাড়ি ফিরেছে কিনা। কিন্তু ফোনের কাছে গিয়েও ফোন তুলতে পারলাম না।
রুমীকে নিয়ে আমার হয়েছে মহা উদ্বেগ। সারাদিন টো-টো করে সারা শহর দৌড়ে বেড়াচ্ছে। কখন যে কি হয়। বন্ধুবান্ধব নিয়ে বাসায় ফিস্ট লাগাতে বলছি, আগে সব সময় লুফে নিয়েছে, এখন নাকি সময় নেই।
আজকেও প্রায় সারাদিনই মিটিং-মিছিল চলছে। আগের রাতে গুলিতে নিহত আটটি লাশ নিয়ে বিক্ষুব্ধ জনতা মিছিল করে ঢাকার বিভিন্ন রাস্তা ঘুরেছে, মিছিল শেষে শহীদ মিনারে লাশ রেখে সকলে সমস্বরে পূর্ব বাংলার স্বাধিকার আদায়ের শপথ নিয়েছে।
বিকেলে পল্টন ময়দানের জনসভাতেও এই লাশগুলো নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে বিশাল জনসমুদ্র শহীদদের আরব্ধ কাজ সমাপ্ত করার শপথ নিয়েছে। সভায় শেখ মুজিব সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। বলেছেন নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা পর্যন্ত বাঙালি জাতি এক পয়সাও ট্যাক্স-খাজনা দেবে না। তিনি সরকারকে বলেছেন সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে আর বাঙালি জনগণকে বলেছেন শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রেখে অহিংস অসহযোগিতা চালিয়ে যেতে।
সন্ধ্যার পর রুমী বাড়ি ফিরলে তার মুখে এসব শুনলাম। আরো শুনলাম এক নতুন পতাকার কথা। গতকালই নাকি বটতলায় ছাত্রদের জনসভায় এ পতাকা প্রথম দেখানো হয়েছিল। আজ পল্টনের জনসভায় শেখের উপস্থিতিতে প্রথমে “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি” গানটা গাওয়া হল, তারপর স্বাধীন বাংলার এই নতুন পতাকা উত্তোলন করা হল।
আমি শিহরিত হয়ে বললাম, “স্বাধীন বাংলার পতাকা? বলিস কি রে? কেমন দেখতে?”
“দাঁড়াও, এঁকে দেখাই।” বলে, একখণ্ড কাগজ ও কয়েকটা রঙিন পেনসিল এনে রুমী স্বাধীন বাংলার পতাকা আঁকতে বসল: সবুজের ওপর টকটকে লাল গোলাকার সূর্য, তার মধ্যে হলুদ রঙে পূর্ব বাংলার ম্যাপ।
আমি বললাম, “এ ক’দিন তো স্বাধিকারের কথাই শুনছি, নির্বাচিত জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথাই শুনছি, এর মধ্যে স্বাধীন বাংলার কথা কখন উঠল?”
“তুমি কোন খবর রাখো না আম্মা। স্বাধীন বাংলার দাবির কথা তো অনেক অনেক পুরনো ব্যাপার। ভেতরে ভেতরে বহুদিন থেকেই গুমরাচ্ছিল। গত বছর নভেম্বরের সাইক্লোনের পরে তা ফেটে পড়েছে। তোমার মনে নেই মওলানা ভাসানী ১৮ নভেম্বর দুর্গত এলাকা পরিদর্শনে যেতে চাইলে তাঁর জাহাজ আটকে দেয়া হয়? সরকার অবশ্য পরে তাঁকে যেতে দেয় কিন্তু এ নিয়ে কি হৈচৈটা হয়, কাগজে পড়নি? তারপরেই তো, ৪ ডিসেম্বরের সেই যে মিটিং ন্যাপ, জাতীয় লীগ আরো কি কি দল যেন একত্রে মিটিং করল, ভাসানী সেখানেই পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার দাবী জানান। তারপর এখন এখন আওয়ামী লীগের উগ্র জাতীয়তাবাদী সেকশনের কাছ থেকে স্বাধীন বাংলার দাবী উঠেছে। চার খলিফা খুব চাপ দিচ্ছে শেখকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেবার জন্য।”
“চার খলিফা?”
জান না বুঝি, আ.স.ম. আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখন আর নূরে আলম সিদ্দিকী– এই চার ছাত্রনেতাকে আমরা সবাই চার খলিফা বলে ডাকি। শাহজাহান সিরাজই তো আজ পল্টন সভায় পতাকাটা তুলেছে।”
“শেখ কি বললেন?”
“কিছুই বললেন না, তবে খুব যে খুশিও হননি, মুখ দেখে বোঝা গেল।”
“তাতো হবেনই না। এই মুহূর্তে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়াটা ভীষণ রিস্কি ব্যাপার না?”
“রিস্কি নিশ্চয়। কিন্তু আম্মা, ঘটনার একটা নিজস্ব গতি আছে না? জলপ্রপাতের মতো। উঁচু পাহাড় থেকে যখন গড়িয়ে পড়ে, তখন তাকে রুখতে পারে, এমন কোনো শক্তি নেই। আমাদের দেশের জনতা এখন ঐ জলপ্রপাতের মতো একটা অনিবার্য পরিণতির দিকে অত্যন্ত তীব্র বেগে ছুটে যাচ্ছে, এঁকে আর বোধ হয় রোখা যাবে না।”
- শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বই থেকে
Post a Comment Blogger Facebook