– শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী ও ঘাতক দল জামায়াতে ইসলামীর প্রাক্তন আমির গোলাম আযম (আত্মজীবনী জীবনে যা দেখলাম ৩য় খন্ড, পৃ: ১২৬-১২৭)
এক.
ক্রিকেটের সঙ্গে রাজনীতির কোনো যোগ নেই এই মিথ্যাচার যারা করেন, তারা হয় অজ্ঞতার কারণে করেন কিংবা জ্ঞানপাপে। ক্রিকেটের ইতিহাস পড়লে তাদের জানা থাকার কথা বর্ণবাদী নীতির (শুধু শ্বেতাঙ্গরাই খেলবে, শুধু শ্বেতাঙ্গদের বিপেক্ষেই খেলবে) কারণে ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত টেস্ট ক্রিকেট খেলতে পারেনি দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়ানডেও। নিষেধাজ্ঞা ওঠার আগ পর্যন্ত তাদের প্রথম অধিনায়ক কেপলার ওয়েসেলস অস্ট্রেলিয়ার হয়ে টেস্ট ক্রিকেট খেলেছেন। রবিন স্মিথ-অ্যালান ল্যাম্ব যেমন ইংল্যান্ডে। শুধু ক্রিকেট নয়, একই কারণে তারা ‘৯২র আগপর্যন্ত তিন যুগ নিষিদ্ধ ছিলো অলিম্পিকে। ফুটবলেও। একটি দেশের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে আন্তর্জাতিকভাবে বর্জন করার এই নীতি তাহলে কোন নীতি? পাকিস্তান ভারতে দীর্ঘদিন ক্রিকেট খেলেনি এবং ইদানিং খেলছে না কোন নীতিতে? স্পন্সর কম পাবে বলে বাংলাদেশকে খেলতে না ডাকা ভারতের ব্যবসায়িক নীতিতে নিশ্চয়ই নয়, সিদ্ধান্তটা রাজনৈতিক। ক্রিকেট রাজনীতি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনাবলীর সঙ্গেও তেমনি জড়িয়ে রয়েছে ক্রিকেট।
|
|
২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ সালে ঢাকায় শুরু হয়েছিলো পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড একাদশ ও আন্তর্জাতিক একাদশের মধ্যে চারদিনের একটি ম্যাচ। রেকর্ড বইয়ে এই ধরণের ম্যাচগুলো প্রথম শ্রেনীর ম্যাচ হিসেবে নথিবদ্ধ হয়। আন্তর্জাতিক সেই ম্যাচে ওপেনার হিসেবে সুযোগ পেয়েছিলেন পাকিস্তানের হয়ে খেলা একমাত্র বাঙালী ক্রিকেটার রকিবুল হাসান। টেস্ট ক্রিকেট তাকে হাতছানি দিচ্ছিলো অনেক দিন ধরেই এবং সব ঠিকঠাক থাকলে জাতীয় দলের প্রথম একাদশে সুযোপ পাওয়াটা ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। হয়তো আসন্ন ইংল্যান্ড সফরেই জুটে যেত সেটা। দু বছর আগে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টেও টুয়েলভথ ম্যান হিসেবে দলে ছিলেন তিনি। (আমি নিশ্চিত না টুয়েলভথ ম্যানের টেস্ট ক্যাপ তখন জুটতো কিনা)।
