![]() |
আজো ছ’টা-দুটো হরতাল।
শেখ মুজিব হরতালের দিনগুলোতে বেতন পাওয়ার সুবিধের জন্য এবং অতি জরুরী কাজকর্ম চালানোর সরকারি-বেসরকারি সব অফিস দুপুর আড়াইটে থেকে চারটে পর্যন্ত খোলা রাখার নির্দেশ দিয়েছে। রেশন দোকানও ঐ একই সময়ে খোলা।
ব্যাঙ্কও তাই। আড়াইটে-চারটের মধ্যে টাকা তোলা যাবে। তবে দেড় হাজার টাকার বেশি নয়। বিকেলে ব্যাঙ্ক খোলা– ভাবতে মজাই লাগছে। শেখের একেকটা নির্দেশে সব কেমন ওলটপালট খেয়ে যাচ্ছে।
জরুরি সার্ভিস হিসেবে হাসপাতাল, ওষুধের দোকান, অ্যাম্বুলেন্স, ডাক্তারের গাড়ি, সংবাদপত্র ও তাদের গাড়ি, পানি, বিদ্যুৎ, টেলিফোন, দমকল, মেথর ও আবর্জনা ফেলা ট্রাক – এগুলোকে হরতাল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
আজ মসজিদ ও মন্দিরে বিশেষ প্রার্থনা। গোসল সেরে পৌনে একটার সময় শরীফ, রুমী, জামী, সুবহান – সবাই পাড়ার এরোপ্লেনে মসজিদে গেল।
তারপর আড়াইটের সময় খেয়ে দেয়ে শরীফ অফিসে রওনা দিল।
আজ বিকেল চারটের সময় লেখক সংঘের মিটিং তোপখানা রোডে। মিটিং শেষে সেখান থেকে মিছিল করে শহীদ মিনারে আসা হবে। আমি সাড়ে পাঁচটা-ছটা নাগাদ সোজা শহীদ মিনারেই যাব। হাঁটুতে বাতের জন্য বেশি হাঁটতে পারি না।
ক’দিন হট্টগোলে কিটিকে বাংলা পড়ানো হয় নি। আজ শরীফ চলে যাবার পর কিটিকে নিয়ে বসলাম। কিটি আমেরিকান মেয়ে– একটা স্কলারশিপ নিয়ে এ দেশে এসেছে ডিসেম্বরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে মুনীর চৌধুরীর আন্ডারে ‘সমাজ-ভাষাবিজ্ঞানে বাংলার মান নির্ধারণ’ বিষয়ে গবেষণা করার জন্য। ন’টা ভাষা জানে। বাংলা ভাঙ্গা বলতে পারে। তাড়াতাড়ি বাংলা শেখার জন্য কোনো বাঙালি পরিবারে বাস করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল কিটি। তাই মুনীর স্যার আমাকে অনুরোধ করেছিলেন, ওর জন্য একটা বাঙালি পরিবার খুঁজে দিতে। তিন-চার জায়গায় চেষ্টা করে না পেয়ে শেষে নিজের বাড়িতেই রেখেছি ওকে।
সপ্তাহে তিন দিন করে বাংলা পড়াই কিটিকে। বাড়ির অন্য সবার সঙ্গে সর্বক্ষণ বাংলায় কথা বলার চেষ্টা করে সে। আজ কিন্তু ওর বাংলা পড়ার কিংবা বাংলায় কথা বলার কোনো চেষ্টা দেখলাম না। সরাসরি ইংরেজিতে প্রশ্ন করে বস্ল, “আচ্ছা আম্মা, আমি যখন প্রথম আসি, তখন রাস্তায় আমাকে দেখলে লোকে উৎসুক হয়ে উঠত, আমার সঙ্গে আলাপ করতে চাইত। আর এখন কেন দেখলে বিরক্ত হয়? রেগে রেগে কি যেন বলে।”
আমি বিপদে পড়লাম। মেয়েটি খুব আবেগপ্রবণ এবং মেজাজীও। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে মনে মনে কথা গুছিয়ে নিয়ে বললাম, “এ প্রশ্নের জবাব দেবার আগে তোমাকে এ দেশের গত পঁচিশ ত্রিশ বছরের ইতিহাস ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিটা ভালো করে বোঝাতে হবে।”
মিটিংয়ে আর যাওয়া হল না। কিটিকে বোঝাতে বোঝাতে সন্ধ্যে কাবার হয়ে গেল।
- শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বই থেকে
Post a Comment Blogger Facebook
Click to see the code!
To insert emoticon you must added at least one space before the code.