আজম খানের জন্ম ১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আজিমপুরের এক সরকারি
কোয়ার্টারে৷ তার আসল নাম মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান৷ ১৯৭০
সালে তিনি ঢাকার টি.এন.টি কলেজ থেকে স্নাতক লাভ করেন৷ বাবা আফতাব উদ্দিন খান
ছিলেন সরকারের সচিবালয়ের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা; মা জোবেদা বেগম একজন
সংগীত শিল্পী।
ষাট এবং সত্তরের দশক ছিল প্রথা না মানার সময়। শুরু পশ্চিমে হলেও এর জের এসে আছড়ে পড়েছিল এই বাংলাতেও। প্রথা না মানা এমনই
একদল তরুণ বিদ্রোহ করেছিল রক্ষণশীল বাংলা গানের বিরুদ্ধে। খুলে দিয়েছিলেন পপ গানের
উন্মাতাল অর্গল। এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন আজম খান।
দ্রোহী হয়ে সামাজিক প্রথা ভাঙলেও তাঁরা কখনো সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হন
নি। সাধারণ মানুষের নাড়ির সাথে যোগাযোগ সবসময়ই
অক্ষুন্ন ছিল।
ছোটবেলা থেকেই আজম খান ডানপিটে স্বভাবের, ভয়ডর কম। ১৯৬৮ সালে আজম খানের বয়স সতের কি আঠারো। ‘ক্রান্তি’ শিল্পী গোষ্ঠীর হয়ে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে গান গাইতে গিয়ে তার একবারও বুক কাঁপেনি।
সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আজম খান বললেন, “১৯৬৮ তে ছাত্রাবস্থায় আমরা বন্ধুবান্ধব মিলে গান করতাম। সেই সময় আমি
গণসঙ্গীত শিল্পী গোষ্ঠি 'ক্রান্তি'র সঙ্গে যুক্ত হই। ঢাকায়, ঢাকার বাইরে
গান করতে গেলে পুলিশ নানা রকম হয়রানী করতো।”
“কত জেলায় জেলায় ঘুরেছি তখন। গান করেছি। আবার পুলিশের তাড়া খেয়ে দৌড়ও দিছি।
তার পরেও পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে গান করা থামাই নাই। আমাদের দলে ছিল
ফকির আলমগীর, মেসবাহ উদ্দিন সাবু সহ আরও অনেকে।”
তরুণ বয়সেই তিনি বুঝতে পারেন পাকিস্তান সরকার এদেশের মানুষের সাথে প্রতারণা করছে। ১৯৬৯ এর গণ আন্দোলনে তার সক্রিয় ভূমিকা ছিল। ১৯৭০ এর নির্বাচন আর পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাকে যুদ্ধের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সকাল থেকেই ঢাকা শহরের মানুষ টের পাচ্ছিল রাতে কিছু একটা হতে যাচ্ছে। আজম খানদের পৈতৃক বাড়ি কমলাপুর। তিনি ও তার পাড়ার বন্ধুরা মিলে এলাকার আশেপাশে ব্যারিকেড তৈরি করলেন। বাসা থেকে এক নলা, দো’নলা বন্দুক, দা, বটি, লাঠি, বাঁশ ইত্যাদি জোগাড় করতে শুরু করলেন। পাকিস্তানি বাহিনী যখনই আসুক তারা এসব অস্ত্র দিয়েই প্রতিরোধ করবেন।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, “১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় দেশপ্রেম থেকে আমরা রাস্তায় ব্যারিকেড
দিয়ে অবরোধ তৈরি করতাম। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর
ভয়ে বাসায় টেঁকা যেতো না। সেই সময় বন্ধুবান্ধব দল বেধে সিদ্ধান্ত নিলাম,
ঢাকায় থাকলে এমনিতেই মরতে হবে, তার চেয়ে যুদ্ধ করে মরাই ভাল। তখন সবাই
একসঙ্গে যুদ্ধে যাই।”
প্রথম প্রতিরোধ
