মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল (১৬ ডিসেম্বর ১৯৪৭ - এপ্রিল ১৮ ১৯৭১)
বাংলাদেশের
স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের মহান
মুক্তিযুদ্ধে চরম সাহসিকতা আর অসামান্য বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশের
সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান বীরশ্রেষ্ঠদের মধ্যে অন্যতম।
জন্ম ও শিক্ষাজীবন
মোস্তফা
কামাল ১৯৪৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভোলা জেলার দৌলতখান থানার পশ্চিম হাজীপুর
গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা হাবিবুর রহমান সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত
হাবিলদার ছিলেন। মাতা মালেকা বেগম৷ শৈশব থেকেই দুঃসাহসী হিসেবে খ্যাত
ছিলেন। পড়াশোনা বেশিদূর করতে পারেননি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পর উচ্চ
বিদ্যালয়ে দু-এক বছর অধ্যয়ন করেন।
মোস্তফা কামালের
ছেলেবেলা তাঁর পিতার কর্মস্থল কুমিল্লা সেনানিবাসে কেটেছে। গ্রামে হাবিবুর
রহমান হাফিজ মিলিটারি নামে পরিচিত৷
সরকারি ছুটিছাটায় হাবিবুর রহমান যখন গ্রামে আসেন তখন তাঁর সাথে নিয়ে আসেন
স্ত্রী মালেকা বেগম ও দুই সন্তান মোস্তফা কামাল এবং মোস্তাফিজুর রহমানকে৷
সেনানিবাসের সাজানো গুছানো পথ ধরে
হাঁটতে হাঁটতে তাঁর দিন কেটে যায়৷ স্কুল ফাঁকি দিয়ে মোস্তফা কামাল ঘুরে
বেড়ান সৈনিকদের ছাউনিতে৷ বিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার চেয়ে
সেনানিবাসে সেনাদের কুচকাওয়াজ, মার্চপাস্ট ইত্যাদি ভাল লাগতো। ক্রমেই তিনি
সেনাবাহিনীর একজন সদস্য হবার স্বপ্ন দেখতে থাকেন এবং স্থির করেন
সেনাবাহিনীতে যোগ দিবেন। পিতা চাননি তাঁর ছেলে সেনাবাহিনীতে যোগ দিক৷ ফলে
২০ বছর বয়সে
মোস্তফা কামাল একদিন কাউকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যান৷
তিনি
চুপিচুপি যোগ দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। পরে ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানের
চতুর্থ ইস্ট-বেঙ্গল রেজিমেন্টে চাকরি চূড়ান্ত হবার পরে তাঁর বাবা-মা
সন্ধান পান।
প্রশিক্ষণ শেষে তাঁকে নিয়োগ করা হয় ৪ ইস্ট বেঙ্গল
রেজিমেন্ট, কুমিল্লায়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর কয়েকদিন পূর্বে
সিপাহি মোস্তফা কামাল অবৈতনিক ল্যান্স নায়েক হিসেবে পদোন্নতি পান।
মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা
তিনি ছিলেন চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক। ১৯৭১ সালের মার্চের মাঝামাঝি সময়ে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে চতুর্থ ইস্ট
বেঙ্গল রেজিমেন্টকে পাঠানো হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়৷ তখন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে
স্বাধীনতা যুদ্ধের স্ফুলিঙ্গ৷ স্বাধীনতার দাবিতে সারাদেশ উত্তাল৷ প্রতিটি
সেনানিবাসে থমথমে অবস্থা৷ বাঙালি সামরিক অফিসারদের চেয়েও অধিক ক্ষুব্ধ,
ক্রুদ্ধ, উদ্বেলিত উত্তেজিত ছিল বাঙালি সিপাহীরা৷
সামরিক নিয়ন্ত্রণ
নিজেদের হাতে রাখার জন্য সশস্ত্র বাহিনীর অবাঙালি অধিনায়কেরা বিভিন্ন
বাঙালি রেজিমেন্টকে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে স্থানান্তর করছিল৷ এই
অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা শক্তিশালী করার উদ্দ্যেশেই কুমিল্লা থেকে
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্থানান্তর করা হয়েছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে৷ কিন্তু
উদ্দেশ্য শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়৷ মেজর শাফায়েত জামিল কিছুসংখ্যক বাঙালি অফিসারের সহায়তায় ২৭ মার্চের সকালবেলা
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সেসময়ের অবাঙালি অধিনায়ক লে.কর্নেল খিজির হায়াত খান এবং
সমস্ত পাকিস্তানি অফিসার ও জওয়ানদের নিরস্ত্র করে বন্দি করে ফেলেন৷ অপরদিকে
মেজর খালেদ মোশাররফ অন্য একটি কোম্পানি নিয়ে সিলেটের শমসেরনগর থেকে
বিদ্রোহে যোগ দেন এবং নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। এরপর তারা মেজর খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে আশুগঞ্জ, উজানিস্বর ও
ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার এন্ডারসন খালের পাশ দিয়ে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন। ১৪
এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী হেলিকপ্টার গানশীপ, নেভাল গানবোট ও এফ-৮৬
বিমানযোগে মুক্তিবাহিনীর ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিরক্ষা অবস্থানের
উপর ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনী কৌশলে পশ্চাদপসরণ করে
ব্রাহ্মণবাড়িয়া - আখাউড়া রেলপথ ধরে চলে এল আখাউড়ায়৷ এই আখাউড়াকে কেন্দ্র করে
নতুনভাবে মোট তিনটি প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে তোলা হলো৷ তিতাস নদীর ব্রিজে,
আখাউড়ার দক্ষিণে গঙ্গাসাগরে এবং তার উত্তরে দরুইন গ্রামে।
ইতিমধ্যেই
মোস্তফা কামালের সাহস, বুদ্ধি ও কর্মতৎপরতা মুগ্ধ করে মেজর সাফায়াত জামিলকে
৷ তিনি তাঁকে ২নং প্লাটুনের ল্যান্সনায়েক নির্বাচিত করেন৷ সে অনুসারে
মোস্তফা কামাল দশজন সৈন্যের সেকশন কমান্ডার হন৷ এই ২নং প্লাটুনকেই দরুইন
গ্রামের প্রতিরক্ষা ঘাঁটির দায়িত্ব দেওয়া হলো৷
যেভাবে শহীদ হলেন
১৬
এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য
কুমিল্লা-আখাউড়া রেললাইন ধরে উত্তর দিকে এগুতে থাকে। ১৭ই এপ্রিল পরদিন
ভোরবেলা পাকিস্তান সেনাবাহিনী দরুইন গ্রামে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উপর
মর্টার ও আর্টিলারীর গোলাবর্ষণ শুরু করলে মেজর শাফায়াত জামিল ১১ নম্বর
প্লাটুনকে দরুইন গ্রামে আগের প্লাটুনের সাথে যোগ দেয়ার নির্দেশ দেন। ১১
নম্বর প্লাটুন নিয়ে হাবিলদার মুনির দরুইনে পৌছেন। সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফা
কামাল তার নিকট থেকে গুলি নিয়ে নিজ পরিখায় অবস্থান গ্রহণ করেন।
সকালটা একরকম নির্বিঘ্নেই কাটল৷
পাকিস্তানি বাহিনী কোনোরকম গোলাবর্ষণই করল না৷ শুধু কয়েকটা হেলিকপ্টার উড়ে
গেল উজানীস্বর পুলের দিকে৷
বেলা
১১ টার দিকে শুরু হয় শত্রুর গোলাবর্ষণ। সেই সময়ে শুরু হয় মুষলধারে
বৃষ্টি। সাড়ে ১১টার দিকে মোগরা বাজার ও গঙ্গা সাগরের শত্রু অবস্থান থেকে
গুলি বর্ষিত হয়। মোগরা বাজারের একটি উঁচু দালানের ছাদে শত্রুরা বসাল একটি
মেশিনগান৷
আর এ থেকেই মারাত্মকভাবে দরুইনের ঘাঁটিতে গোলাবর্ষণ করে যাচ্ছিল৷ ১২ টার
