![]() |
১০ মার্চ, ১৯৭১, বুধবার
স্বাধিকার-স্বাধীনতা
নিয়ে চেয়ারে বসে বাক-বিতণ্ডার লড়াই চলছেই। সাতদিন বাইরে বাইরে ঘুরে, রুমী
এখন দেখি, ক’দিন বাড়িতেই বন্ধু-বান্ধব নিয়ে খাবার টেবিল গুলজার করে রাখছে
ঘন্টার পর ঘন্টা। এতে আমার আর সুবহানের খাটনি বেশি হয় বটে-দফায় দফায়
চা-নাশতার সাপ্লাই দেয়া চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু আমার প্রাণটা থাকে
ঠান্ডা। হৈহল্লা, বাড়িঘর লন্ডভন্ড-যা করছে করুক, অন্তত চোখের সামনে তো
রয়েছে। রুমী বাইরে গেলেই আমার প্রাণটা যেন হাতে কাঁপতে থাকে। জীবন আর
মৃত্যুর মাঝখানে একটা গুলির ব্যবধান মাত্র, কখন আচমকা কোনদিন থেকে তীক্ষ্ণ
শিসে ছুটে আসে, কে বলতে পারে!
“সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ।” জামীর করার কিছু নেই। রুমীর চেয়ে সাড়ে তিন বছরের ছোট হওয়ার অপরাধে তার মিটিং-মিছিলে যাওয়ারও অনুমতি নেই। রুমীদের আলাপ আলোচনায় সর্বক্ষণ তাল দেবার মতো বয়স-বিদ্যা কিছুই এখনো হয় নি। তাছাড়া রুমীর বেশির ভাগ বন্ধু রুমীর চেয়ে বয়সে দু’তিন-চার বছরের বড়। পড়েও তার চেয়ে দু’তিন ক্লাস ওপরে। রুমীদের আলাপ-আলোচনার পরিধির মধ্যে পড়ে কার্ল মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, মাও-সে-তুং। এসবের মধ্যে জামী দাঁত ফোটাতে পারে না। কেবল চে গুয়েভারার কথা উঠলে সে লাফিয়ে এসে বসে।
জামীর বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র টাট্টুকেই দেখি বেশির ভাগ আসতে-যদিও সে থাকে সবচেয়ে দুরে-গুলশানে। অন্য বন্ধুদের পাত্তা নেই-নিশ্চয়ই তাদের মায়েরা বেরোতে দেয় না। টাট্টুর একটা সুবিধে আছে, তার বাবা-মা আমাদের পারিবারিক বন্ধু। কাজেই টাট্টু এ বাড়িতে আসবার আবদার ধরলে তার বাবা-মা, তাকে গাড়ি দিয়ে পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হন। এদিক থেকেও একই কাহিনী। জামী আবদার ধরলে আমরা তাকে গাড়ি করে গুলশানে পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হই। টাট্টু-জামীর ভাবখানা এই মিটিং-মিছিলে যখন যেতে দেবেই না, অন্তত দু’বন্ধুতে মেলামেশা করতে দাও!