রাতের বেলা শুরু হলো গোলাগুলি। আজম খান বলেন, “আমাদের বাড়িটা গলির ভিতর বলে এই দিকে মিলিটারি সেই রাতে ঢুকে নাই। কিন্তু আশপাশের এলাকা, কমলাপুর রেল স্টেশন, রাজারবাগ পুলিশ লাইন সব কিছু দখল করে নিলো মিলিটারিরা। আমরা তো আর ঘরে বসে নাই। বন্ধু বান্ধবরা সবাই মিলে একেক সময় একেক বাসার ছাদে গিয়ে উঁকি দিয়ে মিলিটারিদের ধ্বংসযজ্ঞ দেখি। শেষ পর্যন্ত আর থাকতে পারলাম না বাসায়। ভোরের আগে আগে মসজিদে গেলাম। যাতে আমাদের মুসলমান মনে করে মিলিটারিরা গুলি না করে।”
তখন মসজিদে গেলেন কী করে, মিলিটারি ছিল না? জানতে চাইলে আজম খান বলেন, “রাতের অন্ধকারেই চলে গেছিলাম। যাওয়ায় অসুবিধা হয় নাই। ভোরের আলো ফোটার পর দেখি কমলাপুর স্টেশনে মিলিটারিরা ঘাঁটি গাড়ছে।”
মসজিদ থেকেই উঁকি ঝুঁকি মেরে দেখেন মিলিটারিরা বাসার ছাদের ওপর ওড়ানো বাংলাদেশের পতাকা গুলি করে ফেলে দিচ্ছে। তাদের বাসার ছাদেও উড়ছিল পতাকা। আজম জানান, “সেটা বাঁচানোর জন্য আমার বোন ছাদে ওঠে। পতাকা খুলতে চেষ্টা করে। আমি সেটা দেখে দৌড়ে বাসায় যাই। বোনরে বলি-নাম নাম গুলি লাগব। এই বলতে বলতেই তার মাথার পাশ দিয়া একটা গুলি চলে গেল। অল্পের জন্য বেঁচে গেল আমার বোনটা।”
অতঃপর যুদ্ধযাত্রা
“সময়টা মনে নাই। তবে তখনও বর্ষা শুরু হয় নাই।” বলতে থাকেন আজম খান, “প্রথম প্রথম বাড়িতেই থাকতাম। এরপর যখন পাকিস্তানি মিলিটারি তরুণ যুবকদের ধরা শুরু করলো তখন পলাইয়া থাকতাম।”
মিলিটারি এলেই বাড়ির পেছনের পাঁচিল টপকে অন্যদিকে চলে যেতেন তিনি। এভাবে কয়েক মাস যাওয়ার পর তার মনে হলো- এভাবে কতদিন, এরচেয়ে যুদ্ধে যাওয়াই ভালো। তার বেশ কয়েকজন বন্ধু আগেই যুদ্ধে গিয়েছিল। তাই একদিন মাকে গিয়ে বললেন, “আমি যুদ্ধে যাব।” শুনে তার ছেলের দিকে এক পলক তাকিয়ে বললেন, “আমি জানিনা, তোর বাপকে জিজ্ঞেস কর।”
আজম খানের বাবা আফতাব উদ্দিন খান সচিবালয়ে উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। আজম খানের মনে যুদ্ধে যাওয়ার ভয় নাই, কিন্তু বাবা যদি যুদ্ধে যাওয়ার কথা শুনে থাপ্পড় মারে সেই ভয়ে কাতর হয়ে পড়লেন। শেষ পর্যন্ত সাহস করে বাবাকে বলেই ফেললেন কথাটা। “ভাবলাম এবার কপালে একটা লাথি পাওনা হয়ে গেল। কিন্তু না, আমার দিকে বাবা তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন- যুদ্ধে যাচ্ছিস ভালো কথা, কিন্তু দেশ স্বাধীন না করে ফিরতে পারবি না।
এর পরের দিন ভোরে পায়ে হেঁটে রওনা হলাম। সঙ্গে আমার তিন বন্ধু। গন্তুব্য আগরতলা। হাঁটতে হাঁটতে পুবাইল, কালিগঞ্জ, ঘোড়াশাল, নরসিংদী, ভৈরব পার হয়ে গেলাম। পথে কোন সমস্যা হলো না। ব্রাক্ষণবাড়িয়া পৌছলাম মধ্যরাতে। সেখানে গ্রামের মধ্যে এক যুবককে পেলাম। সে গ্রামবাসীদের নিয়ে দেশপ্রেম সভা করছে। পরে জানলাম, সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা। নামটা মনে নাই। অত রাতে আমাদের দেখে সে সন্দেহ করে বসলো। পরে হাজার প্রশ্নর উত্তর দিয়ে তার সন্দেহ দূর করি। সে আমাদের থাকতে দেয় গোয়াল ঘরে। সারারাত গরুর পাশে মশার কামড় খেয়ে কাটিয়ে দিলাম। পরের দিনও হাঁটলাম সারা দিন। এরপর পৌঁছলাম আগরতলায়। সেখানের মেলাঘর নামের এক জায়গায় মুক্তিযুদ্ধের জন্য আসা তরুণদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বন্ধুরা যারা আগেই যুদ্ধে অংশ নিতে চলে আসছিল তাদের প্রায় সবার সঙ্গে মেলাঘর প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে দেখা হল। আমাদের দেখে তারা হৈহৈ করতে করতে জড়িয়ে ধরলো।”