প্রথম ইনিংসে মাত্র এক রান করে এলবিডব্লু হয়ে সাজঘরে ফেরা রকিবুলের কৃতিত্ব হয়তো পারফরম্যান্সে অনুদিত হয়নি সে ম্যাচে। পরের ইনিংসেও করেছেন এক রান, অবশ্য পাকিস্তানী লিজেন্ড মোশতাক মোহাম্মদ প্রথম ইনিংসে করেছিলেন শূন্য রান। কিন্তু নিজেকে আলাদাভাবে চিনিয়েছিলেন রকিবুল অন্যভাবে। গানস অ্যান্ড মুর ব্যাটে জয় বাংলা লেখা ও স্বাধীন বাংলার মানচিত্র আঁকা স্টিকার নিয়ে খেলতে নেমেছিলেন আঠারোর ওই দীপ্ত তরুণ। বন্ধু শেখ কামালের (বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে) মাধ্যমে গাড়ীর স্টিকার জোগাড় করে সেটাই লাগিয়েছিলেন ব্যাটে। এর মূল্যও দিতে হয়েছে তাকে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হুলিয়া মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন। অস্ত্র হাতে নেননি, বদলে সংগঠিত করেছেন ক্রিকেটারদের।
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অনুদান ও মুক্তিযুদ্ধের জন্য স্বীকৃতির পাশাপাশি দেশের ক্রিকেটকে তুলে ধরতে গঠন করেছিলেন স্বাধীন বাংলা ক্রিকেট দল। কিন্তু ক্রিকেট মৌসুম আসার আগেই দেশ স্বাধীন হয়ে যায়, প্রদর্শনী ম্যাচে নামা হয়নি আর। রকিবুল চাইলেই জয় বাংলার বদলে তলোয়ার মার্কা স্টিকার নিয়েই খেলতে পারতেন। চরম আনুগত্য দেখিয়ে সুযোগ পেতে পারতেন পাকিস্তান টেস্ট দলে। কিন্তু স্বাধীন দেশের জন্য, স্বাধীন মানচিত্রের জন্য তিনি আজন্ম লালিত সাধকে কোরবানি দিতে দু’বার ভাবেননি। তার এই আত্মত্যাগকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কীভাবে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনি তোলো প্রিয় প্রজন্ম?
রকিবুলের খেলা সেই ম্যাচ চতুর্থ দিনে গড়ালো যেদিন, ক্যালেন্ডারে ১ মার্চ। সেদিন দুপুরে রেডিওতে ভেসে এলো ইয়াহিয়ার ঘোষণা: ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। মুহূর্তে গোটা স্টেডিয়াম প্রকম্পিত হলো জয় বাংলা শ্লোগানে। হাতে থাকা পত্রিকা দিয়ে আগুন জ্বালানো হলো গ্যালারিতে। পুড়লো পাকিস্তানের পতাকা। ম্যাচ পরিত্যক্ত। মাঠে থাকা সামরিক-আধাসামরিক বাহিনীর বন্দুকগুলো তাক হলো বিদ্রোহের শ্লোগান ধরা বাঙালীদের দিকে। ঠেকানো গেল না। অগ্নিঝরা মার্চের প্রথম প্রতিবাদ এবং অনিবার্য যুদ্ধের চূড়ান্ত গতি নির্ধারণ করে দেওয়া আন্দোলনের প্রথম স্রোতটা জন্ম নিল ওই ঢাকা স্টেডিয়াম থেকে। একটা ক্রিকেট ম্যাচ থেকে। চাইলেই তো ইতিহাসকে মুছে ফেলা যাবে না।
দুই.
