১.
যখন বয়স কম ছিল তখন দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর একটা শখ ছিল, এখন আর সেই শখ নেই। পৃথিবীর নানা বিচিত্র দেশ থেকে নিজের সাদামাটা দেশটাকেই বেশি ভালো লাগে। তবে আমি কখনও বিষুব রেখা পার হইনি। তাই দক্ষিণ গোলার্ধের রাতের আকাশের নক্ষত্ররাজি দেখতে কেমন লাগে সেটা নিয়ে একটা সূক্ষ্ম কৌতূহল ছিল।
আকাশের নক্ষত্রদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল একাত্তরে। বিনিদ্র রাতে যখন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম তখন মনে হত সেগুলো বুঝি গভীর মমতা নিয়ে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে আছে। দক্ষিণ গোলার্ধে গিয়ে আকাশের দিকে তাকালে আরও নূতন নক্ষত্রের সঙ্গে পরিচয় হবে; তাছাড়া রাতের আকাশের সবচেয়ে উজ্জল নক্ষত্রটি দক্ষিণ গোলার্ধে একটা ভিন্ন সৌন্দর্য নিয়ে দেখা দেয়, সেটা দেখারও আগ্রহ ছিল।
তাই যখন অস্ট্রেলিয়ার বাংলা সাহিত্য সংসদ আমাকে মেলবোর্নে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, আমি যেতে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। আমি ভীতু ধরনের মানুষ, একা ভ্রমণ করতে সাহস পাই না। তাই যখন আমার স্ত্রী সঙ্গে যেতে রাজি হল তখন শেষ পর্যন্ত প্লেনে চড়ে বসলাম।
মেলবোর্ন পৌঁছানোর পর একটি অত্যন্ত অভিজাত ধরনের বিশেষ ট্রেনিং পাওয়া কুকুর আমাদের সবকিছু শুঁকে যখন অনুমতি দিল যে আমরা অস্ট্রেলিয়ায় পা দিতে পারি তখন আমরা বের হয়ে এলাম। আমাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে মেলবোর্নের বাংলা সাহিত্য সংসদের প্রায় সব সদস্য এয়ারপোর্টে চলে এসেছেন। তারা আমার সঙ্গে এমনভাবে কথা বলতে লাগলেন যেন আমি খুব বড় একজন সাহিত্যিক এবং আমার সন্দেহ হতে শুরু করল যে আমি ভুল জায়গায় চলে এসেছি কি না!
বাংলা সাহিত্য সংসদ বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের একটা সংগঠন। বিদেশের মাটিতে যারা থাকেন দেশের জন্যে তাদের ভিন্ন এক ধরনের মায়া থাকে। যারা কখনও দেশ ছেড়ে যাননি তারা আসলে কখনও দেশের জন্যে এই বিচিত্র মায়াটি অনুভব করতে পারবেন না।
দেশের প্রতি এই মমত্ববোধ থেকে বাংলা সাহিত্য সংসদ মেলবোর্ন শহরে নানা কিছুর আয়োজন করে থাকে; তার একটি হচ্ছে বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলা থেকে সাহিত্যিকদের নিয়ে আসা। তাদের আয়োজনে সুনীল-শীর্ষেন্দু–সমরেশ মজুমদারের মতো সাহিত্যিকেরা এসেছেন এবং সেই একই আয়োজনে আমিও চলে এসেছি। নিজের সাহস দেখে আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম!
দেশে আমাকে নানা অনুষ্ঠানে যেতে হয়, শিক্ষকতা করি, তাই কথা বলাই আমার কাজ। সেজন্যে বক্তৃতা দিতেও আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তাই বলে সাহিত্যিক হিসেবে শত শত মানুষের সামনে জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য নয়। কিন্তু সেটা কাকে বোঝাব!
