মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি

<div dir="ltr" style="text-align: left;" trbidi="on"> <table align="center" cellpadding="0" cellspacing="0" class="tr-caption-container" style="margin-left: auto; margin-right: auto; text-align: center;"><tbody> <tr><td style="text-align: center;"><a href="https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiuVH5LFdn6GGlwDHfm4UkbPdtkdEIRNNlwkCPXQ3Y6Ox02S48Z3OgX3sQqoVoHKmnZ6ExQG876VaI4yIexfkkKnDlSJTPMFVr6dVqCv7RmcaVTwK_lGl0wYEYPuVX8isxVdA5MPLQG61U/s1600/np.jpg" imageanchor="1" style="margin-left: auto; margin-right: auto;"><img border="0" data-original-height="613" data-original-width="1181" height="332" src="https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiuVH5LFdn6GGlwDHfm4UkbPdtkdEIRNNlwkCPXQ3Y6Ox02S48Z3OgX3sQqoVoHKmnZ6ExQG876VaI4yIexfkkKnDlSJTPMFVr6dVqCv7RmcaVTwK_lGl0wYEYPuVX8isxVdA5MPLQG61U/s640/np.jpg" width="640" /></a></td></tr> <tr><td class="tr-caption" style="text-align: center;"> </td></tr> </tbody></table> ষোলোই ডিসেম্বর বিকেলের দিকে হঠাৎ সাড়া পড়ে গেল ক্যাম্পে। প্রথমে ফিসফাস গুঞ্জন, তারপর সবাই বলতে থাকে, 'স্বাধীন! স্বাধীন! স্বাধীন হয়ে গেছি আমরা!!' ঢাকা থেকে খবর এসেছে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে আজই, রেসকোর্স ময়দানে। চলো চলো, ঢাকা চলো সবাই।<br /> <div style="text-align: justify;"> <br /> ঝটপট প্রস্তুত হলাম আমরা। কাপড়ের ব্যাগটা কাঁধে নিলাম। বেড়ার গায়ে হেলান দিয়ে রাখা অস্ত্রগুলো সরিয়ে ফেলা হলো। ওগুলো আমরা সঙ্গে নেব না। যে খবর এসেছে তা কতটুকু সত্যি কে জানে? গত কদিন ধরে সত্যি-মিথ্যা নানারকম কথা শোনা যাচ্ছে।<br /> <br /> এই খবরটাই বা কতটা সত্যি কে বলবে? তাই ঢাকা শহরে প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে সিদ্ধান্ত হলো ব্যাগের মধ্যে দুটো স্টেনগান আর কয়েকটা গ্রেনেড নেওয়া হবে, যাতে প্রয়োজনে ব্যবহার করা যায়।<br /> <br /> ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে রওনা দিলাম আমরা। হাফিজ ভাই, মিনি মুজিব ভাই, আমি, মঞ্জু এবং আরও দু'জন- এই ছয় জন এক দলে। হাফিজ ভাই দলের নেতা। তার বন্ধু মুজিব ভাই বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ খুব ভালো নকল করতে পারে, তাই বন্ধুরা তাকে ডাকে 'মিনি মুজিব।'<br /> <br /> ছয়জনের দলটা হনহনিয়ে চলেছে গ্রামের পথে। দুপাশে হলুদ কার্পেটের মতো সর্ষের ক্ষেত। তার উপর এসে পড়েছে ডিসেম্বরের শেষ বিকেলের নরম রোদ। সর্ষের উজ্জ্বল রঙ আর সূর্যের সোনালী আভা মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। সূর্য দ্রুত নেমে যাচ্ছে দিগন্তের দিকে। অন্ধকার গাঢ় হয়ে নেমে আসার আগেই আমরা বুড়িগঙ্গা পার হতে চাই।