শহীদ আবদুল হালিম চৌধুরী বীর বিক্রম তার বন্ধু রকিবুল হাসানের মতো ভাগ্যবান নন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ক্রিকেটে খেলার সৌভাগ্য তার হয়নি। তবে জাতীয় পর্যায়ে নজর কাড়ছিলেন। ডাক নাম জুয়েল। মোহামেডান স্পোর্টিং ও আজাদ বয়েজ ক্লাবের হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলেছেন। উইকেটকিপার এবং মারকুটে ব্যাটসম্যান হিসেবে তুমুল খ্যাতিমান। স্লগ সুইপ স্পেশালিস্ট। প্রাদেশিক ক্রিকেটে নাম করেছেন। কায়েদে আযম ট্রফিতে রকিবুল-জুয়েল রুমমেট বরাবর। দুজনেই পূর্ব পাকিস্তান দলের ওপেনার। মার্চের আগুন জুয়েলকেও দ্রোহী করেছিলো। ঘর ছাড়তে পারছিলেন না মায়ের তীব্র স্নেহের নিগড়ে। সেটা ছিড়লেন ৩১ মে। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে যাওয়ার ক’দিন আগে মাকে নিজের বাধাই করা একটা ছবি দিয়ে বলেছিলেন. ‘আমি যখন থাকবো না, এই ছবিতেই আমাকে পাবে’।
|
|
মেলাঘরে খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বাধীন দুই নম্বর সেক্টরে ট্রেনিং নেন জুয়েল। ফেরেন ঢাকা কাঁপিয়ে ফেলা গেরিলা দল ‘ক্র্যাক প্লাটুন’-এর একজন হিসেবে। সহযোদ্ধা হাবিবুল আলম বীরপ্রতীকের স্মৃতিচারণে জুয়েল চিত্রিত হয়েছেন প্রচণ্ড বুদ্ধিদীপ্ত, সাহসী এবং ঠান্ডা মাথার একজন যোদ্ধা হিসেবে যিনি ক্রিকেট ব্যাটের মতোই সাবলীলভাবেই অস্ত্র চালাতে পারতেন। ঢাকায় বেশ ক’টি অপারেশনে অংশ নিয়েছেন জুয়েল। সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে বোমা হামলা চালাতে গিয়ে আহত হন তিনি, বাঁহাতের তিনটি আঙুল জখম হয় তার। সহযোদ্ধা কাজী কামালুদ্দিন তাকে নিয়ে যান ঢাকা মেডিকেল কলেজের পঞ্চম বর্ষের ছাত্র আবু এস সালাম কুটুর বাসায়। সেখান থেকে কুটু তাকে নিয়ে যান ঢাকা মেডিকেলে, নিউরোসার্জারির অধ্যাপক রশীদ উদ্দিন আহমেদ জুয়েলের হাতের চিকিৎসা করেন এবং ব্যান্ডেজ বেধে দেন। পরে ডাঃ আজিজুর রহমানও জুয়েলের আঙুলের চিকিৎসা দেন।
২৯ আগস্ট আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে ধরা পড়েন জুয়েল। বড় মগবাজারে আজাদের (আনিসুল হকের মা উপন্যাসখ্যাত) বাসায় সে রাতে ছিলেন তিনি। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেখানে হানা দিয়ে জুয়েল, আজাদ, কাজী কামাল ও আজাদের দুই ছোটভাইকে ঘুম ভাঙিয়ে ডেকে তুলে এবং উঠানে লাইন করে দাড়া করায়। জুয়েলের ব্যান্ডেজ বাধা হাত দেখে সেই ভাঙা আঙুলে চাপ দিয়ে ধরা হয় তার কাছ থেকে কথা বের করতে। জান্তব চিৎকারে ভেঙে পড়েন জুয়েল, কাজী কামাল ওই সময়টায় পালিয়ে যান। বাকিদের হাতকড়া পড়িয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। আজাদের ভাইদের পরে অবশ্য ছেড়ে দেওয়া হয় বয়স খুব কম বলে। সে রাতে পাকিস্তানীদের হাতে আরও ধরা পড়েছিলেন রুমি, বদি, আলতাফ মাহমুদসহ অনেকে। হাবিবুল আলম জানিয়েছেন অক্টোবরের শেষার্ধে কিংবা নভেম্বরের শুরুতে এদের সবাইকে হত্যা করা হয় বলে জানতে পারেন মুক্তিযোদ্ধারা।