সাহিত্য-সভাটি শেষ পর্যন্ত ভালোয় ভালোয় শেষ হয়েছিল। শিক্ষক হওয়ার কিছু বিশেষ সুবিধে আছে। সারা পৃথিবীতেই আমার ছাত্রছাত্রী। এখানেও তারা অনেকে আছে, সবাই দলবেঁধে চলে এল। বক্তব্যের শেষে একটা প্রশ্নোত্তর পর্ব ছিল, আয়োজকেরা সেটা নিয়ে একটু দুর্ভাবনায় ছিলেন।
এটি নূতন শুরু হয়েছে। রাজাকার টাইপের মানুষেরা দেশে সুবিধে করতে পারে না বিদেশে সভা-সমিতিতে এসে নাকি যা কিছু করে ফেলতে পারে। আমি আয়োজকদের অভয় দিলাম রাজাকার টাইপের মানুষদের কেমন করে সামলাতে হয় সেটি নিয়ে। কবি রবীন্দ্রনাথ কবিতা পর্যন্ত লিখে গেছেন, “যখনি দাড়াঁবে তুমি সম্মুখে তাহার তখনি সে/পথ কুকুরের মত সংকোচে সত্রাসে যাবি মিশে।”
কিন্তু সে রকম কিছুই হল না। সাহিত্য থেকে দর্শক-শ্রোতার বেশি আগ্রহ ছিল শিক্ষা নিয়ে, দেশ নিয়ে, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে। এগুলো আমারও প্রিয় বিষয়, দেশ নিয়ে সবসময় স্বপ্ন দেখি। সেই স্বপ্নের কথা দশজনকে বলতে আমার কখনও সমস্যা হয় না। (তবে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে যখন একজন দর্শক আমার কাছে জানতে চাইল আমি কেন গোঁফ রাখি, আমি পুরোপুরি হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। আমি কিছু বলার আগেই আমার স্ত্রী যখন হলভরা মানুষকে এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিল তখন আমার মুখ দেখানোর উপায় নেই!)
বাংলা সাহিত্য সংসদের আনুষ্ঠানিক সাহিত্য-সভাটি ছিল মাত্র কয়েক ঘণ্টার। কিন্তু আমরা সংসদের সদস্যদের সঙ্গে ঘরোয়া পরিবেশে নিরবচ্ছিন্নভাবে সময় কাটিয়েছি। প্রতি রাতেই কারও বাসায় সবাই একত্র হয়েছে এবং আমরা বাঙালিরা যে কাজগুলো খুব ভালো পারি– খাওয়া এবং চুটিয়ে আড্ডা দেওয়া– অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সেগুলো করা হয়েছে।
যে মানুষগুলোকে আগে কখনও দেখিনি তাদের থেকে বিদায় নেবার সময় সবার চোখে পানি– এ রকম বিচিত্র ঘটনা বাঙালি ছাড়া অন্য কোনো মানুষের জীবনে ঘটেছে কি না আমার জানা নেই। মাঝে মাঝেই মনে হয়, ভাগ্যিস বাঙালি হয়ে জন্মেছিলাম, তা না হলে কত কিছু যে অজানা থেকে যেত!
২.