<br /> <br /> কিছুদূর যাওয়ার পরই দেখা গেল উল্টো দিক থেকে পাঁচ-সাতজনের একটা দল আসছে আমাদের দিকে। ততক্ষণে শীতের সন্ধ্যা গাঢ় হয়ে নেমেছে। দলটা খুব কাছে আসার পর বোঝা গেল ওরা সশস্ত্র। প্রত্যেকের হাতে থ্রি-নট-থ্রি। আমাদের দিকে তাক করে আছে। কাছাকাছি আসতেই ওদের দলের সামনের লোকটা চিৎকার করে উঠলো, 'হ্যান্ডস আপ!'<br /> <br /> আমরা বোকার মতো হাত তুলে দাঁড়িয়ে গেলাম। ওরা আমাদের কোনো ক্ষতি না করে পাশ দিয়ে হনহনিয়ে চলে গেল উল্টো দিকে।<br /> <br /> দলটা একটু দূরে যেতেই হাফিজ ভাই চরম বিরক্তির সাথে বললো, 'মুজিব... স্টেন দুটো বের কর্। আর গ্রেনেডগুলো হাতে হাতে দিয়ে দে। এরা রাজাকার, পালিয়ে যাচ্ছে। রাজাকাররা আমাদের হ্যান্ডস আপ করলো! অসহ্য!!'<br /> <br /> বাজারের ব্যাগ থেকে বের হলো স্টেনগান, গ্রেনেডগুলো বিলি করা হলো। আবার এগিয়ে চললো দলটা। এবার আর হাঁটছি না আমরা, দু'পকেটে দুটো করে গ্রেনেড নিয়ে ছুটে চলেছি। দূরে রাস্তার ধারে নতুন টিনের কয়েকটা ঘর। সেখান থেকে গুলির শব্দ ভেসে এলো। রাইফেলের সিঙ্গেল শট, থেকে থেকে স্টেনগান আর কারবাইনের ব্রাশ ফায়ার।<br /> <br /> একটু এগোতেই বোঝা গেল ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করছে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা দল- উল্লাস করছে, আনন্দ করছে, আকাশের দিকে গুলি ছুঁড়ছে। ভেসে আসছে 'জয় বাংলা' চিৎকার। ওদের সঙ্গে কুশল বিনিময় হলো আমাদের। আনন্দে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরলাম। পাগলের মতো চ্যাঁচাচ্ছে সবাই- 'স্বাধীন! স্বাধীন!! আমরা স্বাধীন!!!'<br /> <br /> ওদের নেতার সঙ্গে কথা বলছিলেন হাফিজ ভাই। এখনি আবার রওনা দেব আমরা। বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে আছি, চারপাশে ঘর। দক্ষিণ দিকের ছোট একটা ঘরে জানলার শিক ধরে দাঁড়িয়ে ছিল কয়েকজন যুবক। ওদের ওখানে আটকে রাখা হয়েছে। জানালায় মুখগুলো দেখা যাচ্ছে শুধু। হঠাৎ সেখান থেকে কে যেন কাঁদো কাঁদো গলায় ডাক দিল, 'মঞ্জু ভাই!'<br /> <br /> মঞ্জু চমকে তাকালো ওদিকে, দুপা এগিয়ে গিয়ে অবাক গলায় বললো, 'আরে নবী... ! তুই এখানে কি করছিস?'<br /> <br /> জানা গেল ওর নাম নবী হোসেন, বলাকা সিনেমা হলের ব্ল্যাকার। টিকিট ব্ল্যাক করতো। সে রাজাকারের খাতায় নাম লিখিয়েছে, মাসিক আশি টাকার লোভে। মঞ্জু জানালো ও নবীকে চেনে। রাজাকার হলেও সে কারো ক্ষতি করেনি। বরং বিপদের সময় নীলক্ষেত এলাকায় উপকার করেছে দু'একজনের। মঞ্জুর অনুরোধে নবীকে ছেড়ে দেওয়া হলো। ছাড়া পেয়ে ছুটে পালালো নবী।<br /> <br /> পালানোর আগে খুব কাছে থেকে রাজাকার ছেলেটাকে একনজর দেখলাম আমি। আমাদেরই বয়সি এক তরুণ, অথচ যোগ দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শিবিরে। কেন? কি কারণে সে পাকবাহিনীর দোসর হয়েছে? শুধুই মাসিক আশি টাকার লোভে? নাকি অন্য কোনো কারণ আছে - আদর্শগত কোনো কারণ? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন নবীকে রাজাকার বানিয়েছে কারা? এতসব প্রশ্ন অবশ্য সেই সময় এভাবে গুছিয়ে আমার মাথায় আসেনি। এসেছে অনেক পরে।