যে মানুষটা জুয়েলের হাতের ক্রিকেট ব্যাটকে স্টেনগান বানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি মুশতাক আহমেদ। শহীদ মুশতাক আহমেদ। ক্রীড়া সংগঠক মুশতাক ছিলেন আজাদ বয়েজ ক্লাবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। দিন রাত তাকে পাওয়া যেত ক্লাবেই। ২৫ মার্চ গণহত্যার রাতে নির্মমতার শিকার হন মুশতাকও। ২৭ মার্চ বন্ধু সৈয়দ আশরাফুল হককে (ক্রিকেট কর্মকর্তা) নিয়ে মুশতাকের উপুড় হয়ে পড়ে থাকা লাশ দেখে আসেন জুয়েল। প্রিয় মুশতাক ভাইয়ের শরীর ভেদ করা বুলেটগুলো ফিরিয়ে দেওয়ার শপথটা নেন তখনই। প্রতি বছর বিজয় দিবসে শহীদ জুয়েল-মুশতাক প্রীতি ক্রিকেট হয়। দুজনের নামে দুটো স্ট্যান্ড রয়েছে মিরপুর শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। সেই স্ট্যান্ডের নিচে পাকিস্তানী পতাকা যখন দোলে, তাদের আত্মা কষ্ট পায়। ভাঙা তিন আঙুল মোচড়ের চেয়ে তীব্র আর্তচিৎকার দেয় জুয়েলের আত্মা। কষ্ট পান এস এ মান্নান ওরফে লাডু ভাইয়ের আত্মা। স্টেডিয়ামের প্রিয় মুখ, খেলোয়াড় এবং ক্রীড়া সাংবাদিক। ডেইলি অবজারভার পত্রিকার স্পোর্টস এডিটর ছিলেন তিনি। তার লাশ রায়েরবাজারে পড়েছিলো শহীদ বুদ্ধিজীবিদের সঙ্গে। জামায়াতে ইসলামীর ঘাতক আল-বদরদের নৃশংস নির্মম হত্যা তালিকায় ছিলো ক্রীড়াঙ্গনও। তাদের লাশের উপরও দাড়িয়ে বাংলাদেশ।
তিন.
১৯৮০ সালের কথা, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বদান্যতায় পাকিস্তানের নাগরিকরা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে, তাদের একজন গোলাম আযম। সেবছরই ঢাকায় প্রথমবারের মতো খেলতে এসেছে পাকিস্তান। স্বনামে নয় অবশ্য, দলের নাম ওমর কোরেশী একাদশ, খেলোয়াড়দের সবাই টেস্ট প্লেয়ার। জাতীয় দলে আছেন প্রায় সবাই। অধিনায়ক ইমরান খান। পিআইএর বিমানটা থামতেই টারমাকে ভিড় করে থাকা তরুণীদের মাঝে চাঞ্চল্য আর উল্লাস, শেষ বারের মতো ছোট আয়নায় মুখ দেখছে অনেকে। দরজা খুলতে দেখা দিলেন স্বপ্নের পুরুষ। হাসিটা কি একটু শ্লেষাত্মক! সিড়ি বেয়ে নামতে নামতে তরুণীদের উদ্দেশ্যে দুহাত জোড় করে ইমরান উচ্চারণ করেছিলেন ‘নমস্তে’। শরীর ভেজা শিহরণে সেই সম্বোধন উপেক্ষা করেছিলো তরুণীরা, কিন্তু পিক করেছিলো প্রেস। ইমরান ও পাকিস্তানকে গালি শুনতে হয়েছিলো কিছু তেজী বাঙালী যুবকের। বাংলাদেশের মাটিতে ইমরান খানের ওই একমাত্র খেলা। পরের বছর এশিয়া কাপ বাংলাদেশে আয়োজিত হয়েছিলো। কিন্তু সেবার পাকিস্তানকে ভাগাভাগি করে নেতৃত্ব দিয়েছেন জাভেদ মিয়াদাদ আর আবদুল কাদির। ইমরান আসেননি।
সেই ইমরান ২১ বছর পর