মেলবোর্ন শহর পৃথিবীর সবচেয়ে বাসযোগ্য শহর। আমি সেখানে গিয়েছি ঢাকা শহর থেকে। যারা বাসযোগ্য শহরের সার্টিফিকেট দেন তারা ঢাকা শহরকে পৃথিবীর সবচেয়ে বাসের অযোগ্য শহরের সার্টিফিকেট দিয়েছেন।
(আসলে ঢাকা শহর দুই নম্বর। এক নম্বর বাসের অযোগ্য শহর হচ্ছে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কাস। সেখানে বিষাক্ত গ্যাস দিয়ে মানুষ মারা হয়, যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত একটি শহর। এ রকম একটা শহরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা সোজা কথা নয়। আমার ধারণা, যারা বাসের অযোগ্যতার সার্টিফিকেট দেন তারা মে মাসের ৫ তারিখে ঢাকা শহরে হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডব দেখার সুযোগ পেলে প্রথম পুরষ্কারটা নির্ঘাত দামেস্কাসকে না দিয়ে ঢাকা শহরকে দিয়ে দিতেন।)
যে কয়দিন মেলবোর্নে ছিলাম তখন বোঝার চেষ্টা করেছি এই শহরটি কেন সবচেয়ে বাসযোগ্য শহরের পুরস্কার পেয়েছে। বাসযোগ্য শহর হতে হলে মানুষকে বাস করতে হবে। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে মেলবোর্নে পথেঘাটে মানুষই চোখে পড়েনি! পুরো দেশেই মানুষ মাত্র দুই কোটি (এবং এটি শুধু দেশ নয়, মহাদেশও বটে)। তাই চারদিক ফাঁকা। শহরে উচু বিল্ডিং নেই। ছোট ছোট খেলনার মতো বাসা। বাসাগুলো ক্যালেন্ডারের ছবির মতোন। বাসযোগ্য শহরের সার্টিফিকেট ঠিক কী কী কারণে পেয়েছে জানা নেই, তবে বৈচিত্র্যে এই শহরটি অভিনব।
দক্ষিণ গোলার্ধ বলে এখানে সবকিছু উল্টো। আমাদের দেশে গ্রীষ্ম শেষ হয়ে শীত আসছে। সেখানে শীত শেষ হয়ে গ্রীষ্ম আসছে। তবে মনে হল গ্রীষ্ম আসার কোনো তাড়াহুড়া নেই। এখনও প্রচুর শীত। রাতে লেপমুড়ি দিয়ে হিটার জ্বালিয়ে ঘুমাতে হয়। মেলবোর্ন শহরে একই দিনে কখনও প্রচণ্ড গরম। কখনও কনকনে শীত, কখনও বৃষ্টি, আবার কখনও উথালপাথাল হাওয়া। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় মানুষজন নাকি চারটি ভিন্ন ভিন্ন আবহাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়ে বের হয়।
পৃথিবীর সবচেয়ে বাসের অযোগ্য (প্রায়) শহর থেকে সবচেয়ে বাসযোগ্য শহরে পা দেওয়া নিঃসন্দেহে একটা চকমপ্রদ অভিজ্ঞতা। তবে বলে রাখি ঢাকা ফিরে আসার পর যখন প্লেন থেকে নেমেছি আগুনের তাপের মতো দুঃসহ গরমের একটা ঝাপটা অনুভব করেছি। হরতালের মাঝে বাসায় ফিরে এসেছি। এসে দেখি বাসায় পানি নেই। এর মাঝে হঠাৎ করে ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। অন্ধকার মশাদের সে কী আনন্দ! আমাদের ঘিরে তাদের মহোৎসব! কিন্তু মজার ব্যাপার হল, আমার এতটুকু বিরক্তি অনুভব হল না। বরং মনে হল, আহা, ঢাকার মতো এ রকম ভালোবাসার শহর কয়টি আছে পৃথিবীতে?
৩.
আমেরিকা গেলে মানুষ যে রকম নায়েগ্রা ফলস না দেখে ফিরে আসে না, ঠিক সে রকম অস্ট্রেলিয়া গেলে মানুষ ক্যাঙ্গারু না দেখে ফিরে আসে না। যখন অস্ট্রেলিয়া ছিলাম তখন আমাদের ক্যাঙ্গারু দেখার শখ পূরণ করিয়ে দিয়েছিল জিন বিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরী। (আবেদ চৌধুরী আর তার স্ত্রী টিউলিপ আমাদের দীর্ঘদিনের পারিবারিক বন্ধু। আমরা আমেরিকাতে একই ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডির জন্যে কাজ করেছিলাম। অস্ট্রেলিয়া এসে তার সঙ্গে দেখা না করে ফিরে যাওয়া যে কোন হিসেবেই অপরাধ!)
