কবিতাটির নাম "কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি" । ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় গুলিবর্ষণ ও হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে লেখা এটিই ছিল প্রথম কবিতা। মাহবুব উল আলম চৌধূরী সে সময়ে চট্রগ্রাম জেলা রাষ্ট্রভাষা-সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক ছিলেন। একুশে ফেব্রুয়ারির ঠিক আগে আগেই তিনি আকস্মিকভাবে জলবসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। ঢাকার ছাত্রহত্যার খবর পেয়ে একুশে রাতেই রোগশয্যায় শুয়ে এই দীর্ঘ কবিতাটি তিনি রচনা করেন। রাতেই সেটি মুদ্রিত হয় এবং পরদিন প্রচারিত ও চট্রগ্রামের প্রতিবাদ সভায় পঠিত হয়। এই ঘটনার বিবরণ দিয়ে খোন্দকার মোহম্মদ ইলিয়াস লিখেছেন:
জলবসন্তে আক্রান্ত সুশ্রী মাহবুব উল আলম চৌধুরীর সুদীপ্ত দু’টি চোখে ঝরছিল আগুন। তাঁর কলম দিয়ে বেরিয়ে আসে আগ্নেগিরির লাভার মতো জ্বলন্ত এক দীর্ঘ কবিতা, ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’। আন্দরাকিল্লায় অবস্থিত একটি প্রেসে কবিতাটি পুস্তিকার আকারে প্রকাশের দায়িত্ব পড়ে আমার উপর। ব্যবস্থা হয় সারারাত প্রেসে কাজ চালিয়ে পরদিন সকাল বেলার মধ্যে গোপনে প্রকাশ করতে হবে অমর একুশের প্রথম সাহিত্য সৃষ্টি, প্রথম সাহিত্য সংকলন।
রাতের শেষ প্রহরে কম্পোজ ও প্রুফের কাজ যখন সমাপ্ত প্রায় , হঠাৎ একদল সশস্ত্র পুলিশ হামলা করে উক্ত ছাপাখানায়।প্রেসের সংগ্রামী কর্মচারীদের উপস্থিত বুদ্ধি ও ক্ষিপ্ততার মধ্যে দ্রুত লুকিয়ে ফেলা হয় আমাকে সহ সম্পূর্ন কম্পোজ ম্যাটার। তন্ন তন্ন করে খোঁজাখুঁজির পর পুলিশ যখন খালি হাতে ফিরে চলে যায় শ্রমিক -কর্মচারীরা পুনরায় শুরু করে তাদের অসমাপ্ত কাজ। শ্রমিক শ্রেণি যে ভাষায় যে দেশে যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন, তার সংগ্রামী চেতনা যে অসাধারণ তার প্রমাণ সেদিন হাতে হাতে পেয়েছিলাম চট্রগ্রামে। দুপুরের মধ্যে মুদ্রিত ও বাঁধাই হয়ে প্রকাশিত হয় "কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দা্বী নিয়ে এসেছি"।.............
অপরাহ্নের লালদীঘির ময়দানে জনসমুদ্রে সভাপতির আসন অলংকৃত করলেন চট্রগ্রামের মুসলিম লীগ নেতা জনাব রফিউদ্দিন সিদ্দিকী। সভার কর্মসূচীর এক পর্যায়ে ছিল মাহবুব উল আলেম চৌধুরীর রচিত , "কাঁদতে আসিনি,ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি" পাঠ। কবিতার যেমন ভাষা , তেমনি তার ভাব, তেমন তার ছন্দ। শ্রোতৃবৃন্দ একেকবার উত্তেজিত হয়ে ফেটে পরছেন আর আওয়াজ তুলছেন "চল চল ঢাকা চল"।
দেশের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার সৌভাগ্য হয় না সকল সাহিত্যকর্মের । এই কবিতাটি তা হয়েছিল। বাজেয়াপ্ত হলেও হাতে হাতে কবিতাটি পুর্ব বাংলার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছড়িয়ে গিয়েছিল।
পাদটীকাস্বরুপ একটি কথা বলার দরকার । এই কবিতায় একুশে ফেব্রুয়ারির চল্লিশ জন শহীদের উল্লেখ করা হয়েছে। তথ্য হিসেবে এটি অতিরঞ্জিত মনে হতে পারে, কিন্তু তখন আমাদের এমন ধারনা হয়েছিল। হাসান হাবিজুর রহমানের সুবিখ্যাত ‘অমর একুশে’ কবিতায় পঞ্চাশ জন শহীদের কথা বলা হয়েছে। তিনিও তো ভাষা -আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন।
