কনসার্ট ফর বাংলাদেশ।
যা
ছড়িয়ে দিয়েছিল সারা বিশ্বে সংগীত দিয়ে আমাদের স্বাধীনতার ইচ্ছেটা। আমরা
স্বাধীনতার জন্য লড়ছি আর সেই সব ভিনদেশী মানুষ গুলো আমাদের জন্য চেষ্টা
করছে তাও আবার যে দেশটি চায় না স্বাধীন হোক এই দেশটা, সেই মাটিতেই!
গানতো
গানই! গানে আবার শোক-দুঃখের আবহ কেন? এমন প্রশ্ন যাদের মনে ছিল, ১৯৭১
সালের ১ আগস্ট তারা বর্ণে-শব্দে উত্তর পেয়ে যান সে প্রশ্নের!
সে
প্রশ্নের উত্তর ছিল একটি কনসার্টের মাধ্যমে, ‘বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি
গানের মাধ্যমে! আর ঐ প্রশ্নের উত্তর দেন বিশ্বের দু’জন সঙ্গীতগুরু সদ্য
প্রয়াত সেতার বাদক ওস্তাদ রবি শংকর, মানবতাবাদী গায়ক জর্জ হ্যারিসন সহ সব
কীর্তিমান একেকজন সংগীত এর কিংবদন্তিতুল্য গায়ক- বব ডিলান, এরিক ক্লিপটন,
বিলি প্রিষ্টন, লিয়ন রাসেল, রিঙ্গো স্টার, ডন প্রিষ্টন, ওস্তাদ আল্লারাখা, ওস্তাদ আলী আকবর খান, কমলা চক্রবর্তী সহ আরও অনেকে যারাই ছিলেন সব
দারুন সঙ্গীতজ্ঞ। বাজিয়েছেন সব বিখ্যাত সংগীত বাজনা অথবা তালের একেকজন
যাদুকর।
|
কনসার্ট ফর বাংলাদেশ এর বক্স অফিস সাইন |
১৯৭১
সালের মাঝামাঝি। এক ভয়াল সময় অতিক্রম করছে বাংলাদেশের অগণিত মানুষ।
বিশ্বের বৃহৎ পশ্চিমী রাষ্ট্রগুলি বাংলাদেশে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর
গণহত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞের ব্যাপারে সচেতন হচ্ছে না। বাংলাদেশের মানুষের
যৌক্তিক দাবী দমন করার জন্য পাকিস্তানী সামরিক সরকার বেছে নিলো নির্মম
সামরিক আক্রমণের পথ। অজস্র বাঙালী তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে, কেবল প্রাণ
বাঁচানোর তাগিদে ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিলো। শুরু হলো বাংলাদেশের
মুক্তিসংগ্রাম। অথচ ক্ষমতাধর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের এই প্রান্তে
নিজেদের রাজনৈতিক প্রভাব টিকিয়ে রাখার জন্য নতুন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের
আবির্ভাবের বিরোধিতায় ব্যস্ত। বাংলাদেশের শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার
জন্য, বাঙালী মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থন করার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী
ইন্দিরা গান্ধী তখন নিক্সন প্রশাসনের চক্ষুশূল। বাংলাদেশের মানুষের ওপর
বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী একটি সামরিক বাহিনীর আগ্রাসন বন্ধ করার জন্য
ভূমিকা রাখার পরিবর্তে, বহু বাঙালী শরণার্থীর দুর্দশা দেখার পরও ভারত কেন
বাঙালী গেরিলাদের সমর্থন করছে তার সমালোচনা তুলে ধরতেই মার্কিন, বৃটিশ
প্রশাসনের যেন আগ্রহ বেশি। বাঙালী মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সীমিত সামর্থ্য আর
অসীম মনোবল নিয়ে যুদ্ধ করে চলেছে। সাফল্য আসে, আর সাথে সাথে আসে গভীর
বেদনা, কারণ এই সাফল্যের জন্য দিতে হয় অনেক বড় মূল্য। বৃহৎ আন্তর্জাতিক
শক্তির বৈরী মনোভাব যুদ্ধ আর দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কেবল অতিরিক্ত উদ্বেগ আর
উৎকন্ঠাই সৃষ্টি করছিলো বাংলাদেশের মানুষের জন্য ১৯৭১-এর মাঝামাঝি সেই
শান্তিহীন সময়ে।
এমন পরিস্থিতিতেই ১৯৭১ সালের পহেলা
আগস্ট বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি
বিরূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই আয়োজন করা হয় এক অসাধারণ কনসার্ট, যা
ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে বিভিন্ন কারণে। এর আগে কখনো একদল অসম্ভব
খ্যাতিমান এবং বরেণ্য সঙ্গীতশিল্পী কোন দেশকে সাহায্য করার জন্য একসাথে কোন
অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেননি, ইতিহাসে এমন কনসার্ট এই প্রথম। এই কনসার্ট
অগণিত মানুষের সামনে তুলে ধরে সঙ্গীত আর শিল্পের শক্তি, যে শক্তি অতিক্রম
করে যায় অনেক রাজনৈতিক শক্তিকেও। নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে
উপস্থিত হওয়া বহু মার্কিন তরুণ-তরুণী দেখতে পান তাদের প্রিয়
সঙ্গীতশিল্পীরা তুলে ধরছেন মানবতা আর বর্বরতার পার্থক্য, আর তাঁরা সবাইকে
আহ্বান জানাচ্ছেন অসহায়, অত্যাচারিত মানুষের পাশে দাঁড়াবার জন্য যখন
তাদের দেশের সরকারকে বহু নিপীড়িত মা আর শিশুর ক্রন্দন স্পর্শ করছে না।
এই কনসার্ট তাই ছিল এক প্রতিবাদী কনসার্ট, মানবতা আর কল্যাণের পক্ষে আর অশুভত্ব আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক সাহসী কনসার্ট।
কনসার্টের
অর্থ যেখানে আনন্দ-উন্মাদনায় ভেসে যাওয়া, সেখানে সেই কনসার্ট বিশ্বের কোটি
মানুষের হৃদয়ের দুয়ারে পৌঁছে দিল অন্য এক অর্থ - মানবতার আর্তি। পৌঁছে
দিল ভিন্ন প্রান্তে কাঁদতে থাকা বিশ্ব ভাইয়ের ভালোবাসা! ‘কনসার্ট ফর
বাংলাদেশ’ - এর প্রশংসনীয় উদ্যোগ আর শুভত্ব পশ্চিমী রক আর পপ সঙ্গীত জগতে
জমে থাকা গ্লানি, বিষণ্ণতা আর মলিনতাকে অনেকখানি মুছে দেয়।
সঙ্গীতশিল্পীরা তাঁদের কর্তব্যবোধ, সাহস আর মহানুভবতার প্রমাণ তুলে ধরেন এই
কনসার্টটির মধ্য দিয়ে। মানবতার প্রয়োজনে, এক মহান উদ্দেশ্যে সঙ্গীত
ব্যবহারের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয় সেই দিন। বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পীরা
কেউ কেউ কয়েক হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে নিউ ইয়র্কে
আসেন এই কনসার্টে অংশ নিতে, বিনিময়ে কোন পারিশ্রমিক গ্রহণ করেননি তাঁরা।
এ
কনসার্টের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন বিখ্যাত বাঙ্গালি সঙ্গীতজ্ঞ পণ্ডিত
রবিশংকর। ১৯৬৫ সালে এক রাতে রবিশংকরের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল জর্জ হ্যারিসনের। জর্জ
বছর তিনেক সেতার নিয়ে অনুশীলন করেছিলেন তিনি পন্ডিত রবিশংকরের কাছে।
রবিশংকরের মাধ্যমেই
বাংলাদেশের সঙ্গে জর্জের আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৯৭১ সালে রবিশংকর বসবাস
করতেন ক্যালিফোর্নিয়ার হলিউডে। ভারতে বিপুলসংখ্যক মানুষের উদ্বাস্তু
হয়ে আসার খবর শুনে তিনি বাংলাদেশের প্রতি সহমর্মী হয়ে ওঠেন।
উদ্বাস্তুদের মধ্যে তাঁর অনেক দুঃসম্পর্কের আত্মীয়-পরিজনও ছিল। তিনি
তাদের, বিশেষ করে শিশুদের সাহায্য করতে উন্মুখ হয়ে ওঠেন । রবিশঙ্কর
বাংলায় ‘জয় বাংলা’সহ বেশ কিছু গান বাঁধেন। এমনকি তিনি অ্যাপেল রেকর্ড
থেকে একটি গানের অ্যালবামও বের করেন। কিন্তু সংকটের ভয়াবহতার
পরিপ্রেক্ষিতে এই রেকর্ড বিক্রি থেকে যে যৎসামান্য লাভ হয়, তা ছিল
নিতান্তই নগণ্য। ১৯৭১ সালের মে মাসে তিনি অনুধাবন করেন, বড় একটা কিছু করা
দরকার। বন্ধু জর্জ হ্যারিসনের কাছে তিনি একটি চ্যারিটি কনসার্টের
পরিকল্পনার কথা জানান। এই প্রসঙ্গে হ্যারিসনের স্ত্রী অলিভিয়া বলেছিলেন,
"জর্জের কাছে শুনেছি, একাত্তরে বাংলাদেশে গণহত্যা, ধ্বংস আর হানাহানি