ক্যানবেরা এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় যেতে যেতে দেখলাম পথের দুই পাশে কাঙ্গারু। রাতের অন্ধকারে গাড়ির ধাক্কা খেয়ে মারা পড়েছে। জীবিত না হোক, তবুও তো ক্যাঙ্গারু – আমি এতেই সন্তুষ্ট ছিলাম। কিন্তু আবেদ চৌধুরী আমাদের জীবিত ক্যাঙ্গারু না দেখিয়ে ছাড়বে না।
তাই পরদিন কয়েক ঘণ্টা ড্রাইভ করে আমাদের নিয়ে এক জায়গায় হাজির হল। সেখানে পথের দুই পাশে অসংখ্য ক্যাঙ্গারু। আমাদের দেশের এমপিরা যখন তাদের এলাকায় যান তখন স্কুলের হেডমাস্টাররা যেভাবে ছাত্রছাত্রীদের ধরে এনে রাস্তার দুইপাশে রোদের মাঝে দাঁড় করিয়ে রাখেন, ক্যাঙ্গারুরা ঠিক সেভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। আমরা যে রকম বিস্ময় নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়েছিলাম, মনে হল তারাও সেই একই রকম বিস্ময় নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে!
ক্যাঙ্গারুর চলাফেরা খুব মজার। তাদের মতো লেজে ভর দিয়ে জোড়া পায়ে লাগিয়ে আর কোনো প্রাণি ছুটতে পারে না। তার থেকেও মজার হচ্ছে ক্যাঙ্গারু মায়ের পেটের থলেতে ক্যাঙ্গারুর বাচ্চার বসে থাকা। বাচ্চাগুলোকে দেখে মনে হয় পৃথিবীতে বুঝি এর থেকে আরামের কোনো জায়গা নেই।
ক্যানবেরা অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী। সবগুলো দেশের অ্যাম্বেসি কিংবা হাইকমিশন এখানে। এগুলোর পাশে দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ চোখে পড়ল রাস্তার পাশে অপূর্ব একটি বিল্ডিং। চাঁদ-তারা আঁকা লাল পতাকা দেখে বুঝতে পারলাম এটা তুরস্কের হাইকমিশন। টিউলিপ আমাদের বলল, এই জমিটুকু বাংলাদেশকে দেওয়া হয়েছিল এবং শেখ হাসিনা এখানে বাংলাদেশ হাইকমিশন তৈরি করার জন্যে ভিত্তিপ্রস্তরও বসিয়ে গিয়েছিলেন।
পরের বার বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের আমলে বসানো ভিত্তিপ্রস্তরে যেন বিল্ডিং তোলার অপমান সহ্য করতে না হয় সে জন্যে জমিটুকু হাতছাড়া হতে দিয়েছে।
তথ্যটি বিচিত্র হলেও অবিশ্বাস্য নয়। দেশের তথ্য পাচার হয়ে বাইরে যেন চলে না যেতে পারে সেজন্যে এই সরকার একবার বিনি পয়সায় সাবমেরিন ক্যাবলে যুক্ত হওয়ার সুযোগটি হাতছাড়া করে পুরো দেশের মানুষকে ইন্টারনেট থেকে বঞ্চিত করেছিল।
ক্যানবেরার অসংখ্য অ্যাম্বেসি এবং হাইকমিশনের মাঝে সবচেয়ে চমকপ্রদ অ্যাম্বেসিটি একটা তাঁবুর মাঝে। তাদের পুরানো পার্লামেন্ট ভবনের সামনে সেই দেশের আদিবাসীরা তাদের নিজেদের অধিকার আদায় করার জন্যে বিশাল একটা পতাকা উড়িয়ে তাঁবুর মাঝে নিজেদের অ্যাম্বেসি বসিয়ে রেখেছে। সরকার তাদের ঘাটায়নি, বছরের পর বছর সেভাইে রয়ে গেছে।