পাকিস্তানী টিভিতে স্মৃতিচারণ করেন সেই ম্যাচের (এবং ভারতের বিপক্ষে চ্যারিটি ম্যাচ বলে ভুল উল্লেখ করেন)। পাকিস্তানের বিজয়ে জনগনের উল্লাসে নাকি তার মন আদ্র হয়েছে। তখন তার মনে হয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভুল করেছে। নিজেদের ভাইদের বুকে তারা গুলি চালিয়েছে। এজন্য পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া উচিত। এবং এখানে বাড়তি কিছু কথাও আছে। একাত্তরে তিনি সেনাবাহিনীকে ডিফেন্ড করেছেন, লোকজনকে বলেছেন সব ঝুট হ্যায়। কিন্তু দু বছর পর এক বাঙালী বন্ধুর কাছে শুনে নাকি তার মত বদলায়। এবং আমরা সেই সাক্ষাতকারে সাবেক অধিনায়ক ইমরান খানের বদলে তেহরিক-ই-ইনসাফ নামে একটি রাজনৈতিক দলের প্রধানকেই দেখতে পাই, যার লক্ষ্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হওয়া। এবং পাকিস্তানের সঙ্গে রিকনসিলিয়েশন ওয়ালারা (দৈনিক প্রথম আলোর নেতৃত্বে) তার এইসব কথাবার্তা ব্যাপক উদ্দীপনা সহকারে তুলে ধরে।
ব্রিটিশ ম্যাগাজিন ক্যারাভানের জানুয়ারী ২০১২ সংখ্যায় এক সাক্ষাতকারের অংশবিশেষ নিয়ে এদের ব্যাপক উল্লাস লক্ষ্য করা যায়। বাস্তবতা হচ্ছে প্রতিপক্ষের কাছে ‘তালিবান কিং’ উপাধি পাওয়া ইমরান রাজনৈতিক স্বার্থেই তালিবানদের ডিফেন্ড করেন সেই সাক্ষাতকারে। এবং তুলনা করেন বাংলাদেশের মুক্তিযু্দ্ধের গণহত্যার সঙ্গে। তিনি একবারও বলেন না আমাদের মতোই স্বাধিকারের জন্য দীর্ঘদিন লড়ে যাওয়া বেলুচিস্তানের কথা, বেলুচদের কথা। বলেন তালিবানদের কথা, পশতুনদের কথা। যাদের বিরুদ্ধে নাকি পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের মতোই নির্মম। এবং সেই প্রসঙ্গেই বলেন, ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা থেকে শেষ ফ্লাইটে তিনি যাত্রী ছিলেন। ঢাকায় থাকতে শুনেছেন বাঙালী হত্যার পরিকল্পনা, তাদের কিভাবে মারতে হবে যেমন এখন বলা হয় আফগান পশতুনদের ক্ষেত্রে। ইমরান নিজেও পশতুন। তার পুরো নাম ইমরান খান নিয়াজী।
১৯৭১ সালের মার্চে ইমরানের খানের ঢাকা সফর খেলার উদ্দেশ্যে ছিলো না। ঢাকার ম্যাচে ইমরান দলে ছিলেন না।
রকিবুল হাসানের কাছ থেকে আমরা জানতে পারি ১ মার্চ স্টেডিয়াম থেকে পাকিস্তান দলকে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। এবং তারা ঢাকা ছাড়ে ৪ মার্চ। যাওয়ার আগে জহির আব্বাস রকিবুলকে বলেন আবার শিগগিরই দেখা হবে আমাদের, রকিবুলের জবাব ছিলো - হয়তো দেখা হবে, তবে আমার হয়তো পাসপোর্ট ভিন্ন থাকবে, ভিন্ন দেশের, ভিন্ন নামের। সেই মার্চে ঢাকায় আরেকজন ক্রিকেটার অতিথি ছিলেন। আবদুল হাফিজ কারদার। পাকিস্তানের সর্বকালের সেরা অধিনায়কদের একজন। ইয়াহিয়া খানের সফরসঙ্গী ছিলেন তিনি। ২৫ মার্চে ঢাকা ছেড়ে যাওয়া সেই ফ্লাইটে ছিলেন তারাও। তার আগে গণহত্যার ব্লুপ্রিন্ট ‘অপারেশন সার্চলাইট’কে থাম্বস আপ দিয়ে গেছেন ইয়াহিয়া ক্ষমতায় তার দ্বিতীয় বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যে। এবং ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পনের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে গণহত্যা চালানোর জন্য দায়ী লোকটিও একজন পশতুন, ইমরানের মতোই পাঞ্জাবের মিয়াওয়ালি থেকে আসা লে. জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী।
চার.
