![]() |
![]() |
পঁচিশে মার্চের কালরাত্রিতে দেশেই ছিলেন মতিউর। অপারেশন সার্চলাইটের বিভীষিকার সাক্ষী হলেন অবাক বিস্ময়ে। তবে চুপ করে থাকেননি তিনি। নিজ জেলা নরসিংদীতে স্থানীয় জনতাকে নিয়ে জনসভা করলেন তিনি, গেলেন ভৈরববাজার পর্যন্ত। সবাইকে এক থাকতে বললেন। বুঝতে পারছিলেন, এভাবে কিছু হবে না। অস্ত্র লাগবে, গুলি লাগবে। নইলে সশস্ত্র পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে টিকে থাকা যাবে না। তখনই মনে মনে পরিকল্পনা করলেন কিছু একটা।
সেই কিছু একটা কি? ইতিহাস জানবে, একজন অদম্য সাহসী বাঙ্গালী পাকিস্তানের এক বিমানঘাঁটি থেকে যুদ্ধবিমান ছিনতাই করে দেশে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন, নিজের জীবন বাজী রেখে। হলিউডের র্যাম্বো টাইপের নায়কদেরও কি এতো সাহস থাকে? আমাদের র্যাম্বো নেই, জেমস বন্ড নেই, আমাদের একজন মতিউর রহমান ছিলেন। যার নখের সমান যোগ্যতাও হাজারটা র্যাম্বো বা বন্ডের হবে না।
২০শে আগস্ট, ১৯৭১, শুক্রবার। আজ থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর আগের কথা। সকাল এগারোটার কিছু বেশী। মতিউর তখন করাচীর মৌরিপুর বিমানঘাঁটিতে কর্মরত। পাকিস্তানীরা বাঙ্গালীদের এক বিন্দুও বিশ্বাস করতো না, আর তাই ফ্লাইট লেফট্যানেন্ট মতিউরকে জোর করে বসিয়ে দেয়া হয়েছিলো ফাইলপত্রের ভীড়ে। কিন্ত মতিউর সুযোগের সন্ধানে থাকেন, কখন ভাগ্য সুপ্রসন্ন হবে।
সেদিন সকালেই বছর বিশেকের তরুণ পাইলট রশীদ মিনহাজের আকাশে ওড়ার কথা, একটি টি-৩৩ জঙ্গী বিমান নিয়ে। প্র্যাকটিস ফ্লাইট, ঘন্টাখানেকের সেশান। রশীদ পাঞ্জাবী, এখনও প্রশীক্ষন চলছে। বিমানে উঠে ইঞ্জিন স্টার্ট দিলেন তিনি। প্রপেলার ঘুরতে শুরু করেছে, এমন সময় রশীদ খেয়াল করলেন, বাঙ্গালী ফ্লাইট লেফট্যানেন্ট মতিউর পেছনে ইঙ্গিতে কিছু একটা দেখাচ্ছেন। সম্ভবত ইঞ্জিনের গণ্ডগোল টাইপের কোন সমস্যা। ইঞ্জিন চালু রেখেই মুখের মাস্ক খুললেন রশীদ। শিকারী বেড়ালের মতো এগিয়ে এলেন মতিউর রহমান। এরকম একটা সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন এতোদিন। তাঁর স্বপ্নীল চোখে তখন স্বাধীন দেশের মানচিত্র ভাসছে। হাতে ক্লোরোফর্ম মাখা রুমাল। রশীদকে কিছু বোঝার সুযোগ না দিয়েই তার মুখে সেটা চেপে ধরলেন মতিউর। তবে চতুর রশীদ জ্ঞান হারানোর আগেই বিপদসঙ্কেতের সুইচে চাপ দিলেন। প্লেনে উঠে এলেন মতিউর। রশীদের অজ্ঞান দেহটা ধাক্কা দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন পেছনের সিটে। ইঞ্জিন স্টার্ট দেয়াই আছে। থ্রটল চেপে ধরলেন তিনি।