আমি তাদেরকে দেখে আমার নিজের দেশের আদিবাসীর কথা স্মরণ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। সেনাবাহিনী যেন জাতিসংঘের লোভনীয় চাকুরী নিরবচ্ছিন্নভাবে উপভোগ করতে পারে সেজন্যে এই দেশের আওয়ামী লীগ সরকার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে এই দেশে আদিবাসী বলে কিছু নেই। এর চাইতে মমত্বহীন কিছু হতে পারে বলে আমার জানা নেই।
অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরাও মমত্বহীনতার স্বাদ অনেকদিন থেকে পেয়ে এসেছে। সাদা চামড়ার মানুষেরা প্রথম যখন এই দেশ দখল করেছে তখন তারা ফুর্তি করার জন্যে মানুষ যেভাবে পাখি শিকারে যায় তারা সেভাবে আদিবাসী শিকারে যেত। কেউ কোনো আদিবাসীর মাথা কেটে আনতে পারলে তাকে পুরষ্কার দেওয়া হত। মাত্র কিছুদিন আগেও আদিবাসী মায়ের বুক খালি করে আদিবাসী সন্তানদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
অতীতের এই নিষ্ঠুরতার জন্যে অস্ট্রেলিয়ার জনগণ আনুষ্ঠানিকভাবে পার্লামেন্টে আদিবাসীদের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়েছে। কিন্তু এতদিনে যা হবার তা হয়ে গেছে। অস্ট্রেলিয়ার এই বিশাল ভূখণ্ডে সত্যিকার আদিবাসীদের কোনো চিহ্ন বলতে গেলে নেই। সারা পৃথিবীতে এ রকম নিষ্ঠুরতার উদাহরণ এত বেশি যে মনে হয় এটাই বুঝি নিয়ম। সবকিছু কেড়ে নিয়ে কোনো এক সময়ে ক্ষমা চেয়ে নিজেদের পিঠে নিজেরাই নৈতিকতার একটা সিল মেরে দেওয়া।
আমাদের অনেক ছাত্রছাত্রী অস্ট্রেলিয়া থাকে। আমরা মেলবোর্ন এসেছি শুনে অনেকেই দেখা করতে এসেছে। এক সময়ে তারা কমবয়সী ছাত্র কিংবা ছাত্রী ছিল। এখন তারা বড় হয়েছে, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, স্বামী আছে, স্ত্রী আছে, ফুটফুটে ছেলেমেয়ে আছে দেখে বড় ভালো লাগে। শুধুমাত্র আমাদের সঙ্গে দেখা করার জন্যে কেউ শত শত কিলোমিটার দূর থেকে ড্রাইভ করে এসেছে, কেউ কেউ প্লেনে উড়ে এসেছে।
তাদের নিয়ে হাজারো রকমের স্মৃতিচারণ করতে করতে রাত পার হয়ে যাবার অবস্থা! বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ঘটনাগুলোর অনেক কিছুই ছিল মোটামুটি ভয়ংকর। এখন হঠাৎ করে সেগুলোকেই মনে হয় মজার। শুনে সবাই হেসে গড়াগড়ি খায় সে রকম অবস্থা।
আমরা যখন গিয়েছি তখন সবেমাত্র ইলেকশন শেষ হয়েছে। সেই দেশে সবাইকে ভোট দিতে হয়। ভোট না দিলে সত্তর ডলার জরিমানা। একজন বলল, ইলেকশনের খবর পেয়ে তার মা খুব ব্যস্ত হয়ে দেশ থেকে তাকে ফোন করে বলেছেন, বাবা ইলেকশনের দিন খবরদার ঘর থেকে বের হবি না, কখন কোথায় কী বিপদ হয়!
শুনে আমরা সবাই হেসেছি। কিন্তু তার মাঝেও বুকের মাঝে কোথায় যেন একটা ব্যথার ঝোলা অনুভব করেছি। আমাদের দেশেও ইলেকশন আসছে, কিন্তু সেটা নিয়ে আমাদের সবার মাঝে কী ভয়ানক একটা অনিশ্চয়তা, কী হয় সেটা ভেবে কী একটা অসহায় আতংক!