<br /> <br /> সেদিন অন্য দলের ছেলেদের কাছে বিদায় নিয়ে আমরা আবার পথে নেমেছিলাম। দৌড়াতে দৌড়াতে বুড়িগঙ্গার পাড়ে এসে দেখা গেল একটা নৌকাও নাই। জনহীন নদীর তীর। নৌকা নাই, মাঝি নাই, পার হবো কিভাবে? শেষমেশ বহু খোঁজাখুঁজির পর নৌকা এবং মাঝি পাওয়া গেল।<br /> <br /> কোনাকুনি নদী পাড়ি দিচ্ছে মাঝি। অন্ধকার রাত। কালো জলে ছপাস ছপাস দাঁড়ের শব্দ। নদী পাড়ি দিয়ে যেখানে নৌকা ভিড়ালো মাঝি, সেখানেই এক বাড়িতে থাকতো অবাঙালী তিনজন শার্প শুটার। তাদের গুলি এড়িয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঝি ঠিকই আমাদের পৌঁছে দিল এপারে।<br /> <br /> সারারাত জিপে করে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি শেষে পাগলের মতো জয় বাংলা চিৎকার দিতে দিতে গলা ভেঙে শেষরাতে লালকুঠিতে আমরা ক্যাম্প করলাম। লালকুঠিতে ছিল পাক আর্মির ঘাঁটি। যাবার সময় ওরা তাড়াহুড়ায় এখানে ওখানে গ্রেনেড, অস্ত্রশস্ত্র ফেলে গেছে। সোফার গদির নিচে আমি পেয়ে গেলাম একটা চাইনিজ স্টেন আর গোটা তিনেক ম্যাগাজিন।<br /> <br /> এদিকে পূবের আকাশ ফরশা হতে শুরু করেছে। কারো চোখে ঘুম নাই। আমরা কয়েকজন লালকুঠির ছাদে উঠে গেলাম। কি মিষ্টি বাতাস! দক্ষিণে নদী বুড়িগঙ্গা। নদীর উপরে লাফিয়ে উঠলো লাল বলটা - বাংলাদেশের প্রথম সূর্য! এত লাল!<br /> <br /> কে যেন প্রথম জয় বাংলা চিৎকার দিয়ে গুলি ছুঁড়লো আকাশের দিকে। তারপর সবাই। আমিও আমার সদ্য কুড়িয়ে পাওয়া স্টেনগানের ম্যাগাজিন খালি করে ফেললাম।<br /> <br /> তারপর...শুরু হলো পথ চলা। নতুন পথে।<br /> <br /> লিখেছেনঃ <a href="https://www.facebook.com/motazid.momtaz?hc_ref=ARRafqCz6wa1m_leBT3mlFvLTm4nUEzorK75ebJ7W4XYMf491Qlxh8uFXa2gKgnYn2c&fref=nf">Motazid Momtaz Khurram</a></div> </div>

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি

  ষোলোই ডিসেম্বর বিকেলের দিকে হঠাৎ সাড়া পড়ে গেল ক্যাম্পে। প্রথমে ফিসফাস গুঞ্জন, তারপর সবাই বলতে থাকে, 'স্বাধীন! স্বাধীন! স্বাধীন হয়ে গেছি আমরা!!' ঢাকা থেকে খবর এসেছে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে আজই, রে…

Read more »

বিজয় দিবসের প্রত্যাশা

<div dir="ltr" style="text-align: left;" trbidi="on"> <table align="center" cellpadding="0" cellspacing="0" class="tr-caption-container" style="margin-left: auto; margin-right: auto; text-align: center;"><tbody> <tr><td style="text-align: center;"><a href="https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiuVH5LFdn6GGlwDHfm4UkbPdtkdEIRNNlwkCPXQ3Y6Ox02S48Z3OgX3sQqoVoHKmnZ6ExQG876VaI4yIexfkkKnDlSJTPMFVr6dVqCv7RmcaVTwK_lGl0wYEYPuVX8isxVdA5MPLQG61U/s1600/np.jpg" imageanchor="1" style="margin-left: auto; margin-right: auto;"><img