বিপর্যস্ত করে তুলেছিল রবি শংকরকে। এ নিয়ে মনঃকষ্টে ছিল সে। অন্যদিকে নিজের
রেকর্ডিং নিয়ে ব্যস্ত ছিল জর্জ। সত্তরে বিটলস ভেঙে যাওয়ায় নতুন করে
ক্যারিয়ার গড়তে সে মনোযোগী হয়ে ওঠে। এ সময় রবিশংকর জানায়, বাংলাদেশের জন্য
তহবিল সংগ্রহে একটি কনসার্ট করতে চায়। এ উদ্যোগে সে জর্জকে পাশে পেতে চায়।
জর্জেরও মনে হলো, এ কাজে তার নিযুক্ত হওয়া উচিত। তার ডাকে অনেকে সাড়া
দেবে, একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোর মাঝামাঝি সময়ে ওই কনসার্ট আয়োজন সময়োপযোগী
ছিল। জর্জ তখন বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্রেস্টন, রিঙ্গো স্টার,
লিওন রাসেল, ওস্তাদ আলী আকবর, ওস্তাদ আল্লা রাখা ও রবি শংকরকে নিয়ে কনসার্ট
আয়োজন করে। ওই কনসার্ট দিয়েই বাংলাদেশের সঙ্গে জর্জের বন্ধন শুরু।"
হ্যারিসন
সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে যান। যদিও বছর খানেক হয় বিটলস ভেঙে গেছে, তবুও
তিনি জানতেন, তার পরও বিটলসের ভাবমূর্তিকে কাজে লাগানো যাবে। হ্যারিসন
স্মৃতিচারণা করে বলেন, জন লেননই তাঁকে বিটলসের ভাবমূর্তি কাজে লাগানোর কথা
জোর দিয়ে বলেন। পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে হ্যারিসন কাটিয়ে দেন সংগীতজ্ঞদের
তালিকা বানাতে। তিনি সবার সহানুভূতিও পেয়ে যান। নিউইয়র্কের ম্যাডিসন
স্কয়ার গার্ডেনে ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট কনসার্টের দিন নির্ধারিত হয়। দিনটি
ছাড়া আর কোনো খালি দিন ছিল না। কনসার্টের মহড়ার জন্য তাঁরা খুব একটা
সময়ও পাননি।
কনসার্টের তারিখ চূড়ান্ত হওয়ার পর বিভিন্ন
পত্র-পত্রিকা ও গণমাধ্যমে কনসার্ট নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালান হ্যারিসন ও
রবিশংকর। পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে কনসার্টের আয়োজন সম্পন্ন করে ফেলেন হ্যারিসন ও
রবিশংকর বন্ধুদ্বয়। তারপর নির্দিষ্ট দিনে ইউনিসেফের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়
শুরু হয় কনসার্ট।
বিটলস ভেঙে যাওয়ার পর এই অনুষ্ঠানই
ছিলো হ্যারিসনের সরাসরি অংশগ্রহণ করা প্রথম অনুষ্ঠান। এরিক ক্ল্যাপটনও এই
অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে প্রায় পাচ মাস পর কোনো সরাসরি অনুষ্ঠানে গান গান
এবং বব ডিলানও ১৯৬৯ সালের পর প্রথমবারের মতো শ্রোতা দর্শকদের সামনে আসেন।
|
কনসার্ট ফর বাংলাদেশ এর পোস্টার |
সবচেয়ে বেশি মাথাব্যথা ছিল সব শিল্পীদের
একসঙ্গে পাওয়া। জন লেনন, রিংগো স্টার, এরিক ক্ল্যাপটন, বব ডিলান, বিলি
প্যাটারসন, ও লেওন রাসেলসহ সে সময়কার রক গানের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রদের একত্র
করতে চেয়েছিলেন হ্যারিসন। কিন্তু কনসার্টের এক সপ্তাহ আগে লেনন এতে
অংশগ্রহণ করতে পারবেন না বলে জানিয়েছিলেন।
এরিক
ক্ল্যাপটনের এই কনসার্টে অংশগ্রহণ করা নিয়েও তৈরি হয়েছিল অনেক সংশয়।
ষাটের দশকের শেষ ভাগে রক সঙ্গীতের মন্থর সেই সময়ে ক্ল্যাপটনও হয়ে
পড়েছিলেন অনেকটা নির্জীব, প্রায় আড়াই বছর তিনি নিজেকে গুটিয়ে
রেখেছিলেন। সেই মানসিক অবস্থায় লন্ডন থেকে নিউ ইয়র্কে এসে কনসার্টে অংশ
নেয়া তাঁর জন্য সহজ ছিল না। কনসার্টের অল্প ক’দিন আগে জর্জ হ্যারিসন
অনেকটা উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন একজন গিটারিস্টের জন্য, বহু আগ্রহী গিটারিস্ট