খুব অল্প সময়ের জন্যে অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিলাম। তাই আমরা আমাদের ছাত্রছাত্রীদের খুব বেশি সময় দিতে পারিনি। কিন্তু তার মাঝেই তারা সবাইকে নিয়ে দলবেঁধে সমুদ্রোপকূলে বনেজঙ্গলে বেড়াতে নিয়ে চলে গেল। যত ধরনের বেড়ানো আছে তার মাঝে সবচেয়ে মজার বেড়ানো হচ্ছে যখন নিজেদের কিছু করতে হয় না, অন্যেরা সবকিছু করে দেয়। যারা সবকিছু করে দেয় তারা যদি ছাত্রছাত্রী হয় তাহলে তো কথাই নেই।
(মজার ব্যাপার হচ্ছে দেশে ফিরে আসার পর দেখি আমরা কখন কোথায় কী করেছি তার সবকিছু সবাই জানে। ফেসবুকের কল্যাণে কিছু ঘটার আগেই সেই ঘটনার কথা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। এ রকম একটা কিছু যে হতে পারে আমরা কি অল্প কিছুদিন আগেও সেটা জানতাম? ভবিষ্যতে আরও কিছু কী ঘটতে পারে যেটা এখন আমরা কল্পনাও করতে পারছি না!)
৪.
যারা এই লেখাটি পড়ছে তারা নিশ্চয়ই আবিষ্কার করে ফেলেছে আসলে এখানে অস্ট্রেলিয়ার কোনো কথা নেই, এখানে সব কথা অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী বাঙালিদের কথা! আসলে কেউ যদি কয়েকদিনের জন্যে কোনো দেশে যায় তাহলে সেই দেশকে সত্যিকার অর্থে অনুভব করার কোনো সুযোগ থাকে না। একটা দেশকে অনুভব করতে হলে সেই দেশে দীর্ঘদিন থাকতে হয়। তখন সেই দেশের বাহ্যিক চকচকে দৃশ্যের পেছনে গ্লানিগুলো চোখে পড়ে, ব্যর্থতাগুলো দেখা যায়।
যারা সেই দেশে থাকেন তাদের কাছে একটা তথ্য পেয়েছি যেটা আমাকে অবাক করেছে। স্কুলের লেখাপড়া নিয়ে অভিভাবকদের মাঝে এক ধরনের হতাশা। হতাশার মূল কারণ সেখানে যথেষ্ট ভালো শিক্ষক নেই। শিক্ষকের বিশেষ অভাব বিজ্ঞান, গণিত এসব বিষয়ে। সমস্যার সমাধান হবে সে রকম আশাও নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিষয়ে ছাত্রছাত্রী নেই, প্রায় বিশ্ববিদ্যালয়েই এই বিষয়গুলোই তুলে দেওয়া হচ্ছে!
শুনে মনে হয় হুবহু আমাদের দেশের কাহিনী। এত সম্পদ নিয়েও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ হিমশিম খাচ্ছে, তাহলে আমরা কেন অভিযোগ করছি? শিক্ষার পিছনে জিডিপির মাত্র ২.২ শতাংশ খরচ করে আমরা তো খুব খারাপ করিনি! আরেকটু বেশি হলে না যেন কী হত!
অস্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যা দুই কোটি আর আমাদের দেশে স্কুলেই পড়ে তিন কোটি বাচ্চা-কাচ্চা। সরকার যদি লেখাপড়ার গুরুত্বটা বুঝে সেনাবাহিনীর বাজেট না বাড়িয়ে শিক্ষার বাজেট বাড়াত, তাহলে এই দেশে কী বিপ্লব ঘটে যেতে পারত কেউ কি কখনও কল্পনা করে দেখেছে?
৫.
শুরুতে বলেছিলাম বিষুব রেখা অতিক্রম করার একটা উদ্দেশ্য ছিল আকাশের দিকে তাকিয়ে পৃথিবীর উজ্জলতম নক্ষত্রটি দেখা। সেটা দেখে এসেছি– কী চমৎকার সেই নক্ষত্র। মনে হচ্ছে গভীর মমতা নিয়ে সেটি আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
Post a Comment Blogger Facebook