রুমির কাছে প্রশিক্ষণ
এখানে তার পরিচয় হয় শহী জননী জাহানারা ইমামের ছেলে রুমির সঙ্গে। খুব তাড়াতাড়িই দুজনে বন্ধু হয়ে যান। আজম খান জানালেন, “রুমিই আমাকে এলএমজি, রাইফেল চালানো, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করলো। আমাদের মধ্যে রুমিই ছিল সবচেয়ে এক্সপার্ট। একদিন সে চলে গেল যুদ্ধে। পরে খবর পেলাম সে শহীদ হয়েছে। মনটা খুবই খারাপ হলো।”
তবে বেশি দিন মন খারাপ করে থাকার সুযোগ পেলেন না। ততদিনে তাদের প্রশিক্ষণ শেষ। গেরিলা আক্রমণের জন্যই তাদের তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু মনোবল শক্ত করার জন্য একদিন তাদের দলকে পাঠানো হলো সম্মুখ যুদ্ধে। “কুমিল্লার সালদায় আমি প্রথম সরাসরি যুদ্ধ করি।” জানালেন আজম খান।
যুদ্ধের মধ্যেও গানকে ছাড়েননি তিনি। জাহানারা ইমামের একাত্তরের
দিনগুলিতেও সে কথা লেখা আছে। রুমি তার মাকে বলেছিল রাতের বেলা তারা
মেলাঘরে আজম খানের উদাত্ত গলার গান শুনতো। শুধু ট্রেনিং ক্যাম্পেই নয়,
সম্মুখসমরেও গানকে বিসর্জন দিতেন না তিনি। সহযোদ্ধারা নিষেধ করতো গান গাইতে। শত্রু সেনারা অবস্থান
টের পেয়ে যাবে এই আশংকায়। বলতো, ‘ওই গান থামা। পাক
সেনারা শুনলে বুইঝা যাইবো তুই কোথায়। তোর মরণের ভয় নাই নাকি?’ কে শোনে কার কথা। গান যার রক্তে, তাঁর
জন্য গানের আলাদা ক্ষেত্র বলে কিছু নেই। তাই যুদ্ধের ময়দানেও গান চলতো
অবলীলায়। তিনি বলতেন, ‘আরে মরবোইতো একদিন। ভয় পাওয়ার কী আছে? গান গাইয়া লই।
গান গাইতে গাইতে যুদ্ধ করা এই গানওয়ালার এখনও মনে আছে যুদ্ধের সময়ের রোমাঞ্চকর অনেক কাহিনী। এর মধ্যে প্রথম সম্মুখ যুদ্ধের কাহিনীটা তার স্মৃতিতে এরকম যেন গতকালের ঘটনা।
সম্মুখ সমরে
“কুমিল্লার সালদায় আমাদের ক্যাম্পটা ছিল নদীর পাড়ে। আমাদের ওস্তাদতো অনেক অভিজ্ঞ ছিল। তিনি জানতেন কবে পাক সেনাদের রসদ আসবে। একদিন দুপুরে তিনি আমাদের ডাক দিয়া বলেন, তোরা আজ চোখ রাখিস। আজ রসদ আসতে পারে। বলেই তিনি চোখের উপর গামছা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন।”
ঘুমালেন না আজম খানরা। তারা কিছুক্ষণ পরপর নদীর দিকে তাকান, আর নানান দুষ্টামি করেন। কেউ পেয়ারা গাছে উঠে পেয়ার খান, কেউ গান করেন। হঠাৎ দেখেন একটা নৌকা। প্রথমে সন্দেহ করেন নাই। তারপর দেখেন আরও দুইটা নৌকা। সঙ্গে সঙ্গে ওস্তাদকে ডাক দিলেন। তিনি দেখে বললেন, নাহ্ এইগুলা না। বলেই আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। একটু পরেই প্রায় বিশ ত্রিশটা নৌকা সারি চলে এলো দৃষ্টি সীমানায়। এবার আজম খান লাফিয়ে উঠলেন, “আবার ওস্তাদরে ডাক দিলাম। তিনি দেখে বললেন, খবরদার আমার নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত কেউ গুলি করবি না। তারপর পজিশন মত আসতেই তিনি মেশিনগান দিয়া গুলি শুরু করলেন। আর আমরাও যার যার অস্ত্র দিয়া গুলি করতে থাকলাম। নৌকাগুলা সব ছাড়খাড় হয়ে গেল চোখের পলকে। আমরা ভাবতাম পাক সেনারা সাঁতার জানে না। কিন্তু দেখি কী, তাদের মধ্যে কেউ কেউ সাঁতার দিয়া পাড়ের দিকে আসছে। আমরা সেদিকে লক্ষ করে গুলি করা শুরু করলাম।”