ঢাকার ম্যাচে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড একাদশের দলে ইমরান খান ছিলেন না। তবে রকিবুল হাসানের মতো তাকেও জাতীয় দল হাতছানি দিচ্ছিলো। সেই ডাক তিনি পেলেন ইংল্যান্ড সফরে। সে দেশের সিমিং কন্ডিশনে তার মতো মিডিয়াম পেস সিমারের বেশ কদর। ইমরান খানের অভিষেক হলো বার্মিংহাম টেস্টে। এর আগে প্র্যাকটিসের সময়ও তার দেখা হয়েছে বাইরে বাঙালীদের মিছিল। দেখেছেন মে ফেয়ার হোটেলের সামনে। বস্তুত ইংল্যান্ডের মাটিতে পা দেয়ার পর থেকেই বাঙালীদের বিক্ষোভের মুখে পড়েছিলো পাকিস্তানী ক্রিকেটাররা। দাবি সত্য হলে তখন নিশ্চয়ই সবাইকে পূর্ব পাকিস্তানে কিচ্ছু ঘটেনি বলে বোঝাচ্ছেন ইমরান, সেনাবাহিনীর পক্ষ নিয়ে গলা ফাটাচ্ছেন!
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সবচেয়ে বড় ঘটনাগুলো ঘটিয়েছেন ইংল্যান্ড প্রবাসী বাঙালীরা। ফ্রান্সে গিয়ে দাতা দেশগুলোর উপর চাপ সৃষ্টি করে পাকিস্তানকে আর্থিক সাহায্য দেওয়া বন্ধ করেছিলেন তারা। আর বাংলাদেশের পক্ষে তাদের যাবতীয় আন্দোলনের শুরুটা হয়েছিলো ২৮ মার্চ, স্মলহিথ থেকে। সেদিনের সেই সভা ছিলো শপথ সভা, প্রিয় জন্মভূমিকে শত্রুমুক্ত করার জন্য যার যা সাধ্য আছে তাই নিয়ে পাশে দাড়ানোর শপথ। বেগম বদরুন্নেসা পাশা তাদের একজন। বিয়েতে পাওয়া যাবতীয় স্বর্ণালংকার তিনি খুলে দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সাহায্যে দাতব্য তহবিলে। সেই সভাতেই হামলা করেছিলো পাকিস্তানীরা। ১৫-১৬ জন বাঙালী ছুরিকাহত হন তাদের হাতে। লোকজন যখন ভয়ে পালাচ্ছে তখন জ্বালাময়ী এক বক্তৃতা দিয়েছিলেন বদরুন্নেসা, ‘ভাইয়েরা আপনাদের ভাই বোনদের কথা ভাবুন, আপনাদের মায়ের কথা ভাবুন। ভাবুন একবার তারা কি অবস্থায় আছে। আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয়েছে মাত্র, আমাদের পালানোর উপায় নেই, সময় হয়েছে ঘুরে দাড়িয়ে লড়ার, যুদ্ধ করার।’ সবাই ফিরে এসেছিলেন।
২৭ এপ্রিল পাকিস্তান ক্রিকেট দল ইংল্যান্ডে পা রাখার পর থেকেই শুরু হয় বাঙালীদের বিক্ষোভ। ৫ মে মে ফেয়ার হোটেলে পাকিস্তান দলের সম্বর্ধনামূলক এক ডিনারে তারা ঢোকার সময় বাঙালীরা ব্যানার প্ল্যাকার্ড নিয়ে তুমুল বিক্ষোভ জানায়। ঘটনাস্থল থেকে গ্রেফতার করা হয় ২২ জন বাঙালীকে। বার্মিংহাম টেস্টের আগে পাকিস্তান দলের প্র্যাকটিসের বাইরে নিয়মিতই মিছিল করেছেন বাঙালীরা। সবচেয়ে বড় বিক্ষোভটি হয়েছিলো টেস্ট ম্যাচ শুরুর দিন। চার পাচটি বাস ভর্তি হয়ে বাঙালীরা মাঠের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ করেছেন,