border="0" data-original-height="613" data-original-width="1181" height="332" src="https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiuVH5LFdn6GGlwDHfm4UkbPdtkdEIRNNlwkCPXQ3Y6Ox02S48Z3OgX3sQqoVoHKmnZ6ExQG876VaI4yIexfkkKnDlSJTPMFVr6dVqCv7RmcaVTwK_lGl0wYEYPuVX8isxVdA5MPLQG61U/s640/np.jpg" width="640" /></a></td></tr> <tr><td class="tr-caption" style="text-align: center;"> </td></tr> </tbody></table> <div style="text-align: justify;"> আমাদের বয়সী যেকোনো মানুষকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় দিন কোনটি? সে অবধারিতভাবে বলবে, সেটি হচ্ছে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। আমি মনে করি, আমাদের বয়সী মানুষরা যারা সেই দিনটিতে বাংলাদেশের জন্ম হতে দেখেছি, সেই সময়ের তীব্র আনন্দটুকু পৃথিবীর খুব কম মানুষ অনুভব করেছে।<br /><br />আমরা খুবই সৌভাগ্যবান একটি প্রজন্ম, যারা সেই অবিশ্বাস্য আনন্দটুকু অনুভব করার সুযোগ পেয়েছিলাম।<br /></div> <div style="text-align: justify;"> অথচ বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, সেই দিনটিতে যখন একজনের সঙ্গে আরেকজনের দেখা হয়েছে তখন প্রথম অনুভূতিটি হচ্ছে একধরনের বিষাদ। কারণ সারা দেশে একজন মানুষও ছিল না, যার কোনো না কোনো আপনজন বা প্রিয়জন সেই যুদ্ধে মারা যায়নি। নতুন বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম কল্পনাও করতে পারবে না, একটি দেশের স্বাধীনতার জন্য একটি দেশের মানুষ কত বড় আত্মত্যাগ করেছে। বাংলাদেশের পতাকার মধ্যখানে যে লাল বৃত্ত, সেটি সাধারণ মানুষের কাছে শুধু এক টুকরা লাল কাপড়, কিন্তু আমরা জানি সেই লাল রং কোথা থেকে এসেছে, আমরা জানি সেই লাল রঙে আমাদের সব আপনজনের বুকের রক্ত একটুখানি হলেও আছে।<br /><br /> ১৯৭১ সালের বিজয়ের আগের দিনগুলোর স্মৃতি আমাদের এখনো এত স্পষ্টভাবে মনে আছে যে মনে হয়, এটি মাত্র সেদিনের ঘটনা। আমাদের পুরো পরিবার তখন পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন, কে কোথায় আছে, কেমন আছে, আদৌ বেঁচে আছে কি না—আমরা কিছুই জানি না। আমি যাত্রাবাড়ীতে একটা পরিবারের সঙ্গে অনেক শিশুকে নিয়ে আছি। ১৯৭১ সালের যাত্রাবাড়ী আজকের যাত্রাবাড়ীর মতো নয়, মোটামুটি ফাঁকা।<br /><br /> রাস্তার দুই পাশে বাড়িঘর নেই। আমি সেখানে আছি তার চারপাশে ছোট একটা জনবসতি।<br /><br /> তখন শেষ যুদ্ধ শুরু হয়েছে। দিনরাত গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাই। শেলিং হচ্ছে, একটি-দুটি শেল আশপাশে পড়ছে, সে রকম খবরও ভেসে আসছে। মাঝেমধ্যে এত কাছে থেকে এত তীব্র গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাই যে মনে হয়, এই বুঝি সেগুলো আমাদের গায়ে এসে লাগবে। এ রকম সময়ে কিছু না করে চুপচাপ বসে থাকা যায় না, তাই কিছু একটা করার উদ্দেশ্যে একটি কোদাল দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে ঘরের উঠানে একটা ট্রেঞ্চ খুঁড়ে ফেলা হলো। ট্রেঞ্চের ওপরে একটা ঢেউটিনের আস্তরণ। যখন গোলাগুলির শব্দ খুব বেড়ে যায়, তখন বাচ্চাগুলোকে নিয়ে সেই ট্রেঞ্চের ভেতর বসে থাকি।