মুন্সি
আব্দুর রউফ (১ মে ১৯৪৩ - ১৮ এপ্রিল ১৯৭১) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে
অংশগ্রহণকারী একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে চরম
সাহসিকতা আর অসামান্য বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ যে সাতজন বীরকে বাংলাদেশের
সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করা হয় তিনি তাঁদের
অন্যতম।
জন্ম ও শৈশব
মুন্সি আব্দুর রউফ ১৯৪৩ সালের ১ মে ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার (পূর্বে বোয়ালমারী উপজেলার অন্তর্গত) সালামতপুরে (বর্তমান নাম রউফ নগর) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা মুন্সি মেহেদি হাসান ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম এবং মাতা মুকিদুন্নেসা। তাঁর ডাকনাম ছিলো রব। তাঁর দুই বোনের নাম ছিল জোহরা এবং হাজেরা। তিনি সাহসী ও মেধাবী ছিলেন, কিন্তু লেখাপড়ার প্রতি ঝোঁক ছিলো না। শৈশবে তাঁর বাবার কাছে লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়। ছোট চাচা মুন্সি মোতালেব হোসেনের সঙ্গই তাঁর অধিক প্রিয় ছিলো৷ চাচা মুন্সি মোতালেব হোসেন ছিলেন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের হাবিলদার৷ চাচা যখনই বাড়ি ফিরতেন তখনি তিনি তাঁকে শোনাতেন সৈনিকদের সুশৃঙ্খল ও রোমাঞ্চিত জীবনের গল্প৷
মুন্সি আব্দুর রউফ ১৯৪৩ সালের ১ মে ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার (পূর্বে বোয়ালমারী উপজেলার অন্তর্গত) সালামতপুরে (বর্তমান নাম রউফ নগর) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা মুন্সি মেহেদি হাসান ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম এবং মাতা মুকিদুন্নেসা। তাঁর ডাকনাম ছিলো রব। তাঁর দুই বোনের নাম ছিল জোহরা এবং হাজেরা। তিনি সাহসী ও মেধাবী ছিলেন, কিন্তু লেখাপড়ার প্রতি ঝোঁক ছিলো না। শৈশবে তাঁর বাবার কাছে লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়। ছোট চাচা মুন্সি মোতালেব হোসেনের সঙ্গই তাঁর অধিক প্রিয় ছিলো৷ চাচা মুন্সি মোতালেব হোসেন ছিলেন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের হাবিলদার৷ চাচা যখনই বাড়ি ফিরতেন তখনি তিনি তাঁকে শোনাতেন সৈনিকদের সুশৃঙ্খল ও রোমাঞ্চিত জীবনের গল্প৷
শিক্ষা ও কর্মজীবন
১৯৫৫ সালে তাঁর পিতার মৃত্যুর পর তিনি বেশিদূর লেখাপড়া করতে পারেন নি। মুন্সি আব্দুর রউফের বয়স তখন খুবই অল্প৷ বাবার মৃত্যুর পর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন ঘটতে থাকে আব্দুর রউফের জীবনাচারে৷ লেখাপড়ার প্রতি মনযোগ বাড়ে৷ এর ফলে মেধাবী বলে তাঁর সুনামও হয়৷ গাঁয়ের প্রাথমিক স্কুল শেষ করার পর ভর্তি হন থানা শহরের হাইস্কুলে৷ মায়ের দুঃখ কষ্ট দেখে তিনি বিচলিত হয়ে পড়তেন৷ চাচার কাছে শুনেছেন সপ্তম শ্রেণী পাশ করতে পারলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারবেন৷ অষ্টম পড়া অবস্থায় ১৯৬৩ সালের মে মাসে আব্দুর রউফ যোগ দেন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে৷ সেসময় তাঁকে ৩ বছর বেশি বয়স দেখাতে হয়েছিলো চাকুরিটি পাবার জন্য।
চুয়াডাঙ্গার
ইআরপি ক্যাম্প থেকে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষ করে আব্দুর রউফ উচ্চতর
প্রশিক্ষণের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে যান। ছয় মাস পরে তাকে কুমিল্লায়
নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে
চট্টগ্রামে ১১ নম্বর উইং-এ কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ইস্ট বেঙ্গল
রেজিমেন্টের সঙ্গে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদান করেন।
মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মুন্সি আব্দুর রউফ তাতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে তিনি চট্টগ্রামে ১১ উইং-এ চাকুরিরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের ল্যান্স নায়েক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি মাঝারি মেশিনগান ডিপার্টমেন্টের ১ নং মেশিনগান চালক হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি - মহালছড়ি জলপথে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এই জলপথ দিয়ে পাকিস্তানি সশস্ত্রবাহিনীর চলাচল প্রতিরোধের দায়িত্ব পরে তাঁর কোম্পানির উপর। কোম্পানিটি বুড়িঘাট এলাকার চিংড়িখালের দুই পাড়ে অবস্থান নিয়ে গড়ে তুলে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি।
যেভাবে শহীদ হন
নীরব-নির্জন
হ্রদের বুক চিরে শান্ত পানিতে অস্থির ঢেউ তুলে
এগিয়ে আসতে লাগলো সাতটি স্পিডবোট এবং দুটো লঞ্চ৷ এগুলোর মধ্যে রয়েছে
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দুই কোম্পানি সৈন্য৷ তাদের সঙ্গে ছয়টি তিন
ইঞ্চি মর্টার আর অনেক মেশিনগান ও ভারী অস্ত্রশস্ত্র৷ এটি ছিলো পাকিস্তানি
সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের কোম্পানি। মুক্তিযোদ্ধাদের
প্রতিরক্ষা ঘাঁটির কাছাকাছি পৌঁছেই পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ শুরু করে।
স্পিডবোট থেকে মেশিনগানের গুলি এবং আর লঞ্চ দুইটি থেকে তিন ইঞ্চি মর্টারের
শেল নিক্ষেপ করছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে। পাকিস্তানি বাহিনীর উদ্দেশ্য
ছিলো রাঙামাটি-মহালছড়ির জলপথ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের পিছু হটিয়ে নিজেদের
অবস্থান প্রতিষ্ঠা।
অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে খুব দ্রুতই পজিশন নিয়ে নেন পরিখায়। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর গোলাগুলির তীব্রতায় প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে যায় এবং তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক অবস্থান চিহ্নিত করে ফেলে। যুদ্ধের এই পর্যায়ে প্রতিরক্ষা ঘাঁটির কমান্ডার আব্দুর রউফ বুঝতে পারলেন, এভাবে চলতে থাকলে ঘাঁটির সকলকেই পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে মৃত্যু বরণ করতে হবে। তিনি তখন কৌশলগত কারণে পশ্চাৎপসারণের সিদ্ধান্ত নিলেন। এই সিদ্ধান্ত সৈন্যদের জানানো হলে সৈন্যরা পিছু হটতে লাগল। মুন্সি আব্দুর রউফ দেখলেন, শত্রু এগিয়ে এসেছে খুব কাছে আর এভাবে সকলে একযোগে পিছু হটতে চাইলে একযোগে সকলেই মারা পড়বে৷ কাভার দেওয়ার জন্যে কাউকে না কাউকে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে৷ তিনি পিছু হটলেন না৷ কাভার দেওয়ার জন্য নিজ পরিখায় দাঁড়িয়ে গেলেন মুন্সি আব্দুর রউফ স্বয়ং৷ ল্যান্স নায়েক আব্দুর রউফ এক একটা স্পিড বোটকে লক্ষ্য স্থির করে মেশিনগান দিয়ে অবিরাম গুলি বর্ষণ করতে থাকেন৷ তাঁর প্রচণ্ড গুলিবৃষ্টিতে থমকে গেল শত্রুরা৷ একের পর এক শত্রুসেনা লুটিয়ে পড়তে লাগলো৷ একটি একটি করে সাতটি স্পিড বোটই ডুবে গেলে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের দুটি লঞ্চ নিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। লঞ্চ দুটো পিছু হটে রউফের মেশিনগানের গুলির আওতার বাইরে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি বাহিনী এরপর লঞ্চ থেকে মর্টারের গোলাবর্ষণ শুরু করে। মর্টারের গোলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা রউফের একার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। শত্রুর একটি মর্টারের গোলা হঠাৎ এসে পড়ে তার বাঙ্কারে৷ মৃত্যুশেলে ঝাঁঝড়া হয়ে যায় তাঁর সমস্ত শরীর৷ থেমে গেলেন তিনি৷ হাত থেকে পাশে ছিটকে পড়ল মেশিনগান৷ কিন্তু তাঁর মৃত্যুর আগে সহযোগী যোদ্ধারা সবাই নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছে যেতে পেরেছিলো। সেদিন আব্দুর রউফের আত্মত্যাগে তাঁর কোম্পানির প্রায় ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধার জীবন রক্ষা পায়।