সেই সময় এসে ভিড় জমায় অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার জন্য। জর্জ হ্যারিসন
মার্কিন গিটারিস্ট জেসি এড ডেভিস কে বেছেও নেন। তিনি ব্লুজ সঙ্গীতশিল্পী
তাজ মহল এর সাথে কাজ করেছেন, কাজ করেছেন জর্জ হ্যারিসন এবং জন লেননের
নিজস্ব অ্যালবামেও। কনসার্টে জেসি এড ডেভিস অন্যতম গিটারিস্ট হিসেবে অংশ
নেন। ক্ল্যাপটন এলেন এলেন ঠিক আগের দিন। তাও শেষ মহড়ায় অংশ নিতে পারলেন
না। তিনি হাজির হন কনসার্টের শব্দযন্ত্রগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সময়।
ক্ল্যাপটন সে সময় নেশার শিখরে অবস্থান করছেন। কনসার্টের এক ঘণ্টা আগে
হ্যারিসন দেখলেন, ক্ল্যাপটন অত্যন্ত বাজে অবস্থায় রয়েছেন। তিনি আসার পর
কেউ তাঁর জন্য হেরোইন খুঁজতে গেছেন। কনসার্টের পুরোটা সময় তিনি চোখই
খুলতে পারেননি, কিন্তু তাঁর গিটারে একবারও ছন্দপতন হয়নি। তিনি সত্যিই এক
অমিত প্রতিভাবান ব্যক্তি ছিলেন। পরবর্তীতে ক্ল্যাপটন বলেছেন, সেই সময় নিউ
ইয়র্কে যাওয়া তার জন্য অনেক কঠিন হলেও অন্যান্য সঙ্গীতশিল্পীরা যেভাবে
তাঁদের নিয়মিত কাজের বাইরে যেয়ে এই কনসার্টে অংশ নিয়েছেন, সেই
দৃষ্টান্তই তাকে উদ্বুদ্ধ করেছে বাড়তি প্রচেষ্টা ব্যয় করে এই কনসার্টে
অংশগ্রহণ করতে।
আরেকজন
বড় তারকা ছিলেন বব ডিলান। সংগত কারণেই হ্যারিসন তাঁকে মঞ্চে আনতে
চেয়েছিলেন। বিটলস ও বব ডিলানের মধ্যকার সাংগীতিক সম্পর্কের সূচনা ১৯৬০ এর
দশকের মধ্যপর্যায় থেকেই। ডিলান কনসার্টে অংশগ্রহণের ব্যাপারে কথা দিলেও
হ্যারিসন ঠিক নিশ্চিত হতে পারছিলেন না। প্রখ্যাত উডস্টক অনুষ্ঠানে তিনি
যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কনসার্টের এক দিন আগে ডিলান এসে উদয়
হলেন। বব ডিলান অনুষ্ঠানের আগের দিন ম্যাডিসন স্কোয়্যার গার্ডেনে এসে
চারদিকের বিশাল সব ক্যামেরা আর অসংখ্য মাইক্রোফোন দেখে অস্বস্তিতে পড়ে যান। তিনি জর্জ হ্যারিসনকে বলে ওঠেন, সেখানে তার পক্ষে গান গাওয়া সম্ভব নয়।
অনুষ্ঠানের দিন ডিলান দর্শকদের সামনে এসে না দাঁড়ানো পর্যন্ত জর্জ
হ্যারিসন সহ অন্যান্যরা সন্দেহে ছিলেন যে ডিলান আদৌ গান করতে আসবেন কী না।
জর্জ হ্যারিসন ব্যাডফিঙ্গার ব্যান্ডের পিট হ্যামকে সঙ্গে নিয়ে দর্শকদের
প্রচন্ড উল্লাসের মাঝে ‘হিয়ার কামস দ্য সান’ গানটি শেষ করার পর বার বার
পেছন ফিরে তাকান দেখার জন্য যে ডিলান স্টেজে উঠে আসছেন কী না। ডিলান
দর্শকদের সামনে এসে দাঁড়ান তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে, কিন্তু জর্জ হ্যারিসন
তাকে দেখেই বুঝতে পারেন যে তখনও ডিলানের ভীতি পুরোপুরি কাটেনি।
এমন বিশাল আয়োজন এই বিখ্যাত মিউজিশিয়ানদেরও মানসিক চাপে ফেলে দিয়েছিলো।
অনুষ্ঠানের আগে যখন জর্জ হ্যারিসনকে প্রশ্ন করা হয় এই অনুষ্ঠানের মূল
আকর্ষণ তিনিই হবেন, এই ব্যাপারে তিনি কেমন বোধ করছেন, তখন জর্জ হ্যারিসন
বলে ওঠেন ‘নার্ভাস’।
হ্যারিসনের
আহ্বানে সাড়া দিয়ে কনসার্টে অংশ নিতে আরো আসেন বিখ্যাত জার্মান
সঙ্গীতশিল্পী ক্লাউস ভুরম্যান, ড্রামার জিম কেল্টনার, গিটারিস্ট ডন
প্রেস্টন আর কার্ল রেডল, বৃটিশ রক ব্যান্ড ‘ব্যাডফিঙ্গার’-এর সব সদস্য, জিম
হর্নের নেতৃত্বে ‘হলিউড হর্নস’ দলের সদস্যরা এবং অন্যান্য আরো অনেক
সঙ্গীতশিল্পী যারা অনুষ্ঠানে কন্ঠ দিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের
নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ এর
মাধ্যমে যেন নতুন এক ইতিহাস উন্মোচন করা হল উপস্থিত ৪০ হাজার দর্শক তথা
বিশ্বের মানুষের কাছে।
প্রায় চল্লিশ হাজার দর্শক এর
সামনে নিউইয়র্ক এর সেই বিখ্যাত মেডিসন স্কয়ার গার্ডেনের মায়াভরা জায়গাটায়
সবাই যেন এক হয়ে গিয়েছিল আমাদের এই বাংলাদেশ নামক একটি ছোট্ট দেশের বিপদের
সময়টায়। সেই সময়ের কনসার্টে যারাই দর্শক হিসেবে অংশ নিয়েছিল তারা সবাই
আমাদের দেশের শুভ কামনার জন্যই জড়ো হয়েছিল।
কনসার্টের
বার্তা নিয়ে কোনো সংশয় ছিল না। 'বাংলাদেশ' শব্দটি ব্যবহার করে রবিশঙ্কর ও
জর্জ হ্যারিসন তাঁদের রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার করেন। এটি লক্ষণীয়,
তাঁরা ‘পূর্ব পাকিস্তান’ বা ‘পূর্ব বাংলা’র মতো নিরাপদ শব্দ ব্যবহার
করেননি। সংবাদ সম্মেলনে হ্যারিসন বলেন, অর্থের চেয়ে সচেতনতা অনেক জরুরি।
পরবর্তীকালে তিনি লেখেন, "আপনি আজ কাউকে খেতে দিতে পারেন, আগামীকাল সে
ক্ষুধার্ত হবে। কিন্তু যদি গণহারে মানুষ মারা পড়ে, তাহলে প্রথমে সেটা
বন্ধ করা উচিত।" সংবাদ সম্মেলনের আগে তথ্যমাধ্যমে এর যে প্রচার দেওয়া হয়,
তাতে কনসার্টের গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কনসার্টের টিকিট বিক্রির সংবাদ
সংগ্রহ করতে আসা একজন টিভি প্রতিবেদক বলেন, এই কনসার্ট পূর্ব পাকিস্তানের
গণহত্যার কারণে যে বিপুলসংখ্যক শিশু উদ্বাস্তু হয়েছে, তাদের ত্রাণের জন্য।
আবার অনেক ভক্ত বলেন, তাঁরা প্রকৃত অর্থেই পূর্ব পাকিস্তানের দাবির প্রতি
একাত্মতা জানাতে এখানে এসেছেন।
প্রথমে পরিকল্পনা ছিল, একটি কনসার্ট হবে। কিন্তু সেদিন এত বিপুল সাড়া
জাগিয়েছিল কনসার্টটি যে পরে অনুষ্ঠানসূচি ঠিক রেখে, একই দিনে আরও একটি
অনুষ্ঠান করতে হয়েছিল দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ-এর।
জর্জ
হ্যারিসন অনুষ্ঠানে হাজার হাজার শ্রোতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে শুরুতেই বলেন,
"ভারতীয় সংগীত আমাদের চেয়ে অনেক গভীর।" তারপর পণ্ডিত রবিশংকর ও ওস্তাদ আলী
আকবর খান এবং সহশিল্পীদের পরিচয় করিয়ে দেন। কনসার্টটির শুরুতেই পণ্ডিত
রবিশংকর এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, "প্রথম ভাগে ভারতীয় সংগীত থাকবে। এর
জন্য কিছু মনোনিবেশ দরকার। পরে আপনারা প্রিয় শিল্পীদের গান শুনবেন।
আমাদের বাদন শুধুই সুর নয়, এতে বাণী আছে। আমরা শিল্পী, রাজনীতিক নই। তবে
বাংলাদেশে আজ যে তীব্র যন্ত্রণা, বেদনা ও দুঃখের ঘটনা ঘটছে, আমাদের সংগীত
দিয়ে আমরা তা আপনাদের উপলব্ধি করাতে চাই। আমরা তাদের কথাও উপলব্ধি করাতে
চাই, যারা বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী হয়ে ভারতে এসেছে। বাংলাদেশের
পল্লিগীতির সুরের ভিত্তিতে আমরা বাজাব 'বাংলা ধুন'।" রবি শঙ্কর এই পর্বে
দর্শকদের ধুমপান না করতেও অনুরোধ করেন। তুমুল হাততালির মধ্য দিয়ে দর্শকরা
রবিশংকরের উদ্বোধনী বক্তব্যকে স্বাগত জানায়।
এর
পর তিন বিখ্যাত ভারতীয় শিল্পী অল্প কিছুক্ষণ তাঁদের বাদ্যযন্ত্রগুলির সুর
ঠিকঠাক করার পরপরই আবার শোনা যায় তুমুল হাততালি, বোঝা যায় পশ্চিমের এই
তরুণ দর্শকরা সিতার-সরোদ-তবলা-তানপুরার শব্দ কতোটা পছন্দ করেছে। রবি শঙ্কর
হাসতে হাসতে দর্শকদের উদ্দেশ্যে মাইকে বলে ওঠেন: "ইফ ইউ অ্যাপ্রিশিয়েট
দ্য টিউনিং সো মাচ, আই হোপ ইউ উইল এনজয় দ্য প্লেয়িং মোর!"