সেদিন বহু পাক সেনা মেরেছিলেন তারা। বিকালেই ওস্তাদ তাদের এলাকা থেকে সরে যেতে বললেন। কারণ প্রতিশোধ নিতে অন্য পাক সেনারা আসবেই। হলোও তাই। সন্ধ্যা বেলা থেকেই শুরু হলো পাক সেনাদের আক্রমণ। “আমরা মাটিতে ক্রল করে, ক্ষেতের আইল আড়াল দিয়ে, মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে জান নিয়ে ওই এলাকা ছাড়লাম। এরপরই আমাদের পাঠিয়ে দেয় ঢাকার দিকে।” জানালেন আজম খান।
ঢাকায় বোমা হামলা
ঢাকায় এসেও যেসব কাজ করেছেন সেসবও কম বীরত্বপূর্ণ নয়। এসময় তার দায়িত্ব ছিল ঢাকার আশে পাশের এলাকায় গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করা। আজম খান ছিলেন দুই নম্বর সেক্টরের একটা সেকশনের ইনচার্জ। আর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন কর্নেল খালেদ মোশাররফ।
আজম জানালেন, “একবার ডেমরার দিকে তিতাস গ্যাসের একটা পাইপ লাইন বোমা মেরে উড়িয়ে দিলাম।”
খুব সহজেই যে কথাটা বললেন সে কাজটা অতো সহজ ছিল না। “প্রথমে বোমার ফিতায় আগুন ধরাতে গিয়া সমস্যা। ম্যাচের কাঠি শুধু নিবে যায়। শেষে একসঙ্গে অনেকগুলা কাঠি জ্বালিয়ে বোমাতে আগুন দিলাম।” কিন্তু পালানোর জন্য যে সময় রেখেছিলেন তার আগেই বোমা গেল ফেটে। গ্যাসের লাইন ফেটে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। সেই আগুনে রাতের বেলাও আশেপাশের এলাকা দিনের মত পরিস্কার দেখা গেল। আর কী আওয়াজ! দুম দুম করে ফাটতে থাকলো গ্যাসের লাইন। আশেপাশের সব মানুষ পালানো শুরু করলো।
পাইপ লাইন উড়ালেন কেন জানতে চাইলে ব্যাখ্যা করলেন, “অভিজাত এলাকায় যাতে
গ্যাস না থাকে, তারা যাতে চাপে পড়ে এই কারণে। তখন অভিজাত এলাকাতেই তো পাক
আর্মিদের বড় বড় অফিসাররা থাকত।”
কিন্তু এলাকাটা যে রেকি করে এসেছিল সে হিসাবে একটু ভুল করছিলো। তাই পাইপ লাইন উড়িয়ে পালানোর সময় আজম খানরা বিপদে পড়লেন।
“আমাদের নৌকা ছিল নদীতে। আওয়াজ শুনে আমার সহযোদ্ধারা সবাই আগেই চলে গেছে। তাদের ওপর সেভাবেই নির্দেশ ছিল। কিন্তু আমার নৌকা নিয়া যখন পালাতে গেলাম, তখন দেখি আর দম নাই, শক্তিতে কুলোচ্ছে না। আমার সঙ্গে আরও দুই জন যোদ্ধা ছিল। নৌকায় আমাদের গোলা-বারুদ-অস্ত্র। আমরা তিনজন নৌকায় উঠতেই সেটাতে পানি উঠে গেল। ডুবে যায় যায় অবস্থা। শেষে আমরা তিনজনই পানিতে নেমে নৌকা ঠেলে এগুতে থাকলাম।”
তারা তখন দারুন টেনশনে ছিলেন। একদিকে জীবন আর অন্য দিকে অস্ত্র বাঁচানোর চিন্তা। কাছাকাছি আজম খানের পরিচিত একটা গ্রাম ছিল। সেখানকার বেশ কিছু ছেলেকে তারা প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত সেখানে কোনমতে পৌঁছানোর পর আজম খান নিজেই এক হাতে টেনে নৌকা পাড়ে উঠালেন। লোকজন তাকে দেখতে ধরাধরি করে গ্রামে নিয়ে গেল। আজম খানের তখন চৈতন্য লোপ পাওয়ার দশা। “সেই রাতে আমার আর কিছু মনে নাই। পড়ে সকালে উঠে দেখি আমি খড়ের গাদার উপর শুয়ে আছি। আর হাত পা ছিলে গেছে।”
হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে যে বোমা
বিস্ফোরণ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়া জাগিয়েছিল, সেটার নেতৃত্বেও ছিলেন আজম
খান। তাঁর দলই এই দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করেছিল। আন্তর্জাতিক এ হোটেলে
হামলা চালানোর কারণ ছিল, ঐ হোটেলে অবস্থানরত বিদেশীরা যাতে বুঝতে পারে দেশে
যুদ্ধ চলছে।
এছাড়াও তার নের্তৃত্বে ঢাকার অদূরে মাদারটেকের কাছে ত্রিমোহনীতে ও
কালিগঞ্জের সম্মুখ সমরে পাকসেনাদের হটিয়ে দেয় মুক্তিযোদ্ধারা। আরবান
গেরিলাদের যে দলগুলো বিজয়ের অনেক আগেই ঢাকা প্রবেশ করেছিল তার মধ্যে
অগ্রগন্য ছিল তার দলটা। গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ২০ নভেম্বর ঢাকায়
প্রবেশ করেন আজম খান।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আজম খান বলেন, “শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জাকিরের কথা প্রায়ই মনে পড়ে। ঢাকার
গোপীবাগে একজন আহত মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচাতে গিয়ে সে পাকিস্তানী সেনাদের
গুলিতে মারা যায়।... সে সময় জাকিরের মৃত্যুর খবর আমি গ্রুপের কাছে চেপে
গিয়েছিলাম, নইলে তারা মনোবল হারাতে পারতো।”
যুদ্ধের ফাঁকে বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসা সম্পর্কে তিনি বলেন, “আসতাম। চুপি চুপি। তখন পকেটে থাকতো টুপি। ওটা ছিল ক্যামোফ্লেজ। ঈদে বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। অনেক ঘুরে ঘুরে বাড়ি আসলাম। ঢুকলাম। বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা করে কোনরকমে এক চামচ সেমাই আর এক গ্লাস পানি মুখে দিয়েই বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম।”
ছেলে মুক্তিযুদ্ধে থাকার কারণে আজম খানের পরিবারের লোকজনকেও অনেক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। আজম খান জানালেন, “পাড়ার সামনে এক বুড়ো দোকানদার আমার কাছে দেড়শো টাকা পেতো। সেই টাকা ফেরত না পেয়ে দোকানদার পাক সেনাদের আমার বাসা চিনিয়ে দেয়।”
পাক সেনারা অনেক ঝামেলা করতো। তারা আজম খানের বাবার কাছে গিয়ে বলতো- আজম কাহা হ্যায়? বাবা বলতেন- আজম নেহি হ্যায়। মা হিন্দি উর্দুতে ভালো বলতে পারতেন। তিনিই পাক সেনাদের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতেন। তারপরও শেষ রক্ষা হয়নি। “আমার ছোট ভাইকে তারা বাসার ছাদে নিয়া কাপড় খুলে উল্টা করে ঝুলিয়ে অনেক মেরেছে, আমার ব্যাপারে কথা বের করার জন্য।”
পাক সেনাদের অত্যাচার আজম খানের পরিবার যে কতটা সহ্য করেছে সেটার উদাহরণ দিতে গিয়ে খান বললেন চরম এক মুহূর্তের কথা, “একবার তো আমার দুই ভাই মারাই যাচ্ছিল। বাড়ির পেছনে একটা কূয়া ছিল। সেখানে আমার বড় দুই ভাই আলম খান (সুরকার) ও মোহন খানকে খালি গায়ে দাঁড় করিয়ে জেরা শুরু করলো। আমার খোঁজ না দিলে তাদেরকে মেরে ফেলবে। সেটা দেখে আমার বাবাও শার্ট খুলে তাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে গেলেন। বললেন – আমার ছেলেদের মেরে ফেললে আমার বেঁচে থেকে কী লাভ। কপাল ভালো, ঠিক এ সময় শুরু হলো ভারতীয় বিমান বাহিনীর বোমা বর্ষণ। তখন পাক সেনারা আমার বাবা ভাইদের ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়।”