সমাধিস্থল
চির রুদ্রের প্রতীক এই বীরকে সমাহিত করা হয়েছিলো রাঙামাটি শহরের রিজার্ভ
বাজারে কেন্দ্রিয় শহীদ মিনারের পাশে৷ ১৯৯৬ সালে রাঙামাটিবাসী প্রথম জানতে
পারে, এ চিরসবুজ পাহাড়ের মাঝেই ঘুমিয়ে আছেন বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ৷ ঐ
সময় দয়ালন চন্দ্র চাকমা নামে এক আদিবাসী বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের
সমাধিস্থল শনাক্ত করেন৷ শনাক্ত করার পর তাঁর সমাধিস্থলটি সরকার নতুনভাবে
সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়৷ শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের সমাধি পার্বত্য জেলা রাঙামাটির নানিয়ার চরে অবস্থিত।
এই কবরে মহান এই বীর চিরশায়িত আছেন |
সম্মাননা
তাঁর
অপরিসীম বীরত্ব, সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে
সর্ব্বোচ সম্মান বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করে। বাংলাদেশ রাইফেলস ১৯৭৩ সালে
সিপাহি মুন্সি আব্দুর রউফকে অনরারি ল্যান্স নায়েক পদে মরণোত্তর পদোন্নতি
প্রদান করে। ২০১৪ সালে পিলখানায় বাংলাদেশ রাইফেলস কলেজের নাম পরিবর্তন করে
রাখা হয় বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ। তাঁর স্মৃতিতে
শালবাগান, চট্টগ্রাম - রাঙামাটি সড়ক, সাপছড়ির মধ্যবর্তী স্থানে
ইঞ্জিনিয়ারিং কন্সট্রাকশন ব্যাটালিয়ন (ECB-16) একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি
করেছে। মানিকছড়ি, মুসলিম পাড়া, মহালছড়ি, খাগড়াছড়ি এর একটি উচ্চ
বিদ্যালয় তাঁর নামে রাখা হয়েছে। সিলেটের একটি ক্রিকেট স্টেডিয়াম তাঁর
নামে রাখা হয়েছে। ফরিদপুর জেলার একটি কলেজ তাঁর নামে রাখা হয়েছে, যেটি
সরকারিকরণ করা হয়েছে।
সংক্ষিপ্ত জীবনী
নাম : মুন্সি আব্দুর রউফ ।
জন্ম : ১ মে, ১৯৪৯ ইং ৷
জন্মস্থান : ফরিদপুর জেলার মধুখালী থানার সালামতপুর গ্রামে ৷
পিতা : মুন্সি মেহেদী হোসেন ৷
মা : মোছাঃ মুকিদুন্নেছা ৷
কর্মস্থল : ই পি আর ( ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস)৷
যোগদান : ৮ মে ১৯৬৩ সাল৷
পদবী : ল্যান্স নায়েক ৷
মুক্তিযুদ্ধে অংশরত সেক্টর : ১ নং সেক্টর ৷
মৃত্যু : ১৮ এপ্রিল, ১৯৭১ সাল ৷
সমাধি স্থল : রাঙামাটি শহরের রিজার্ভ বাজারে কেন্দ্রিয় শহীদ মিনারের পাশে।
ছবি ও তথ্য সূত্র : মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর, উইকিপিডিয়া, ইন্টারনেট, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বিভিন্ন গবেষনাপত্র।
এই নিবন্ধটি ইংরেজিতে পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
সংক্ষিপ্ত জীবনী
নাম : মুন্সি আব্দুর রউফ ।
জন্ম : ১ মে, ১৯৪৯ ইং ৷
জন্মস্থান : ফরিদপুর জেলার মধুখালী থানার সালামতপুর গ্রামে ৷
পিতা : মুন্সি মেহেদী হোসেন ৷
মা : মোছাঃ মুকিদুন্নেছা ৷
কর্মস্থল : ই পি আর ( ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস)৷
যোগদান : ৮ মে ১৯৬৩ সাল৷
পদবী : ল্যান্স নায়েক ৷
মুক্তিযুদ্ধে অংশরত সেক্টর : ১ নং সেক্টর ৷
মৃত্যু : ১৮ এপ্রিল, ১৯৭১ সাল ৷
সমাধি স্থল : রাঙামাটি শহরের রিজার্ভ বাজারে কেন্দ্রিয় শহীদ মিনারের পাশে।
ছবি ও তথ্য সূত্র : মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর, উইকিপিডিয়া, ইন্টারনেট, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বিভিন্ন গবেষনাপত্র।
এই নিবন্ধটি ইংরেজিতে পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
উনি ৮ই এপ্রিল শহীদ হয়েছিলেন ১৮ এপ্রিল নয়।
ReplyDelete