<br /><br /> বাড়িটার পাশেই রাস্তা, সেই রাস্তা দিয়ে মিলিটারির বহর যাচ্ছে-আসছে। একদিন মিলিটারিরা সেই রাস্তা দিয়ে যাওয়া একটা স্কুটারের সব যাত্রীকে মেরে ফেলল। আমরা দেখতে পাই, স্কুটারের ভেতর থেকে মৃত মানুষগুলোর হাত-পা বের হয়ে আছে। মৃত মানুষগুলো প্রকাশ্য রাস্তায় স্কুটারের ভেতর দিনের পর দিন পড়ে আছে, কেউ সেটা নিয়ে বিচলিত হচ্ছে না।<br /><br /> একসময় লক্ষ করলাম, রাস্তা দিয়ে বড় বড় ট্যাংক ঘড়ঘড় শব্দ করে ঢাকার দিকে ফিরে যাচ্ছে। তার সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য পাকিস্তানি মিলিটারি! ‘পশ্চাদপসরণ’ বলে একটা শব্দ আছে, এই মিলিটারি বাহিনীকে দেখলেই বোঝা যায় তারা সেই পশ্চাদপসরণ করছে। প্রাণের ভয়ে? আমরা দূর থেকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকি।<br /><br /> ঠিক তখন একদিন যখন সূর্যের আলো নিভু নিভু, অন্ধকার নেমে আসছে, গোলাগুলির শব্দ কমে আসছে, তখন নৈঃশব্দ বিদীর্ণ করে একজন চিৎকার করে উঠল, ‘জয় বাংলা’।<br /><br /> মুহূর্তের মধ্যে আমরা বুঝে গেলাম দীর্ঘ প্রতীক্ষার শেষ হয়েছে, যে স্বাধীনতার জন্য বুভুক্ষের মতো আমরা অপেক্ষা করছিলাম, সেই অপেক্ষার শেষ হয়েছে। সেটি জানার জন্য আমাদের প্রয়োজন ছিল শুধু একটি স্লোগান! জয় বাংলা।<br /><br /> কী আশ্চর্য, মুক্তিযুদ্ধের সেই স্লোগানটি এ দেশে নির্বাসিত হয়েছিল। শুধু স্লোগানটি নয়, যে মুক্তিযুদ্ধের জন্য এই স্লোগান সেই মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত দেশ থেকে নির্বাসিত করা হয়েছিল, দেশের শাসক হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত স্বাধীনতার শত্রুরা! ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে ছিল শুধু আওয়ামী লীগের কর্মীদের মধ্যে। কেউ সেই স্লোগানটি উচ্চারণ করলেই মানুষ ধরে নিত সেই মানুষটি নিশ্চিতভাবে আওয়ামী লীগের কর্মী। দেশের মানুষ মনে হয় ভুলেই গেল যে এটি কোনো রাজনৈতিক দলের স্লোগান ছিল না। এই স্লোগানটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র গর্জে ওঠার আগে তাঁদের কণ্ঠ থেকে প্রকম্পিত হতো এই স্লোগান।<br /><br /> গণজাগরণ মঞ্চের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই যে তারা মুক্তিযুদ্ধের সেই স্লোগানটি আবার আমাদের উপহার দিয়েছে। কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য না হয়েও এখন একজন শুধু মুক্তিযুদ্ধের প্রতি গভীর ভালোবাসায় জয় বাংলা স্লোগানটি দিতে পারে!<br /><br /> ২.