রবি
শঙ্কর, আলী আকবর খান, আল্লাহ্ রাখা আর তানপুরায় কমলা চক্রবর্তীর
অংশগ্রহণে বেজে ওঠে 'বাংলা ধুন'– বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতের এক অনন্য সুর।
বাংলার গ্রামের সবুজ প্রান্তরের সৌন্দর্য আর সারল্য ভরা জীবনের ছবি যেন
স্পষ্ট ভেসে ওঠে সঙ্গীতের মূর্ছনায় বাংলাদেশ থেকে বহু দূরে নিউ ইয়র্কের
এক ভিন্ন পরিবেশে। দর্শকরা মুগ্ধ হয়ে নীরবভাবে শোনেন সেই সুর, চোখের
সামনে দেখতে পান কী করে সিতার-সরোদ-তবলা-তানপুরা যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে এই
গুণী শিল্পীদের হাতের ছোঁয়ায়।
|
কনসার্টের প্রথম পর্বে ভারতীয় শিল্পীদের পরিবেশনা |
এরকমভাবে আরেকবার সুরের মূর্ছনা মন্ত্রমুগ্ধ
করে তোলে ম্যাডিসন স্কোয়্যার গার্ডেনের অসংখ্য দর্শককে অনুষ্ঠানের
দ্বিতীয় পর্বে, জর্জ হ্যারিসনের বিখ্যাত 'হোয়াইল মাই গিটার জেন্টলি উইপস'
গানটির সময়। এই গানের লীড গিটারের অংশটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, প্রয়োজন
ছিল এমন একজন গিটারিস্টের যিনি গিটারের সুরকে কিছুটা বিষাদমগ্ন আবার একই
সাথে আন্দোলিত আর অস্থির করে তুলতে পারবেন। এই কঠিন কাজটির দায়িত্ব সেদিন
পালন করেন এরিক ক্ল্যাপটন, আর যারা কনসার্টটি দেখেছেন তারা জানেন যে কতোটা
অসাধারণভাবে এরিক ক্ল্যাপটন সেদিন এই কঠিন কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন, এই
গানটির সময় তাঁর গিটারের সুরলহরী কতোটা স্পন্দনময় হয়ে উঠেছিল। 'হোয়াইল
মাই গিটার জেন্টলি উইপস' গানটির জন্য ক্ল্যাপটন ব্যবহার করেছিলেন একটি
সেমি-অ্যাকুউসটিক গিটার। কিন্তু এমন একটি গানের জন্য তিনি সঠিক গিটার
বাছেননি, পরে তিনি বলেছেন, তার উচিৎ ছিল একটি ফেন্ডার বা সলিড গিবসন গিটার
ব্যবহার করা। সেমি-অ্যাকুউসটিক গিটার বেছে নিয়ে তিনি নিজের জন্য কাজটা
অনেক বেশি কঠিন করে ফেলেছিলেন। কিন্তু এরিক ক্ল্যাপটনের মতো একজন শিল্পীর
পক্ষে যে কোন পরিস্থিতিতেই যে গিটারের সুরকে অসাধারণ আকর্ষণীয় করে তোলা
সম্ভব সেদিন তাঁর কাজ তাই প্রমাণ করে।
|
এরিক ক্ল্যাপটন |
জর্জ হ্যারিসন তাঁর বিভিন্ন বিখ্যাত গান
যেমন 'ওয়াহ্-ওয়াহ্', 'মাই সুইট লর্ড', 'বিওয়ের অফ ডার্কনেস' একে একে
পরিবেশন করেন। নিজের জনপ্রিয় গানগুলি নিয়ে বব ডিলান আসেন এরপর। হাজার
হাজার দর্শক উপভোগ করেন সেই দৃশ্য– ডিলান তাদের সামনে দাড়িয়ে গাইছেন
তাঁর বিখ্যাত গান 'ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড'। ডিলানের 'জাস্ট লাইক আ ওম্যান'
গানটির সময় গিটার হাতে তাঁর একপাশে দাড়ান জর্জ হ্যারিসন, আর অন্যপাশে
ক্লাউস ভুরম্যানের নানা-নকশা-আঁকা রঙীন বেস গিটারটি নিয়ে দাঁড়ান লিওন
রাসেল।
|
বব ডিলান |
কনসার্টে
হ্যারিসন আর ডিলানের গানের মাঝে শোনা যায় রিঙ্গো স্টারের কন্ঠে 'ইট ডোন্ট
কাম ইযি', আর পিয়ানোর সামনে চুপচাপ বসে থাকা লিওন রাসেল গেয়ে ওঠেন দ্রুত
তালের 'জামপিং জ্যাক ফ্ল্যাশ' গানটি। এই গানটির সময়ই সব মিউজিশিয়ানদের
সবচেয়ে বেশি উৎফুল্ল হতে দেখা গিয়েছিল। বিলি প্রেস্টন আর লিওন রাসেলের
পিয়ানো, বিভিন্ন ধরনের গিটার, রিঙ্গো স্টার আর জিম কেল্টনারের ড্রাম আর