দিকে আসে পশ্চিম দিক থেকে সরাসরি আক্রমণ। প্রতিরক্ষার সৈন্যরা আক্রমণের
তীব্রতায় বিহ্বল হয়ে পড়ে। কয়েক জন শহীদ হন। মোস্তফা কামাল মরিয়া হয়ে
পাল্টা গুলি চালাতে থাকেন। দুপুরের পর পাক হানাদারের আক্রমণ আরও তীব্রতর
আকার ধারণ করল৷ মুক্তিযোদ্ধারা সামান্য হতবিহ্বল হয়ে
পড়েন৷ তবে সেকশন কমান্ডার মোস্তফার অবিচলিত মনোভাব ফের তাঁদের আত্নবিশ্বাস
ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে৷ তাঁর পূর্ব দিকের সৈন্যরা পেছনে সরে নতুন
অবস্থানে সরে যেতে থাকে এবং মোস্তফাকে যাবার জন্য অনুরোধ করে। কিন্তু
মোস্তফা
কামাল স্থির করলেন তিনিই কাভারিং ফায়ার দেবেন৷ তাদের সবাইকে নিরাপদে সরে
যাওয়ার সুযোগের জন্য মোস্তফা পূর্ণোদ্যমে এল এম জি থেকে গুলি চালাতে
থাকেন। তাঁর ৭০ গজের মধ্যে শত্রুপক্ষ চলে এলেও তিনি থামেননি। মোস্তফা
কামালকে দুর্গের মধ্যে
রেখেই বাকিরা খুব সাবধানে পিছু হটতে লাগলেন৷ মোস্তফা অনবরত গুলি চালাতে
লাগলেন শত্রুদের ওপর৷ তাঁর গুলির তোড়ে হানাদার বাহিনী এগোতে গিয়ে থামতে
বাধ্য হলো৷ ক্রমাগত গুলি চালাতে লাগলেন
শত্রুর ওপর৷ কিন্তু একসময় তাঁর গুলি ফুরিয়ে গেল৷ হানাদার বাহিনী
ত্রিমুখী আক্রমণে তাঁকে ঘিরে গুলি চালাতে লাগল৷ গুলিতে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে
গেল মোস্তফার শরীর৷ নিজের পরিখাতেই ঢলে পড়েন তিনি৷
দরুইন
গ্রাম থেকে মুক্তিযোদ্ধারা আখাউড়া চলে যান৷ গঙ্গাসাগর ও
দরুইন অধিকার করে একসময় পাকবাহিনী এলাকা ছেড়ে যায়৷ পরবর্তীতে দরুইনের
স্থানীয় লোকেরা বুলেটে ঝাঁঝরা, বেয়নেটবিদ্ধ মোস্তফা কামালের লাশ খুঁজে পান৷
হানাদার বাহিনী যখন ট্রেঞ্জে প্রবেশ করে তখনও হয়ত মোস্তফার দেহে প্রাণ
ছিল৷ বর্বর হানাদাররা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়েই হয়তো তাঁকে হত্যা
করেছে৷
পুরস্কার ও সম্মাননা
দরুইন
গ্রামের জনগণ মোস্তফা কামালকে তাঁর শাহাদাতের স্থানের পাশেই সমাহিত
করেন। মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ সরকার
তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করে। এছাড়া
তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত কলেজ প্রাঙ্গণের একটি কোণে ভোলা জেলা পরিষদের
তত্ত্বাবধানে বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল লাইব্রেরি ও জাদুঘর নির্মাণ করা
হয়। মোস্তফা কামালের নামানুসারে গ্রামের নাম মৌটুপীর নাম পরিবর্তন করে
রাখা হয়েছে কামালনগর৷
|
বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের সমাধীসৌধ |
সংক্ষিপ্ত জীবনী
জন্ম : ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৪৭ সাল।
জন্মস্থান : ভোলা জেলার দৌলতখান থানার পশ্চিম হাজিপুর গ্রামে৷
পিতা : হাবিবুর রহমান মণ্ডল ৷
মা : মোসাম্মৎ মালেকা বেগম ৷
কর্মস্থল : সেনাবাহিনী৷
যোগদান : ১৯৬৮ সাল৷
পদবী : সিপাহী৷
মুক্তিযুদ্ধে অংশরত সেক্টর : ৮ নং সেক্টর৷
মৃত্যু : ১৮ এপ্রিল, ১৯৭১ সাল৷
সমাধি স্থল : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার দরুইন গ্রামে৷
ছবি ও তথ্য সূত্র : মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর, উইকিপিডিয়া, ইন্টারনেট, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বিভিন্ন গবেষনাপত্র।
এই লেখাটি ইংরেজিতে দেখতে
এখানে ক্লিক করুন।