<br /><br /> বাংলাদেশটি আমরা এমনি এমনি পাইনি। এই দেশটি পাওয়ার একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে। একসময় আমরা পাকিস্তানের অংশ ছিলাম। সেই পাকিস্তান দেশটির জন্য যে লাহোর প্রস্তাব ছিল, সেখানে বহুবচনে দুটি দেশের কথা বলা হয়েছিল। ‘মুদ্রণ প্রমাদ’ বলে দুটি দেশের ধারণাটিকে সরিয়ে একটি পাকিস্তান তৈরি করা হয়েছিল। আমরা জন্ম থেকে দেখে আসছিলাম বলে মেনে নিয়েছিলাম, এখন নিশ্চয়ই সবাই চোখ কপালে তুলে বলে, এটি কিভাবে সম্ভব? একটি দেশের দুই টুকরা দুই জায়গায়, মধ্যখানে হাজার কিলোমিটার দূরত্ব? সেটিই ছিল আজব স্থান পাকিস্তান! জনসংখ্যায় আমরাই ছিলাম বেশি, অথচ সম্পদের বড় অংশ ভোগ করত পশ্চিম পাকিস্তান। পুরো দেশটিই যে ছিল ষড়যন্ত্রের জোড়াতালি দিয়ে তৈরি করা একটি দেশ, সেটি বুঝতে বাঙালিদের মাত্র বছরখানেক সময় লেগেছিল যখন পাকিস্তানের স্থপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে ঘোষণা দিয়ে গেলেন উর্দু এবং শুধু উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা! ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন হলো, রক্ত দিয়ে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হলো। ১৯৫৪ সালে বঙ্গবন্ধু আর সহনেতারা প্রাদেশিক নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে সরকার গঠন করলেন; কিন্তু বছর ঘোরার আগেই সেই সরকারকে বাতিল করে দেওয়া হলো। বঙ্গবন্ধু তখন একজন তরুণ রাজনৈতিক নেতা, কিন্তু তাঁর বুঝতে বাকি রইল না যে পাকিস্তানের এই ষড়যন্ত্র থেকে মুক্তি লাভের একটি মাত্র উপায়, সেটা হচ্ছে স্বায়ত্তশাসন। তিনি ছয় দফার আন্দোলন শুরু করলেন।<br /><br /> এ দেশের নতুন প্রজন্মের যারা দেশকে নিয়ে চিন্তাভাবনা করে তাদের সবার এই ছয়টি দফা একবার হলেও পরে দেখা উচিত, তাহলে তারা অবাক হয়ে আবিষ্কার করবে যে ছয় দফা আসলে একটি মাত্র দফা, যার আসল অর্থ হচ্ছে স্বাধীনতা! পাকিস্তানে তখন আইয়ুব খানের সামরিক শাসন, বঙ্গবন্ধু আর তাঁর সহকর্মীরা বেশির ভাগ সময়ই জেলখানায় থাকেন। রাজনৈতিক নেতাদের বলতে গেলে কেউই বাইরে নেই, ছাত্ররা আন্দোলন করে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করে আনল (আজকাল কেউ কল্পনা করতে পারবে, এখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছাত্রলীগ আছে ক্যাফেটেরিয়া ক্যান্টিনে ফাউ খাওয়া থেকে যারা বড় কিছু চিন্তা করতে পারে না, তাদের পূর্বসূরিরা একসময় এত বড় বড় কাজ করেছেন!)।<br /><br /> ১৯৬৯ সালে বিশাল গণ-আন্দোলনে সামরিক শাসক আইয়ুব খানের পতন ঘটল, ক্ষমতা দেওয়া হলো সর্বকালের নৃশংস দানব ইয়াহিয়া খানের কাছে। এখনো অবশ্য আমরা তার সেই পরিচয়টির কথা জানি না।<br /><br /> ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার প্রতি স্বীকৃতি জানিয়ে বাঙালিরা তাঁকে একটা অভূতপূর্ব বিজয় উপহার দেয়। বাঙালিরা প্রথমবার এ দেশের শাসনভার গ্রহণ করবে, পাকিস্তানি মিলিটারির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল! তাদের বিশাল ষড়যন্ত্রের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী তারা নির্বাচনের রায় অস্বীকার করা মাত্রই সারা দেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন, তাঁর অঙ্গুলি হেলনে এ দেশ চলতে শুরু করল। ৭ই মার্চ রেসকোর্সে তিনি তাঁর সেই ঐতিহাসিক ভাষণটি দিলেন। সেটি শুনলে এখনো আমার শরীরে শিহরণ জাগে!