একুশের প্রথম কবিতা যে মাহবুব উল আলম চৌধুরী লিখলেন, তা হয়তো এক আকস্মিক ঐতিহাসিক ঘটনা। কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে কবিতা তাঁকে লিখতেই হতো তাঁর সমগ্র জীবনাচরণ ও সাহিত্য চর্চা ধারায় তা চির অনিবার্য। নিতান্ত অল্প বয়স থেকেই রাজনীতি ও সংস্কৃতিকে তিনি মিলিয়েছিলেন একই স্রোতে।
কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি - মাহবুব উল আলম চৌধুরী
ওরা চল্লিশজন কিংবা আরো বেশি
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে−রমনার রৌদ্রদগ্ধ কৃষ্ণচুড়া
গাছের তলায়
ভাষার জন্য, মাতৃভাষার জন্য−বাংলার জন্য।
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে
একটি দেশের মহান সংস্কৃতির মর্যাদার জন্য
আলাওলের ঐতিহ্য
কায়কোবাদ, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের
সাহিত্য ও কবিতার জন্য−
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে
পলাশপুরের মকবুল আহমদের
পুঁথির জন্য−
রমেশ শীলের গাথার জন্য,
জসীমউদ্দীনের ‘সোজন বাদিয়ার ঘাটের’ জন্য।
যারা প্রাণ দিয়েছে
ভাটিয়ালি, বাউল, কীর্তন, গজল
নজরুলের “খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি
আমার দেশের মাটি।”
এ দুটি লাইনের জন্য
দেশের মাটির জন্য,
রমনার মাঠের সেই মাটিতে
কৃষ্ণচুড়ার অসংখ্য ঝরা পাপড়ির মতো
চল্লিশটি তাজা প্রাণ আর
অঙ্কুরিত বীজের খোসার মধ্যে
আমি দেখতে পাচ্ছি তাদের অসংখ্য বুকের রক্ত।
রামেশ্বর, আবদুস সালামের কচি বুকের রক্ত
বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সেরা কোনো ছেলের বুকের রক্ত।
আমি দেখতে পাচ্ছি তাদের প্রতিটি রক্তকণা
রমনার সবুজ ঘাসের উপর
আগুনের মতো জ্বলছে, জ্বলছে আর জ্বলছে।
এক একটি হীরের টুকরোর মতো
বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছেলে চল্লিশটি রত্ন
বেঁচে থাকলে যারা হতো
পাকিস্তানের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ
যাদের মধ্যে লিংকন, রকফেলার,
আরাগঁ, আইনস্টাইন আশ্রয় পেয়েছিল
যাদের মধ্যে আশ্রয় পেয়েছিল
শতাব্দীর সভ্যতার
সবচেয়ে প্রগতিশীল কয়েকটি মতবাদ,
সেই চল্লিশটি রত্ন যেখানে প্রাণ দিয়েছে
আমরা সেখানে কাঁদতে আসিনি।
যারা গুলি ভরতি রাইফেল নিয়ে এসেছিল ওখানে
যারা এসেছিল নির্দয়ভাবে হত্যা করার আদেশ নিয়ে
আমরা তাদের কাছে
ভাষার জন্য আবেদন জানাতেও আসিনি আজ।
আমরা এসেছি খুনি জালিমের ফাঁসির দাবি নিয়ে।
আমরা জানি ওদের হত্যা করা হয়েছে
নির্দয়ভাবে ওদের গুলি করা হয়েছে
ওদের কারো নাম তোমারই মতো ওসমান
কারো বাবা তোমারই বাবার মতো
হয়তো কেরানি, কিংবা পূর্ব বাংলার
নিভৃত কোনো গাঁয়ে কারো বাবা
মাটির বুক থেকে সোনা ফলায়
হয়তো কারো বাবা কোনো
সরকারি চাকুরে।
তোমারই আমারই মতো
যারা হয়তো আজকেও বেঁচে থাকতে
পারতো,
আমারই মতো তাদের কোনো একজনের
হয়তো বিয়ের দিনটি পর্যন্ত ধার্য হয়ে গিয়েছিল,
তোমারই মতো তাদের কোনো একজন হয়তো
মায়ের সদ্যপ্রাপ্ত চিঠিখানা এসে পড়বার আশায়
টেবিলে রেখে মিছিলে যোগ দিতে গিয়েছিল।
এমন এক একটি মূর্তিমান স্বপ্নকে বুকে চেপে
জালিমের গুলিতে যারা প্রাণ দিল
সেই সব মৃতদের নামে
আমি ফাঁসি দাবি করছি।
…
খুনি জালিমের নিপীড়নকারী কঠিন হাত
কোনোদিনও চেপে দিতে পারবে না
তোমাদের সেই লক্ষদিনের আশাকে,
যেদিন আমরা লড়াই করে জিতে নেব
ন্যায়-নীতির দিন
হে আমার মৃত ভাইরা,
সেই দিন নিস্তব্ধতার মধ্য থেকে
তোমাদের কন্ঠস্বর
স্বাধীনতার বলিষ্ঠ চিৎকারে
ভেসে আসবে
সেই দিন আমার দেশের জনতা
খুনি জালিমকে ফাঁসির কাষ্ঠে
ঝুলাবেই ঝুলাবে
তোমাদের আশা অগ্নিশিখার মতো জ্বলবে
প্রতিশোধ এবং বিজয়ের আনন্দে।
Post a Comment Blogger Facebook