image

image
 

A+ A-
Voice of 71 Voice of 71 Author
Title: ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠঃ বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মতিউর রহমান
Author: Voice of 71
Rating 5 of 5 Des:
বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মতিউর রহমান (২৯শে অক্টোবর, ১৯৪১—২০শে আগস্ট, ১৯৭১) বাংলাদেশী মুক্তিযোদ্ধা । তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত হন ...
বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মতিউর রহমান (২৯শে অক্টোবর, ১৯৪১—২০শে আগস্ট, ১৯৭১)

বাংলাদেশী মুক্তিযোদ্ধা । তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত হন । বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে চরম সাহসিকতা আর বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ যে সাতজন বীরকে সর্বোচ্চ সম্মান বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করা হয় ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান তাদের মধ্যে অন্যতম ।

বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মতিউর রহমান

জন্ম, শিক্ষা ও কর্মজীবনঃ
মতিউর রহমান ১৯৪১ সালের ২৯ অক্টোবর পুরান ঢাকার ১০৯ আগা সাদেক রোডের পৈত্রিক বাড়ি "মোবারক লজ"-এ জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর বাবা মৌলভী আবদুস সামাদ, মা সৈয়দা মোবারকুন্নেসা খাতুন । তাঁর বাবা পেশায় ছিলেন ঢাকা কালেক্টর অফিসের সুপার । নরসিংদী জেলার রায়পুর থানার রামনগর গ্রামে ছিল তাঁদের পৈত্রিক নিবাস । নয় ছেলে দুই মেয়ের পরিবারে জন্ম নেয়া মতিউর ছিলেন অষ্টম ।

ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, দুরন্ত, ডানপিটে । ১৯৫২ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীতে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় । ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ষষ্ঠ শ্রেণী পাস করার পর সারগোদায় পাকিস্তান বিমান বাহিনী পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন । ১৯৬০ সালের মে মাসে তিনি ডিস্টিংকশনসহ মেট্রিক পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন ।

এরপর ১৯৬১ সালের আগস্টের ১৫ তারিখে তিনি রিসালপুরে পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর একাডেমিতে ফ্লাইট ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন জিডি পাইলট কোর্সে । মতিউর ছিলেন একজন চৌকস ক্যাডেট । তাঁর একাগ্রতা, ইচ্ছা আর মেধা দিয়ে তিনি এগিয়ে গেলেন । ১৯৬৩ সালের জুন মাসে রিসালপুর পি.এ.এফ কলেজ থেকে কমিশন লাভ করেন এবং জেনারেল ডিউটি পাইলট হিসাবে নিযুক্ত হন । এরপর করাচির মৌরীপুরে জেট কনভার্সন কোর্স সমাপ্ত করে পেশোয়ারে গিয়ে জেটপাইলট হন । ১৯৬৫ তে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ফ্লাইং অফিসার অবস্থায় কর্মরত ছিলেন । এরপর মিগ কনভার্সন কোর্সের জন্য পুনরায় সারগোদায় যান । সেখানে ১৯৬৭ সালের ২১ জুলাই একটি মিগ - ১৯ বিমান চালানোর সময় আকাশে সেটা হঠাৎ বিকল হয়ে গেলে দক্ষতার সাথে প্যারাসুট যোগে মাটিতে অবতরণ করেন । ১৯৬৭ সালে তিনি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি লাভ করেন । ইরানের রানী ফারাহ দিবার সম্মানে পেশোয়ারে অনুষ্ঠিত বিমান মহড়ায় তিনি ছিলেন একমাত্র বাঙালি পাইলট । 

বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান, সামনের সারিতে ডান থেকে দ্বিতীয়

১৯৬৮ সালের ১৯ এপ্রিল বিয়ে করেন এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে মিলি খানকে । বিয়ের কয়েকদিন পরেই মতিউর চলে যান পাকিস্তানের চাকলালা বিমান ঘাঁটিতে । ১৯৬৯ সালের ২৩ এপ্রিল জন্ম হয় এ দম্পতির প্রথম কন্যা মাহিনের । শহীদ হওয়ার পর বিজয় দিবসের মাত্র ২ দিন আগে ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ জন্ম হয় মতিউরের দ্বিতীয় সস্তান তুহিনের ।

মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকাঃ
১৯৭১ সালের শুরুতে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে মতিউর সপরিবারে দুই মাসের ছুটিতে আসেন ঢাকা । ২৫ মার্চের কালরাতে মতিউর ছিলেন রায়পুরের রামনগর গ্রামে । ২৫ মার্চের ঘটনায় তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হন । পরে তিনি দৌলতকান্দিতে জনসভা করেন এবং বিরাট মিছিল নিয়ে ভৈরব বাজারে যান । পাক-সৈন্যরা ভৈরব আক্রমণ করলে বেঙ্গল রেজিমেন্টে ই.পি.আর-এর সঙ্গে থেকে প্রতিরোধ বুহ্য তৈরি করেন । পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একজন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হয়েও অসীম ঝুঁকি ও সাহসিকতার সাথে ভৈরবে একটি ট্রেনিং ক্যাম্প খুললেন । যুদ্ধ করতে আসা বাঙালি যুবকদের প্রশিক্ষণ দিতে থাকলেন । মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা অস্ত্র দিয়ে গড়ে তুললেন একটি প্রতিরোধ বাহিনী । ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল পাকিস্তানি বিমান বাহিনী 'সেভর জেড' বিমান থেকে তাঁদের ঘাঁটির উপর বোমাবর্ষণ করে । মতিউর রহমান পূর্বেই এটি আশঙ্কা করেছিলেন । তাই ঘাঁটি পরিবর্তনের কারণে ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পান তিনি ও তাঁর বাহিনী । এরপর ৯ মে সপরিবারে করাচি ফিরে যান ।