<br /><br /> ২৫ মার্চ পাকিস্তান মিলিটারি এ দেশে গণহত্যা শুরু করল, ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন, শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ।<br /><br /> ৯ মাসের সেই যুদ্ধের ইতিহাস হচ্ছে আত্মত্যাগের ইতিহাস, বীরত্বের ইতিহাস আর অর্জনের ইতিহাস। পৃথিবীর কয়টি দেশ এ রকম একটি গৌরবের ইতিহাস দাবি করতে পারবে?<br /><br /> ৩.<br /><br /> বাংলাদেশের একটি কালো অধ্যায়ের সময় ছিল যখন সেই ইতিহাসকে অস্বীকার করা হতো কিংবা খাটো করে দেখানো হতো। প্রজন্মের পর প্রজন্মকে বোঝানো হতো বঙ্গবন্ধু বলে কেউ নেই, কেউ ছিল না, জিয়াউর রহমান নামের একজন মেজরের ঘোষণায় এ দেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে; দেশ স্বাধীন হয়েছে। রাজাকার শব্দটি উচ্চারণ করা যেত না। পাকিস্তান বলা যেত না, বলতে হতো হানাদার। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতেন, তাঁদের শাসন করা হতো, শাস্তি হিসেবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বদলি করে দেওয়া হতো। যুদ্ধাপরাধের বিচারের কথা উচ্চারণ করলে দেশদ্রোহী হিসেবে মামলা করে দেওয়া হতো।<br /><br /> ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা আমাকে জিজ্ঞাসা করত, ‘স্বাধীনতার ঘোষক কে?’ (স্বাধীনতা যেন একটি ছেলের হাতের মোয়া, কোনো একজন তার কথা ঘোষণা করলেই দেশ স্বাধীন হয়ে যায়!)। তারা জিজ্ঞাসা করত, রাজাকাররা কেমন করে মন্ত্রী হয়? যারা এ দেশ চায়নি, এ দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করেছে, তারা কেমন করে এ দেশ শাসন করে? তারা কেমন করে তাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়?<br /><br /> আমাদের অনেক বড় সৌভাগ্য, সেই দুঃসময় আমরা পেছনে ফেলে এসেছি। কেউ আমাদের কাছে জানতে চায় না স্বাধীনতার ঘোষক কে? নতুন প্রজন্ম এখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানে। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ওরা পাঠ্য বইয়ে পড়েছে, নিজের কানে শুনতে পেয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এ দেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতে দেখেছে, দেশকে গ্লানিমুক্ত হতে দেখেছে।<br /><br /> এ দেশকে নিয়ে অনেকের অনেক কিছু চাওয়ার আছে, আমার আর কিছু চাওয়ার নেই। এ দেশ থেকে আমি যা চেয়েছিলাম তার চেয়ে বেশি পেয়েছি। বিজয় দিবসের প্রাক্কালে নতুন প্রজন্মের কাছে আমার শুধু একটি মাত্র প্রত্যাশা, যেটুকু পেয়েছি সেটি যেন কোনোভাবে আবার হারিয়ে না ফেলি।</div> </div>

বিজয় দিবসের প্রত্যাশা

  আমাদের বয়সী যেকোনো মানুষকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় দিন কোনটি? সে অবধারিতভাবে বলবে, সেটি হচ্ছে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। আমি মনে করি, আমাদের বয়সী মানুষরা যারা সেই দিনটিতে বাংলাদ…

Read more »