ষোলোই ডিসেম্বর বিকেলের দিকে হঠাৎ সাড়া পড়ে গেল ক্যাম্পে। প্রথমে ফিসফাস গুঞ্জন, তারপর সবাই বলতে থাকে, 'স্বাধীন! স্বাধীন! স্বাধীন হয়ে গেছি আমরা!!' ঢাকা থেকে খবর এসেছে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে আজই, রেসকোর্স ময়দানে। চলো চলো, ঢাকা চলো সবাই।
ঝটপট প্রস্তুত হলাম আমরা। কাপড়ের ব্যাগটা কাঁধে নিলাম। বেড়ার গায়ে হেলান দিয়ে রাখা অস্ত্রগুলো সরিয়ে ফেলা হলো। ওগুলো আমরা সঙ্গে নেব না। যে খবর এসেছে তা কতটুকু সত্যি কে জানে? গত কদিন ধরে সত্যি-মিথ্যা নানারকম কথা শোনা যাচ্ছে।
এই খবরটাই বা কতটা সত্যি কে বলবে? তাই ঢাকা শহরে প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে সিদ্ধান্ত হলো ব্যাগের মধ্যে দুটো স্টেনগান আর কয়েকটা গ্রেনেড নেওয়া হবে, যাতে প্রয়োজনে ব্যবহার করা যায়।
ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে রওনা দিলাম আমরা। হাফিজ ভাই, মিনি মুজিব ভাই, আমি, মঞ্জু এবং আরও দু'জন- এই ছয় জন এক দলে। হাফিজ ভাই দলের নেতা। তার বন্ধু মুজিব ভাই বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ খুব ভালো নকল করতে পারে, তাই বন্ধুরা তাকে ডাকে 'মিনি মুজিব।'
ছয়জনের দলটা হনহনিয়ে চলেছে গ্রামের পথে। দুপাশে হলুদ কার্পেটের মতো সর্ষের ক্ষেত। তার উপর এসে পড়েছে ডিসেম্বরের শেষ বিকেলের নরম রোদ। সর্ষের উজ্জ্বল রঙ আর সূর্যের সোনালী আভা মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। সূর্য দ্রুত নেমে যাচ্ছে দিগন্তের দিকে। অন্ধকার গাঢ় হয়ে নেমে আসার আগেই আমরা বুড়িগঙ্গা পার হতে চাই।
কিছুদূর যাওয়ার পরই দেখা গেল উল্টো দিক থেকে পাঁচ-সাতজনের একটা দল আসছে আমাদের দিকে। ততক্ষণে শীতের সন্ধ্যা গাঢ় হয়ে নেমেছে। দলটা খুব কাছে আসার পর বোঝা গেল ওরা সশস্ত্র। প্রত্যেকের হাতে থ্রি-নট-থ্রি। আমাদের দিকে তাক করে আছে। কাছাকাছি আসতেই ওদের দলের সামনের লোকটা চিৎকার করে উঠলো, 'হ্যান্ডস আপ!'
আমরা বোকার মতো হাত তুলে দাঁড়িয়ে গেলাম। ওরা আমাদের কোনো ক্ষতি না করে পাশ দিয়ে হনহনিয়ে চলে গেল উল্টো দিকে।
দলটা একটু দূরে যেতেই হাফিজ ভাই চরম বিরক্তির সাথে বললো, 'মুজিব... স্টেন দুটো বের কর্। আর গ্রেনেডগুলো হাতে হাতে দিয়ে দে। এরা রাজাকার, পালিয়ে যাচ্ছে। রাজাকাররা আমাদের হ্যান্ডস আপ করলো! অসহ্য!!'
বাজারের ব্যাগ থেকে বের হলো স্টেনগান, গ্রেনেডগুলো বিলি করা হলো। আবার এগিয়ে চললো দলটা। এবার আর হাঁটছি না আমরা, দু'পকেটে দুটো করে গ্রেনেড নিয়ে ছুটে চলেছি। দূরে রাস্তার ধারে নতুন টিনের কয়েকটা ঘর। সেখান থেকে গুলির শব্দ ভেসে এলো। রাইফেলের সিঙ্গেল শট, থেকে থেকে স্টেনগান আর কারবাইনের ব্রাশ ফায়ার।
একটু এগোতেই বোঝা গেল ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করছে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা দল- উল্লাস করছে, আনন্দ করছে, আকাশের দিকে গুলি ছুঁড়ছে। ভেসে আসছে 'জয় বাংলা' চিৎকার। ওদের সঙ্গে কুশল বিনিময় হলো আমাদের। আনন্দে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরলাম। পাগলের মতো চ্যাঁচাচ্ছে সবাই- 'স্বাধীন! স্বাধীন!! আমরা স্বাধীন!!!'