উড়িয়েছেন স্বাধীন বাংলার পতাকা। পোড়ানো হয়েছে পাকিস্তানের পতাকা। সেই ম্যাচের দিন পাকিস্তানীদের সঙ্গে তাদের তুমুল বিতন্ডা হয়েছে, যদিও সেদিন কোনো হামলা হয়নি।
একই সিরিজে একটি ব্যাটে স্বাক্ষর করেছিলো পাকিস্তান ও ইংলিশ ক্রিকেট দল। লর্ডসে ওই ব্যাটটি নিলামে তোলা হয়েছিলো পাকিস্তানী শরণার্থীদের সাহায্যে। সেই টাকা ইয়াহিয়া সরকারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিলো। সে টাকার ব্যবহার কিসে হয়েছিলো তা জানা যায়নি।
অনেক বছর পর বার্মিংহামে সবুজশাড়ি লাল ব্লাউজ পড়ে খেলা দেখতে গিয়েছিলেন মিসেস বদরুন নেসা পাশা। গিয়েছিলেন বাংলাদেশ দলকে সমর্থন দিতে। নিজেদের দেশ টেস্ট ম্যাচ খেলছে এই গর্বে উদ্বেল ছিলেন তিনি। আর আমাদের তরুণরা কোনো টুর্নামেন্টে নিজের দেশ শুরুতেই বাদ পড়লে পাকিস্তানের মাঝে নিজেদের খুজি। আফসোস, একবারও ভাবি না সেইসব মানুষের আত্মত্যাগের কথা!
পাঁচ.
ছবিটা পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত ২০০৯ সালের টুর্নামেন্টের। টুর্নামেন্টের নাম আলবদর টুর্নামেন্ট। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ড পরিচালিত করেছিলো যে নৃশংস খুনী গোষ্ঠী, তাদের নাম আল বদর। গঠন করা হয়েছিলো আইজেটির পূর্ব পাকিস্তান উইং ইসলামী ছাত্র সংঘের (বর্তমানে ইসলামী ছাত্র শিবির) সদস্যদের নিয়ে। যার প্রধান ছিলেন বর্তমান জামাতের আমির ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে গ্রেফতার মতিউর রহমান নিজামী। পূর্ব পাকিস্তান প্রধান ছিলেন আলী আহসান মুজাহিদ। কামারুজ্জামান ছিলেন আল বদরের প্রধান সংগঠক। মুক্তিযুদ্ধে নিহত সেই আলবদরের স্মৃতিতে এই টুর্নামেন্ট আয়োজন করে আইজেটি।
এই ভিডিওটি টুর্নামেন্টের সমাপনী বক্তৃতার। সেখানে লেখা: Nazim e Ala Islami Jamiat Talaba Pakistan, Br. Ateeq ur Rehman Khan Speaks in IJT Punjab Medical College’s Albadar Floodlight Sports Festival 2009. Dedicated to the martyrs of Albadr East Pakistan.