বিভিন্ন হর্ন ইন্সট্রুমেন্টের মাধ্যমে পুরো কনসার্টে যে সঙ্গীত তৈরি করা
হয়, তা ছিল অদ্ভুত চিত্তাকর্ষক।
|
রিঙ্গো স্টার |
|
লিওন রাসেল |
|
বিলি প্রিস্টন |
ধীরে
ধীরে কনসার্টটি তার শেষ ভাগে চলে আসে। জর্জ হ্যারিসনের 'সামথিং' গানটির পর
সব মিউজিশিয়ানরা স্টেজের পেছনে চলে যান, কিন্তু কিছু পরই তাঁরা আবার ফিরে
আসেন। এবং তারপরই জর্জ হ্যারিসন গেয়ে ওঠেন এই অনুষ্ঠানের জন্য তাঁর
নিজের লেখা বিশেষ গান, 'বাংলাদেশ'। লিওন রাসেল তাঁকে বলেছিলেন গানটির
শুরুতে একটি ছোট ভূমিকা দেয়ার জন্য। জর্জ হ্যারিসন রাসেলের পরামর্শটি
পছন্দ করেছিলেন, এবং সেভাবেই গানটি শুরু হয়– 'মাই ফ্রেন্ড কেম টু মি, উইথ
স্যাডনেস ইন হিজ আইস, টোল্ড মি হি ওয়ানটেড হেল্প, বিফোর হিজ কান্ট্রি
ডাইজ …"।
|
'বাংলাদেশ' গানটির অরিজিনাল স্ক্রিপ্ট |
হ্যারিসন শেষ করেন 'বাংলাদেশ বাংলাদেশ'
দিয়ে। ওই গানটিই ছিল যথেষ্ট। যদিও হ্যারিসনের গানের 'বাংলাদেশকে রেহাই
দাও' অন্তরাটি কয়েকবার ছিল, হ্যারিসন গানটি শুরু করেন তাঁর বন্ধুর
প্রতিবেশী দেশকে উদ্দেশ্য করে, 'যেখানে বহু মানুষ মারা পড়ছে তো পড়ছেই'।
এতে দর্শকেরা চট করে বুঝে যান যে বাংলাদেশের সমস্যা শুধু রাজনৈতিক নয়, এটা
মানবিক বিয়োগান্তক ব্যঞ্জনায়ও গভীর।
|
জর্জ হ্যারিসন |
কনসার্টের সফলতা ছিল রবিশঙ্কর ও হ্যারিসনের
কল্পনারও বাইরে। তাঁরা ভেবেছিলেন, এ থেকে ২০ হাজার ডলারের মতো উঠবে। কিন্তু
কনসার্ট শেষে আয় দাঁড়ায় প্রায় আড়াই লাখ ডলার। ইউনিসেফের মাধ্যমে এ
অর্থ ত্রাণের কাজে ব্যয় করা হয়। এই কনসার্টের বাণী এর ভেন্যুকে ছাড়িয়েও
ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। সংবাদপত্রে তো ছবি ছাপা হয়ই, বিশ্বের
বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সেটা সম্প্রচারিত হয়। এরপর তিনটি ক্যাসেটের একটি
বাক্সবন্দী অ্যালবাম বেরোয়, শিগগিরই তা সারা দুনিয়ায় তালিকার শীর্ষে চলে
আসে। অ্যালবামের মূল প্রচ্ছদে একটি রোগা শিশুর শূন্য থালা সামনে নিয়ে বসে
থাকার ছবি ছিল। ছবিটি মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রতিমূর্তি হয়ে ওঠে।
অ্যালবামে যে নোট ছিল, তাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে একটি 'পরিকল্পিত
সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম' ও হিটলার কর্তৃক ইহুদি নিধনের পর সবচেয়ে জঘন্য ও
নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করা হয়।
|
কনসার্ট ফর বাংলাদেশ অ্যালবাম এর সিডির কভার |
এই
কনসার্ট সেই প্রজন্মের অনুভূতিকে নাড়া দিতে পেরেছিল। জনগণের ওপর এর
প্রভাব কত গভীর ছিল, তা পাকিস্তান সরকারের প্রতিক্রিয়া দেখেই বোঝা যায়।
পাকিস্তান সরকার তার সব দূতাবাসকে এই বলে সতর্ক করে দেয় যে এতে
'পাকিস্তানবিরোধী প্রচারণা রয়েছে'। সঙ্গে সঙ্গে এও বলে দেয় যে তাদের সব
রকম যোগাযোগের মাধ্যমে এর 'সম্প্রচার বন্ধ করে দিতে হবে'। সংগত কারণেই এর
রেকর্ড পাকিস্তানে সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করা হয়।
দ্য
কনসার্ট ফর বাংলাদেশ-এর পর দেশে দেশে মানবতার কল্যাণে কত বড় বড় কনসার্ট হলো
দুনিয়া ভর। কিন্তু সেসবেরই পথিকৃৎ হয়ে আছে ৪০ বছর আগের দ্য কনসার্ট ফর