ওদের নেতার সঙ্গে কথা বলছিলেন হাফিজ ভাই। এখনি আবার রওনা দেব আমরা। বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে আছি, চারপাশে ঘর। দক্ষিণ দিকের ছোট একটা ঘরে জানলার শিক ধরে দাঁড়িয়ে ছিল কয়েকজন যুবক। ওদের ওখানে আটকে রাখা হয়েছে। জানালায় মুখগুলো দেখা যাচ্ছে শুধু। হঠাৎ সেখান থেকে কে যেন কাঁদো কাঁদো গলায় ডাক দিল, 'মঞ্জু ভাই!'
মঞ্জু চমকে তাকালো ওদিকে, দুপা এগিয়ে গিয়ে অবাক গলায় বললো, 'আরে নবী... ! তুই এখানে কি করছিস?'
জানা গেল ওর নাম নবী হোসেন, বলাকা সিনেমা হলের ব্ল্যাকার। টিকিট ব্ল্যাক করতো। সে রাজাকারের খাতায় নাম লিখিয়েছে, মাসিক আশি টাকার লোভে। মঞ্জু জানালো ও নবীকে চেনে। রাজাকার হলেও সে কারো ক্ষতি করেনি। বরং বিপদের সময় নীলক্ষেত এলাকায় উপকার করেছে দু'একজনের। মঞ্জুর অনুরোধে নবীকে ছেড়ে দেওয়া হলো। ছাড়া পেয়ে ছুটে পালালো নবী।
পালানোর আগে খুব কাছে থেকে রাজাকার ছেলেটাকে একনজর দেখলাম আমি। আমাদেরই বয়সি এক তরুণ, অথচ যোগ দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শিবিরে। কেন? কি কারণে সে পাকবাহিনীর দোসর হয়েছে? শুধুই মাসিক আশি টাকার লোভে? নাকি অন্য কোনো কারণ আছে - আদর্শগত কোনো কারণ? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন নবীকে রাজাকার বানিয়েছে কারা? এতসব প্রশ্ন অবশ্য সেই সময় এভাবে গুছিয়ে আমার মাথায় আসেনি। এসেছে অনেক পরে।
সেদিন অন্য দলের ছেলেদের কাছে বিদায় নিয়ে আমরা আবার পথে নেমেছিলাম। দৌড়াতে দৌড়াতে বুড়িগঙ্গার পাড়ে এসে দেখা গেল একটা নৌকাও নাই। জনহীন নদীর তীর। নৌকা নাই, মাঝি নাই, পার হবো কিভাবে? শেষমেশ বহু খোঁজাখুঁজির পর নৌকা এবং মাঝি পাওয়া গেল।
কোনাকুনি নদী পাড়ি দিচ্ছে মাঝি। অন্ধকার রাত। কালো জলে ছপাস ছপাস দাঁড়ের শব্দ। নদী পাড়ি দিয়ে যেখানে নৌকা ভিড়ালো মাঝি, সেখানেই এক বাড়িতে থাকতো অবাঙালী তিনজন শার্প শুটার। তাদের গুলি এড়িয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঝি ঠিকই আমাদের পৌঁছে দিল এপারে।
সারারাত জিপে করে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি শেষে পাগলের মতো জয় বাংলা চিৎকার দিতে দিতে গলা ভেঙে শেষরাতে লালকুঠিতে আমরা ক্যাম্প করলাম। লালকুঠিতে ছিল পাক আর্মির ঘাঁটি। যাবার সময় ওরা তাড়াহুড়ায় এখানে ওখানে গ্রেনেড, অস্ত্রশস্ত্র ফেলে গেছে। সোফার গদির নিচে আমি পেয়ে গেলাম একটা চাইনিজ স্টেন আর গোটা তিনেক ম্যাগাজিন।
এদিকে পূবের আকাশ ফরশা হতে শুরু করেছে। কারো চোখে ঘুম নাই। আমরা কয়েকজন লালকুঠির ছাদে উঠে গেলাম। কি মিষ্টি বাতাস! দক্ষিণে নদী বুড়িগঙ্গা। নদীর উপরে লাফিয়ে উঠলো লাল বলটা - বাংলাদেশের প্রথম সূর্য! এত লাল!
কে যেন প্রথম জয় বাংলা চিৎকার দিয়ে গুলি ছুঁড়লো আকাশের দিকে। তারপর সবাই। আমিও আমার সদ্য কুড়িয়ে পাওয়া স্টেনগানের ম্যাগাজিন খালি করে ফেললাম।
তারপর...শুরু হলো পথ চলা। নতুন পথে।
লিখেছেনঃ
Motazid Momtaz Khurram