যেভাবে শহীদ হলেনঃ
করাচি পৌঁছে মতিউর লক্ষ্য করলেন বাঙালি অফিসারদের সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে । তাঁকেও তাঁর নিজের দায়িত্ব না দিয়ে দেয়া হলো ফ্লাইট সেফটি অফিসারের দায়িত্ব । মতিউরের চিন্তা তখন কেবল একটি বিমানের । তিনি পরিকল্পনা শুরু করেন । সহকর্মীদের সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করছেন আর খুঁজছেন সুযোগ । পি. আই. এ-এর একটি বিমান হাইজ্যাকের পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর বাঙালি অফিসারদের উপর কড়া নজর রাখা শুরু হয় । বাঙালি পাইলটদের আকাশে উড্ডয়নের অনুমতি বাতিল করা হয় । মতিউর তখন করাচির মশরুর বিমান ঘাঁটির বেস ফ্লাইট সেফটি অফিসার । এর আগে মতিউর ছিলেন ফ্লাইট ইন্সট্রাকটর । ছাত্রদের বিমান চালনার প্রশিক্ষণ দিতেন তিনি । তাঁর অনেক পাকিস্তানি ছাত্রের একজন রশিদ মিনহাজ । সে পুরাতন ছাত্র । মতিউর জানতেন, সে একা আকাশে উড্ডয়নের অনুমতি পাবে । তাই তিনি তাকে টার্গেট করেন ।

১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট শুক্রবার ফ্লাইট শিডিউল অনুযায়ী মিনহাজের উড্ডয়নের দিন ছিলো । মতিউর পূর্ব পরিকল্পনা মতো অফিসে এসে শিডিউল টাইমে গাড়ি নিয়ে চলে যান রানওয়ের পূর্ব পাশে । সামনে পিছনে দুই সিটের প্রশিক্ষণ বিমান টি-৩৩ । রশিদ মিনহাজ বিমানের সামনের সিটে বসে স্টার্ট দিয়ে এগিয়ে নিয়ে আসছে । এবার মতিউরের পালা । মতিউর হাত তুলে বিমান থামালেন । হাতের ইশারায় বোঝানোর চেষ্টা করলেন, বিমানের পাখায় সমস্যা । রশিদ মিনহাজ বিমানের 'ক্যানোপি' খুলতেই মতিউর তাকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে ফেলে বিমানের পেছনের সিটে লাফিয়ে উঠে বসলেন । কিন্তু জ্ঞান হারাবার আগে মিনহাজ বলে ফেললেন, "আই হ্যাভ বিন হাইজ্যাকড ।" ছোট পাহাড়ের আড়ালে থাকায় কেউ দেখতে না পেলেও কন্ট্রোল টাওয়ার শুনতে পেল তা । বিমানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মতিউর বিমান নিয়ে ছুটে চললেন । রাডারকে ফাঁকি দেবার জন্য নির্ধারিত উচ্চতার চেয়ে অনেক নিচ দিয়ে বিমান চালাচ্ছিলেন তিনি । যদিও ততক্ষণে এফ ৮৬ ও একটি হেলিকপ্টার তাঁকে ধাওয়া করা শুরু করে কন্ট্রোল টাওয়ারের নির্দেশে । 

বিমানটি যখন ভারতীয় সীমান্তের দিকে যাচ্ছে তখন মিনহাজের জ্ঞান ফিরে আসে এবং সে বাধা দিতে চেষ্টা করে । সীমান্ত থেকে মাত্র দুই মিনিট দূরত্বে সিন্ধু প্রদেশের জিন্দা গ্রামে বালির ঢিবির উপর আছড়ে পড়ে ব্লুবার্ড-১৬৬ । ১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট দেশের জন্য শহীদ হন আমাদের এই বীর সন্তান মতিউর । মতিউরের বিমান হাইজ্যাকের স্বপ্ন সফল হলো না । 

এরপর মতিউর ও মিনহাজের লাশ উদ্ধার করা হয় এবং কোন প্রকার ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া মসরুর বিমান ঘাঁটিতে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের জন্য নির্ধারিত স্থানে মতিউরের লাশ দাফন করা হয় । তাঁর কবরে লেখা হয় 'গাদ্দার' বা বিশ্বাসঘাতক । রশীদকে পাকিস্তান সরকার সম্মানসূচক খেতাব দান করে । দীর্ঘ ৩৫ বছর পর ২০০৬ সালের ২৫ জুন তাঁর দেহাবশেষ বাংলাদেশে আনা হয় । ২৬ জুন মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয় । দীর্ঘ ৩৫ বছর অবহেলায় থাকলেও মতিউর ফিরে আসেন তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন দেশে । ঠাঁই পান এদেশের মাটিতে ।

২০০৬ সালে মতিউরের দেহাবশেষ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবি কবর স্থানে পুনঃসমাহিত করা হয়।

সংক্ষিপ্ত জীবনীঃ
নাম: মতিউর রহমান
জন্ম: ১৯৪১ সালের ২৯ অক্টোবর, ঢাকা শহরের আগা সাদেক রোডের ১০৯ নম্বর বাড়ি
মা: সৈয়দা মোবারুকুন্নেসা ।
বাবা: মৌলবি আব্দুস সামাদ ।
কর্মস্থল: বিমান বাহিনী ।
পদবী: ফ্লাইট লেফট্যানেন্ট ।
মৃত্যু: ১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট শুক্রবার ।
সমাধিস্থল: মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থান ।

রেফারেন্সঃ
১. বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান - উইকিপিডিয়া
২. বীরশ্রেষ্ঠ: মতিউর রহমান - মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী

About Author

Advertisement

Post a Comment Blogger

 
Top