আমাদের যেসব তরুণরা স্রেফ মুসলমান বলে পাকিস্তান সমর্থন করো, তাদের আরেকবার ভাবতে বলি। খুব কৌশলে তোমাদের মধ্যে তাদের জন্য প্রীতির জন্ম দেওয়া হচ্ছে নানা ছুতোয়, নানা অজুহাতে, নানা মধুমাখা কথায়, নানা প্রচারণায়। ৩০ লাখ শহীদ, ২ লাখ বীরাঙ্গনা, এক কোটি উদ্বাস্তু যাদের কীর্তি, সেই পাকিস্তানীদের প্রতি ভালোবাসা জন্মাতে নিত্য পরিশ্রম করছে তাদের এদেশীয় দোসররা। যারা পাকিস্তানকে ভাই মনে করে, এদেশকে মনে করে পূর্ব পাকিস্তান।
ফেসবুকে আছেন তারা তো নিয়মিতই দেখছেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কিরকম বিতর্কিত স্ট্যাটাস ও ছবি শেয়ার করে এই পাকিস্তানপন্থী জারজরা। বাস্তবতা আরো নির্মম আরো নিষ্ঠুর, তার প্রমাণ এই ছবিটা। গত বছর বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে একটি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজন করে ইসলামী ছাত্র শিবির। দেখতেই পাচ্ছেন সেই টুর্নামেন্টের বিজয়ী কারা! পাকিস্তানের জার্সি পড়িয়ে জেতানো এই অবুঝ কিশোরদের বিপরীতে কারা খেলেছিলো? কোন দল? একটু মাথা খাটালেই উত্তরটা পেয়ে যাবেন।
শেষ কথা:
৩০ লাখ শহীদের অভিশাপ নিও না ভাই ও বোনেরা, লাখো বীরাঙ্গনার লুটানো সম্ভ্রমের কথা একবার ভেবো- নিজের মা কিংবা বোনকে তাদের জায়গায় বসিও পারলে। এবং ওদের পাতা ফাদে পা দিও না। স্রেফ নিজেদের যুদ্ধাপরাধের পাপ ঢাকতেই তারা তোমাদের বিভ্রান্ত করছে। পাকিস্তানীদের সুনাম করছে। ওদের মেনে নিতে বলছে। এই গল্পে সেই গল্পে। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন, বাঙালীর শ্রেষ্ঠ অর্জন। আর তা এসেছিলো এই নিষ্ঠুর, নির্মম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধেই, যারা মুসলমান হওয়ার পরও আমাদের রেহাই দেয়নি। আজ কিসের ভাই? কার রক্ত মাড়িয়ে? কার ছিন্ন শাড়ি পায়ে ঠেলে পাকিস্তানকে ভালোবাসবে। নিজেকে বাঙালী ভাবো, দেশটাকে ভালোবাসো। ৪১ বছর কি খুব দীর্ঘ সময় সব অপমান ভুলে যাওয়ার? সব রক্ত, অসম্মাণ, লুন্ঠণ ভুলে যাওয়ার? জাতীয় পতাকার কথা ভাবো, ওই লালটা শহীদের রক্ত, ওই সবুজটা বীরাঙ্গনাদের শাড়ি। এবার সিদ্ধান্ত নাও, স্রেফ ধর্ম পরিচয়ে একাত্তরকে অস্বীকার করবে কিনা! শহীদ, বীরাঙ্গনা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগকে অস্বীকার করবে কিনা! যদি করো, তোমার কোনো যোগ্যতা নেই এই দেশকে ধারণ করার। তুমি বিশ্বাসঘাতক। তুমি বেঈমান। দেশপ্রেম যদি ঈমানের অঙ্গ হয়, সেই ঈমান তোমার নেই। আরেকবার ভাবো। ভুল হয়, ভুল শোধরানো যায়। এদেশ তোমার-আমার। যারা এর জন্মকে অস্বীকার করেছিলো তাদের নয়, তাদের তাবেদারদের নয়। তুমি কি আমাদের দলে. নাকি ওদের? তোমার রক্ত কার কথা বলে?
কৃতজ্ঞতা: স্বাধীনতা ট্রাস্ট, হাবিবুল আলম বীরপ্রতীক, বিবিসি বাংলা, দৈনিক ইত্তেফাক
ছবি: আফতাব আহমেদ, ইত্তেফাক, প্রথম আলো, জন্মযুদ্ধ
প্রাসঙ্গিক অ্যালবামমূল লেখা-
জন্মযুদ্ধডটকম