বাংলাদেশ। ২০০৫ সালে নতুন করে প্রকাশিত হয়েছে দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ
অ্যালবামের ডিভিডি। দুটি ডিভিডির একটি সুদৃশ্য সেট এখনো পাওয়া যায়। এর
সঙ্গে যুক্ত ছিলেন অলিভার হ্যারিসন। একটি সিডিতে রয়েছে পুরো গানের
অনুষ্ঠান। আরেকটি সিডিতে রয়েছে শিল্পী-কলাকুশলীদের সাক্ষাৎকার, যাতে
কনসার্টটি আয়োজনের নেপথ্য কাহিনি তুলে ধরা হয়েছে। আরও আছে মহড়ার কিছু
চিত্র ও গান। এর সঙ্গে আছে একটি সচিত্র পুস্তিকা। এই নতুন ডিভিডির
ভূমিকায় পণ্ডিত রবিশংকর বলেছেন, ৭৫ বছরের সংগীতজীবনে যত কনসার্ট করেছেন,
তার মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় হয়ে আছে ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের ওই কনসার্টটিই। নতুন ডিভিডিতে সাক্ষাৎকারে এরিক ক্ল্যাপটন বলেছেন, "এ অনুষ্ঠান সারা
জীবনের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সংগীতশিল্পী হওয়াটা যে গর্বের একটা বিষয়,
তা সেই মুহূর্তে বুঝেছিলাম।" রিঙ্গো স্টার বলেন, "অনুষ্ঠানটি যেন অনন্য
সাজে সেজেছিল। দর্শক-শ্রোতার উপস্থিতি ছিল বিশাল।"
২০০৫
সালে পুনঃপ্রচারিত দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ ডিভিডি উপলক্ষে সঙ্গে প্রকাশিত
পুস্তিকায় ইউএসএ ফান্ড ফর ইউনিসেফের সভাপতি চার্লস জে. লিওনসের লেখা থেকে
জানা যায়, কনসার্টের টিকিট বিক্রি থেকে সংগ্রহ হয়েছিল প্রায় আড়াই লাখ ডলার।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত তিনটি রেকর্ডসহ অ্যালবাম এবং ১৯৭২ সালের
মার্চের কনসার্ট নিয়ে তৈরি ফিল্ম থেকে আয় নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়। পরবর্তী
দশকগুলোতে এসব অর্থ দান করা হয় ইউনিসেফ পরিচালিত শিশুদের কল্যাণমূলক
তহবিলে।
অর্থ
প্রদানের চেয়েও অনেক বেশি সহায়তা করা হয় এই কনসার্টের মধ্য দিয়ে
বাংলাদেশ আর এই দেশের মানুষের ওপর ঘটতে থাকা অন্যায় এর বিরুদ্ধে পশ্চিমী
বিশ্বে বিশেষ করে তরুণদের মাঝে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে।
জর্জ হ্যারিসন যেমন বলেছিলেন, "অর্থ নয়, বরং গণমানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি
করাই হবে আমাদের মূল লক্ষ্য, কারণ যতো টাকাই আমরা তুলি না কেন তা দিয়ে তো
আর বাংলাদেশের বর্তমান সমস্যার সমাধান করা যাবে না।" এই কনসার্ট, আর
অসাধারণ আবেগ নিয়ে গাওয়া জর্জ হ্যারিসনের 'বাংলাদেশ' গানের মধ্য দিয়ে
রাতারাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের নাম। বাংলাদেশকে কেন সমর্থন
দেয়া জরুরি এই বক্তব্যটিই বহু মানুষের কাছে পৌঁছে যায় এই অনুষ্ঠানটির
মধ্য দিয়ে। যে কিংবদন্তী-প্রতিম সঙ্গীতশিল্পীদের গান মুগ্ধ করে রেখেছিল
কোটি কোটি ভক্তদের, বাংলাদেশের জন্য সেই সঙ্গীতশিল্পীদের সমবেত হওয়ার
শক্তি ১৯৭১ সালের পহেলা আগস্টের পর থেকে যুক্ত হয় বাংলাদেশর মানুষের
মুক্তিসংগ্রামের সাথে। ইতিহাস হয়ে থাকা সেই কনসার্টটির ৪৩ বছর পূর্তির এই
দিনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি সেদিন সেই অনুষ্ঠানটিকে সফল করে তোলার জন্য
পরিশ্রম করা প্রতিটি মানুষকে।
কনসার্ট ফর বাংলাদেশ এর কিছু ভিডিওঃ
কৃতজ্ঞতাঃ
লেখাঃ লাল লোহিত