ছেলে-ছোকরারা স্বাধীনতা-স্বাধিকারের তর্কে একমতে আসতে পারছে না- ওদিকে আশি বছরের বৃদ্ধ ভাসানী গতকালকার পল্টন ময়দান মিটিংয়ে স্বাধীনতার দাবি ঘোষণা করে বসে আছেন। গতকাল বিকেল তিনটেয় পল্টন ময়দানে ‘স্বাধীন বাংলা আন্দোলন সমন্বয় কমিটি’র উদ্যোগে যে জনসভা হয়, তাতে সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী। তিনি বলেন: “বর্তমান সরকার যদি ২৫ মার্চের মধ্যে আপসে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা না দেয় তাহলে '৫২ সালের মত মুজিবের সঙ্গে একযোগে বাংলার মুক্তিসংগ্রাম শুরু করব।”
ভাসানীর বক্তৃতার একটি কথা আমার মনে খুব দাগ কেটেছে। তিনি বলেছেন, “পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার চেয়ে বাংলার নায়ক হওয়া অনেক বেশি গৌরবের।” মহাকবি মিল্টন-এর অমর মহাকাব্য ‘প্যারাডাইজ লস্ট’-এর সেই বিখ্যাত পঙক্তি মনে পড়ল-“ইট ইজ বেটার টু রেইন ইন হেল দ্যান সার্ভ ইন হেভন।” স্বর্গে গোলামি করার চেয়ে নরকে রাজত্ব করা অনেক ভালো।
ব্যাঙ্কে টাকা তোলার আবার নতুন সময় করা হয়েছে- নয়টা-বারোটা। এখন থেকে শেখ মুজিবের নির্দেশে তাজউদ্দিন মাঝে মাঝে খবরের কাগজে বিভিন্ন বিষয়ে নির্দেশ দিতে থাকবেন।
- শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বই থেকে
“সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ।” জামীর করার কিছু নেই। রুমীর চেয়ে সাড়ে তিন বছরের ছোট হওয়ার অপরাধে তার মিটিং-মিছিলে যাওয়ারও অনুমতি নেই। রুমীদের আলাপ আলোচনায় সর্বক্ষণ তাল দেবার মতো বয়স-বিদ্যা কিছুই এখনো হয় নি। তাছাড়া রুমীর বেশির ভাগ বন্ধু রুমীর চেয়ে বয়সে দু’তিন-চার বছরের বড়। পড়েও তার চেয়ে দু’তিন ক্লাস ওপরে। রুমীদের আলাপ-আলোচনার পরিধির মধ্যে পড়ে কার্ল মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, মাও-সে-তুং। এসবের মধ্যে জামী দাঁত ফোটাতে পারে না। কেবল চে গুয়েভারার কথা উঠলে সে লাফিয়ে এসে বসে।
জামীর বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র টাট্টুকেই দেখি বেশির ভাগ আসতে-যদিও সে থাকে সবচেয়ে দুরে-গুলশানে। অন্য বন্ধুদের পাত্তা নেই-নিশ্চয়ই তাদের মায়েরা বেরোতে দেয় না। টাট্টুর একটা সুবিধে আছে, তার বাবা-মা আমাদের পারিবারিক বন্ধু। কাজেই টাট্টু এ বাড়িতে আসবার আবদার ধরলে তার বাবা-মা, তাকে গাড়ি দিয়ে পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হন। এদিক থেকেও একই কাহিনী। জামী আবদার ধরলে আমরা তাকে গাড়ি করে গুলশানে পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হই। টাট্টু-জামীর ভাবখানা এই মিটিং-মিছিলে যখন যেতে দেবেই না, অন্তত দু’বন্ধুতে মেলামেশা করতে দাও!
ছেলে-ছোকরারা স্বাধীনতা-স্বাধিকারের তর্কে একমতে আসতে পারছে না- ওদিকে আশি বছরের বৃদ্ধ ভাসানী গতকালকার পল্টন ময়দান মিটিংয়ে স্বাধীনতার দাবি ঘোষণা করে বসে আছেন। গতকাল বিকেল তিনটেয় পল্টন ময়দানে ‘স্বাধীন বাংলা আন্দোলন সমন্বয় কমিটি’র উদ্যোগে যে জনসভা হয়, তাতে সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী। তিনি বলেন: “বর্তমান সরকার যদি ২৫ মার্চের মধ্যে আপসে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা না দেয় তাহলে '৫২ সালের মত মুজিবের সঙ্গে একযোগে বাংলার মুক্তিসংগ্রাম শুরু করব।”
ভাসানীর বক্তৃতার একটি কথা আমার মনে খুব দাগ কেটেছে। তিনি বলেছেন, “পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার চেয়ে বাংলার নায়ক হওয়া অনেক বেশি গৌরবের।” মহাকবি মিল্টন-এর অমর মহাকাব্য ‘প্যারাডাইজ লস্ট’-এর সেই বিখ্যাত পঙক্তি মনে পড়ল-“ইট ইজ বেটার টু রেইন ইন হেল দ্যান সার্ভ ইন হেভন।” স্বর্গে গোলামি করার চেয়ে নরকে রাজত্ব করা অনেক ভালো।
ব্যাঙ্কে টাকা তোলার আবার নতুন সময় করা হয়েছে- নয়টা-বারোটা। এখন থেকে শেখ মুজিবের নির্দেশে তাজউদ্দিন মাঝে মাঝে খবরের কাগজে বিভিন্ন বিষয়ে নির্দেশ দিতে থাকবেন।
- শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বই থেকে
Post a Comment Blogger Facebook
Click to see the code!
To insert emoticon you must added at least one space before the code.