মিনিটখানেকের মধ্যেই আকাশে উড়লো টি-৩৩ বোমারু বিমানটা। মতিউর তখনও জানেন না, মিনিট পাঁচেক পরেই তাঁকে আটকানোর জন্যে একই ঘাঁটি থেকে আরো চারটি বিমান উড়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মতিউর রহমান দেখতে পেলেন বিমানগুলোকে, দৃষ্টিসীমায় চলে এসেছে। ভয় পাবেন আমাদের মতিউর? অনেকেই জানেন না, ইরানের রানী ফারাহ দিবার সম্মানে পেশোয়ারে অনুষ্ঠিত বিমান মহড়ায় ছয়টি বিমানের একটির পাইলট ছিলেন মতিউর রহমান, একমাত্র বাঙ্গালী পাইলট, যিনি এই বিরল সম্মান অর্জন করেছিলেন নিজ পেশাগত যোগ্যতায়। এসব বিমানকে ফাঁকি দিয়ে ভারতের আকাশসীমায় প্রবেশ করাটা মতিউরের জন্যে দুধভাত। আর বেশী দেরীও নেই। মাইল চল্লিশেক পরেই ভারতের সীমানা শুরু। পাঁচ মিনিটের ব্যাপার।
![]() |
ভারতের সীমান্ত থেকে পঁয়ত্রিশ মাইল দূরে আছড়ে পড়ে মতিউরের দেহ। আর সেখান থেকে আধমাইল দূরেই রশীদকে নিয়ে বিদ্ধ্বস্ত হয় বিমানটি। শহীদ হলেন মতিউর রহমান, যিনি একটি জাতির স্বাধীনতার জন্যে নিজের প্রাণ উৎসর্গ করে শত্রুর গুহা থেকে বিমান ছিনতাই করতে গিয়েছিলেন। শুধু কি নিজের জীবন? স্ত্রী মিলি আর একমাত্র কণ্যাশিশুটি তখন করাচীর এয়ারফোর্স অফিসার্স কোয়ার্টারে। মতিউর তো তাঁদের কথাও ভাবেননি। তিনি সবার আগে বেছে নিয়েছিলেন জন্মভূমিকে, স্বাধীনতাকে। আর তাই দেশের তরেই তাঁর এই বিশাল আত্নত্যাগ।
রশীদ মিনহাজকে পাকিস্তান সরকার ভূষিত করে সর্বোচ্চ সামরিক সম্মানে, আর তড়িঘড়ি করে মতিউরের লাশ দাফন করা হয় মাশরুর এয়ারবেজের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের কবরস্থানে। যে কবরের গায়ে লেখা ছিলো- “এখানে শুয়ে আছে এক বেইমান!!”
স্বাধীন বাংলাদেশ তার বীর সন্তানের অবদানকে ভুলে যায়নি। মতিউরকে ভূষিত করা হয় বীরশ্রেষ্ঠ সম্মানে, তিনি বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান। তবে স্বদেশের বুকে শেষ শয্যা পাতার জন্যে তাঁর অপেক্ষার দিনগুলো শেষ হয় আরো পঁয়ত্রিশ বছর পর। ২০০৬ সালের তেইশে জুন, বীরশ্রেষ্ঠ মতিউরের দেহাবশেষ ফিরিয়ে আনা হয় এই বাংলার মাটিতে, যে বাংলাদেশের জন্যে তিনি নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন নিঃশঙ্ক চিত্তে। শহীদ বুদ্ধিজীবি কবরস্থানে পুর্ন সামরিক মর্যাদায় দাফন করা হয় তাঁকে।
শুভ জন্মদিন বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান, আমাদের সুপারহিরো! আমরা একজন মতিউর কিংবা সাত বীরশ্রেষ্ঠের বীরত্বকে মনে রাখি না, আমাদের মাথায় থাকে সেলুলয়েডের রূপালী পর্দায় নকল মারামারি করে শরীর প্রদর্শন করা নায়কেরা। আমরা ভুলে যাই আমাদের রিয়াল লাইফ হিরোদের, আমাদের স্বাধীনতার কাণ্ডারীদের, যাদের আত্নত্যাগে রচিত হয়েছে বাংলাদেশ নামের মহাকাব্যের একেকটি পংক্তি।
Post a Comment Blogger Facebook
Click to see the code!
To insert emoticon you must added at least one space before the code.