অবহেলিত মুক্তিযোদ্ধাদের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “এই তো সেদিন ফকিরাপুলে আমার গ্রুপের একজন মুক্তিযোদ্ধাকে দেখি, ফুটপাতে চা বিক্রি করছে! কি আর করবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যার ভেতর আছে, সে তো আর চুরি করতে পারে না! ... মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো সরকারই তো মূল্যায়ন করেনি।”
স্বাধীনতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সম্ভাবনা নিয়ে তিনি বলেন, “অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন স্বাধীনতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কঠিন হয়ে গেছে। এখন রাজাকার, আলবদর, আলশামসরা সংগঠনিকভাবে অনেক বেশী শক্তিশালী। একজন গোলাম আজমের বিচার করলেই এদের ভিত্তি নির্মূল করা যাবে না। এদের যে বিস্তৃতি গত ৩৬ বছরে ঘটেছে, তাকে উৎখাত করা সত্যিই কঠিন। তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার একদিন না একদিন হতেই হবে।”
“স্বাধীনতার পর পরই এই বিচার হওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু তা হয়নি, কারণ ভারত সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে পাকিস্তানী সেনাদের স্বসন্মানে পাকিস্তানে ফেরৎ পাঠিয়েছে। একই সঙ্গে এর পরের সরকারগুলো ক্ষমতার লোভে পাক সেনাদের সহযোগী যুদ্ধাপরাধীদের লালন-পালন করেছে।”
“কিন্তু তা না হয়ে ভারত যদি মুক্তিযুদ্ধে শুধু সহায়কের ভুমিকা পালন করতো, আমরা নিজেরাই যদি আমাদের যুদ্ধ শেষ করতে পারতাম, তাহলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতো। নয় মাসে নয়, নয় বছর পরেও দেশ স্বাধীন হলে আমরা স্বাধীনতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারতাম।”
“কিন্তু যুদ্ধাপরাধ কখনো তামাদী হয় না। তবে এদের বিচার বিলম্বিত হওয়ায় অনেক সাক্ষ্য প্রমান সংগ্রহ করা এখন কঠিন হয়ে গেছে। তাই অনেক দেরীতে হলেও আন্তর্জাতিক আদালত বসিয়ে এর বিচার করা উচিত। এ জন্য সরকারের সদিচ্ছা ছাড়াও আন্তর্জাতিক সমর্থন প্রয়োজন।”
“স্বাধীনতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দায়িত্ব সৎ ও দেশপ্রেমিক সরকারকেই নিতে হবে। তবে যতদিন এটি জাতীয় দাবিতে পরিনত না হবে, ততদিন কোনো সরকারই এই বিচার করবে না।”
এখন নতুন প্রজন্মকে নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের গান, নতুন আশার গান শোনাবেন কিনা এ প্রশ্নের উত্তরে হতাশা ছড়িয়ে পড়ে শিল্পীর গলায়, “এই প্রজন্মের কেউ তো মুক্তিযুদ্ধের গান শুনতে চায় না! এদের জন্য এই সব গান করে লাভ নেই। তারা তো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসই জানে না। তবু এখন দেশ গড়ার গান করছি। দেশের দুঃসময়ে আমাদের আমি এই প্রজন্মকে অন্য এক মুক্তির গান শোনাতে চাই। কারণ এ দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি, প্রগতিশীল চিন্তা - চেতনার মুক্তি এখনো আসেনি।”